ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়
(গঙ্গাসাগরে স্নানের প্রেক্ষাপটে নরনারীর সম্পর্কের পরিণতির এই গল্পটি বাংলা সাহিত্যে প্রথম সারির লেখা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। ১৯৮৬ সালে লেখা গল্পটি নতুন করে প্রকাশ করতে সম্মতি দিয়েছেন লেখক। বঙ্কিম পুরস্কার-সহ বহু সম্মানে সম্মানিত ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়কে নতুন করে পরিচয় করানোর প্রয়োজন নেই। তাঁর এই গল্পটি পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে, আজও সাগরের স্নান করতে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে হয়তো লুকিয়ে রয়েছে এমনই কত চরিত্র।)
পানটা সেজে মুখে পুরতেই কানে বাজে হৃদয়রঞ্জনের অনুযোগ, …আচ্ছা পূর্ণি একটা পান বরোজ বসালে তোমার ক’দিন কুলোবে…
গালের পান গালেই থাকে, দু-চোখ আস্তে আস্তে কেমন ভারি স্থির লেপটে যায় দেওয়ালে। স্টিলের ক্র্যাচটা দেওয়ালের ঠেকনোয় কাত খেয়ে দাঁড়িয়ে। ঠিক তার সোজাসুজি উপরে ছবিটা। হাসিখুশি মধ্যবয়স্ক মুখ। শার্টের কলারে মোটা তোয়ালের টুকরো রুমাল গোঁজা। ঘামের দাগ রুখতে বরাবরের অভ্যেস এখনও গেঁথে আছে, তিন বছরের ধুলো জালি ঝাপসা ফটোতে।
—নেশা বলতে পান… বড্ড খরচ করাই না…, এই বাঁধা উত্তরটা নিজের মনে স্মরণ করে। উচ্চারণ ফোটে না। বরং জোরে শ্বাস ছেড়ে ভাবে, তার কথা তো এখনও চমকে চমকে শুনি… আমার কথা…!
মালতী কোমরে আঁচলটা বেড় দিয়ে ঘরে ঢোকে, দিদি মাখম আসছ্যে গো
খেয়াল হয় কাটা পা-টা ঢেকে আছে, বাঁ পায়ের হাঁটু অব্দি উদোম। বাঁধানো রকের মেঝে, মাটির দেওয়াল খোড়ো চালের লম্বা দৌড় ঘরদোর। নিচু জানালায় ফুরফুরে হাওয়া। ছ্যাঁক ছেঁকে শীতলতা। শায়া শাড়ি টানতে টানতে বলে, ডাক দে যা—
দোরগোড়া ডিঙোতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় মাখম। পূর্ণিমার ফরসা পায়ের গোছে দু-চারখানা কালো রোম যেন বর্ষা ধোওয়া ঘাসের ডগ।
—কী হল, আসবে তো, বলে মেঝেয় হাত চাপড়ে বসতে জানায়।
মাখমের বুকের ভেতরটা ছম ছম করে। আজকাল পূর্ণিমা কত কাছাকাছি বসতে ডাকে। গত বছর প্রয়াগ সঙ্গমে ছাই ভাসাতে গিয়ে মেয়ে মানুষটা সব ব্যাপারে কত যে নির্ভর করতে শুরু করেছে…! যমুনার নীল জলে ডুব দিয়ে রুপোর কৌটোয় হৃদয়বাবুর অস্থি ভাসিয়ে দিয়েছিল পূর্ণিমা। বেঁটে খাটো। গায়ে মাসে বড় মানুষের বউ।
চোখ মুখ ভিজে। রোদে বাতাসে কাপড়চোপড় টেনে গেলেও দু-চোখ একদম শুকোয়নি। ওদিকে গঙ্গা সাদা জল বয়ে এনে যমুনার নীল শরীরের আস্তে আস্তে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। টুকরো নুড়ি পাথরে মুঠো মুঠো ঘুলোনো ফেনা। টিনের নৌকোয় মাখম, হাতে পোটলা পুটলি নিয়ে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমাকে দেখতে দেখতে ভেবেছিল, জমি জায়গার মালিক না হলে, তীথ্যি ধম্ম পুণ্যি করা যায়? কত গাড়ি ভাড়া খরচ খরচা…।
যমুনার জলে মাচা বেঁধে দাঁড়াবার ব্যবস্থা। হাঁটু ডুবে আছে নীল জলে। মাচার গায়ে টিনের নৌকো। ডান বগলের ক্র্যাচটা সরিয়ে পূর্ণিমা ভারি শরীর নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে বলেছিল, মাখমদা ধরো গো—
বড় মানুষের বউ, ভিজে কাপড়চোপড় গায়ে লেপটে। হৃদয়বাবুদের দশ বিঘা জমি ভাগে চাষবাস করে পেট চলে…তার বউয়ের হাত ধরাধরি…!
—আগো ধরবেনি।
পূর্ণিমার ঘেরা উঠোনের ওপাশ দিয়ে খোয়া ফেলা সহজরাস্তা। রাস্তায় ভ্যান রিকশার হর্নের বিকট খ্যাচখ্যাচানি শব্দ। লঞ্চ এসেছে এপারে। প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাচ্ছে। বাস ধরবে। কলকাতার ডি-লাক্স।
পূর্ণিমা মাখমের শুকনো অথচ মগ্ন দু-চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, খবর কী বলো তো মাখমদা? তোমার বাড়ি ভালো—
মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ জানায়।
—পান খাও, বলে পাশে বসায়।
পাতলা খোলের ফুলকাটা রঙচঙে শাড়িটায় বড়লোকি গন্ধ। মাঝে মাঝে বিভ্রম জাগে মাখমের, হৃদয়বাবুর বউ তো…! নাকি বাস ম্যাটাডোরের কোন আইবুড়ো মেয়েছেলে।
—মাখমদা।
—বলো
—ঘুঘুডাঙার কিছু হ’ল?
— হবে আবার কী? লোকগুলো হেঁকে দিলো, হৃদয়বাবুর তো পাঁচ-সাতটা ছেলেপুলে নাই একলা গিন্নি মানুষ, তার আবার কত খোরাকি? চোখ বড় বড় করে শোনে পূর্ণিমা।
মাখম গড় গড় করে বিবরণ দেয়, চাষীরা বলেছে কী আর ধান দুবো। যা হোক, দু-চার বস্তা লিবে খোন। বরং নিজেদের ছেলেপুলেকে খাবাই পরাই
—এমএলএ-র বাড়ি যাওনি?
—সে আর বলতে। তোমার খুড়তুতো ভগ্নিপতি? সে সব শুনে বলল, ও তো আমার জানা।
—তারপর…
—এমএলএ. বাবু বলল, এক্ষুনি মিটিংয়ে যাবো। সাগর মেলার ঝামেলা কাটুক তারপর ডেকেডুকে সব শুনবো।
—নিজে মুখে সব বলেছে তো…
—না তো কি? তোমাকে মনগড়া গপ্পো ফাঁদছি, অভিমান গড়ায় গলার স্বরে।
ঝুঁকে পড়ে হাতটা ধরে পূর্ণিমা বলল, মাখমদা কথার পিঠে কথা উঠলেই ঝল্কে ওঠো— ঠিক তোমার বাবুটা অমন করতো…
ছ্যাঁৎ করে ধারালো ফলার মতো লাগে মাখমের পাঁজরায়। এত করেও হৃদয়বাবু খোঁচা মারে বুকের হাড়ে।
মুখটা শুকিয়ে যায়, চোখ দু’টো ছোট হয়ে আসে। পূর্ণিমা তার দু-চোখের দর্পণে টের পায়, মানুষটার ভেতরে আগুন ধরেছে। হল্কা লাগছে নিজের আটাশ-তিরিশের গাল গলার মাংসে, চামড়ায়।
পুরনো দিনের গোলাঘর উঠোনের মাঝে। চলা ফেরায় লক্ষ্য। সব সময় মা লক্ষ্মীর প্রতি বিনম্র আচরণ। আবার গোলা ভরানোর জন্যে বছরভর পরিশ্রম। সকাল হলে ছড়া ঝাঁট, সন্ধেয় আঁচল গলায় দিয়ে সন্ধ্যাপ্রদীপ, সে সব কবে উঠে গেছে। মানুষটা বেঁচে থাকতে থাকতে। গোলাঘরের মাচার তলায় ক’টা মুরগিছানা চেঁচামেচি করছে। পোষা কুকুরটা বিশ্রী ডেকে যাচ্ছে। পূর্ণিমা হাঁক দেয়, ও মালতী কুকুরটা অতো ডাক ছাড়ে কেন রে?
সম্বচ্ছরের খাওয়া পরায় কাজের মেয়ে মালতী হাতের কাজ ফেলে বাইরে এসে অবাক।
—ও দিদি হাই যা
—কিরে?
—কেউটিয়া
—কোথ্কেরে
—গোলাতলায়
হুটপাট করে দেওয়াল ধরে উঠতে যায় পূর্ণিমা। ক্র্যাচটা পড়ে যেতেই ঠক শব্দ। সোজা এক ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে অসহায় পূর্ণিমা।
মাখম ক্র্যাচটা ধরিয়ে দেয় পূর্ণিমার ডান দিকে। ফরসা গোলগাল মুখে একটা আশ্রয়।
—মাখমদা যাও, একটু সামলাও।
—তুমি থাকো না। আমি দেখি ঠি-লাঠি কই গো? এই মালতী লাঠি দেনা—
বেরিয়ে আসে মাখম। দূর থেকে প্রথম সন্দেহ জাগে। লাঠিটা হাতে পেয়ে আরও কাছে যায়। একটু নিরীক্ষণ করে গজরে ওঠে মাখম, হেই দাঁড়া মালতী তোর কোমর আগলি ভাঙি…ওইটা কেউটা, না দাঁড়াস?
ডান বগলে ক্র্যাচটা লাগিয়ে ঠক ঠক করে দরজা ডিঙোয় পূর্ণিমা। ঘর থেকে চেঁচিয়ে নিষেধ করে, মাখম তাহলে থাক্-থাক্-ওটা বাস্তুসাপ।
একটুও তাড়া দিতে হয়নি। নিজের খেয়ালে নালাপথ বেয়ে বেরিয়ে যায় প্রাণীটা। ওটা বেরুলে হৃদয়রঞ্জন বলতো, যা-মা যাহ্। মনসাতলায় পুজো দিস্ তো…ভাবছে ভাবতে মাখমকে দেখে পূর্ণিমা। হঠাৎ কানে এলো, যাহ্ মা যা…।
বিস্ময়ে স্থাণু পূর্ণিমা। একেবারে নিজের মানুষটার মতো আবেদন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, পুরুষে পুরুষে তফাৎটা তাহলে কোথায়!
দেড়খানা ড্রয়ারের ড্রেসিং টেবিল। কালো মেহগনি কাঠের বনেদী জিনিস। বড় ড্রয়ারের মধ্যে আর একটা ছোট্ট নিরাপদ আলাদা চাবির বাক্স। সেটা খুলে খুচরো পয়সা দু-টাকা পাঁচ টাকার নোট হাতখরচের জন্যে রাখা। পাশে একদা রুপোর সিঁদুর কৌটো যার মধ্যে একটুও সিঁদুর আর নেই এখন। সেটা জ্বলে ওঠে। খুব যত্নে সেটা দেখে ভাবে, সাগর মেলা আর ক’দিন? মানুষটার শেষ অস্থিটুকু…
—বউদি
ঘাড় ফেরায় পূর্ণিমা। মাখম দাঁড়িয়ে, তার কালো পরিশ্রমী চেহারা। সাবানকাচা ধুতি শার্টে কালো মুখচোখ ভীষণ পুরুষালি। অমন মানুষই বউ বাচ্চা আগলে সামলে রাখতে পারে…
—ঘর যাই
—যাবে তো। খরচ খরচা কইলে নি?
—কত আর। যা দিছিলে টাকা দুই বেশি লাগছে। এমএলএ-র হাতের লোক কুণ্ডুপদ ধরে বসলো, চা খাবাও ম্যানেজার।
পূর্ণিমা হেসে ফেলে। মাখমের নাম পাল্টাচ্ছে, পরিচয়ও
—কী দিবে দাও, নাই তো থাক।
—থাকবে কেন?
—গাড়ি ঘোড়ার বড্ড বেহাল। সাগর মেলার প্যাসেঞ্জারদের ভিড়।
—খুব ভিড়…, বলতে বলতে বুকের ভেতরটা কুঁকড়ে যায় পূর্ণিমার। পথ হাঁটতে গেলে সব কিছু নজরে রাখতে হয়, বাসে গাড়িতে আরও দাঁত কামড়ে সাবধান তো বটে।
—ভিড় মানে… ঘাটে তো পাঁচখানা নতুন জেটি, দু’শো লঞ্চ, তালপাটি, রসুলপুরের ফেরিবোট যেন এক একটা জাহাজ-সব গাঙ পাড়ে।
অতো চামড়া ছাড়িয়ে দেখতে শুনতে চায় না পূর্ণিমা। তবু হা করে তাকিয়ে থাকে মাখমের হাত মুখ নাড়াচাড়ার কায়দাকানুনের দিকে।
—আগো আসার সময় তো শুনে এলুম, বোটওয়ালা আলকাতরা লাগিয়ে মাস্তুলে রঙচঙ মাখিয়েও প্যাসেঞ্জার পাকড়াতে পারছেনি। সব লঞ্চো করে পারাচ্ছে
—মাখমদা লে যাবে…
—কাই গো?
—সাগরে
চেনা আদলে একেবারে নতুন মেয়েছেলের জোর নিয়ে দাঁড়ায়। বলে।
শেষ রাত। পুব আকাশে মেঘ আঁধারের পর্দায় সূর্য ঢাকা। সমুদ্রের জল চর ছাড়িয়ে অনেকটা নীচে। সবে জোয়ার লেগেছে। গোটা বালিচরে শালের খুঁটিতে খুঁটিতে আলো। জেনারেটার গুলোর ভটভট শব্দ। বাঁশ খুঁটোর বেড়া আর কাঁটাতারের লম্বা লাইন দিয়ে পুণ্যার্থীদের অবগাহন দ্বারপথ। মেলায় তথ্যবিভাগের বড় টাওয়ার থেকে গম্ভীর সংস্কৃত স্তোত্র ভেসে আসছে। সামনে পিছনে অসংখ্য মানুষ। জল কিনারায় দু-চারখানা বোট ডিঙি, তাতে তাদের হ্যারিকেন লণ্ঠন জোরে জ্বলছে। পুণ্য মহাতিথির মোক্ষ মুহূর্ত ধরার জন্যে সচেতন প্রচেষ্টা।
ঠুক ঠুক করে ক্র্যাচ তুলে তুলে হাঁটে সমুদ্রের দিকে, জলের দিকে পূর্ণিমা। পাশে পাশে মাখম।
বালি ভিজে নরম। কিছু পলি মাটির আস্তরে ক্র্যাচের নাল ডুবে যায়। পূর্ণিমা বাঁ পায়ে ভর রেখে ডান দিকের ক্র্যাচ তুলতে তুলতে বলে, মাখমদা…
—বলো
—আছো
—হুঁ
—তুমি না আনলে কে নিয়ে আসতো এমন কষ্টের জায়গায়
—ভাইয়েরা
—দূর। জায়গা জমি দেখে ভারি বয়সী লোকের সঙ্গে বিয়া দিয়ে খোঁড়া মেয়ের ঝক্কি তাড়াইছে—
হাওয়া, শীতের হাওয়ায় ধার। নিজের গায়ের শালটা টেনে নেয় পূর্ণিমা। মাখমের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, আমার ভুল হইছ্যে
—কি গো
—তোমাকে একটা মোটা চাদর কিনে দিলে ঠিক হ’ত। ওই পাতলায় শীত কাটে? একেবারে আচমকা গায়ের শালটা খুলে বাড়িয়ে ধরে, নাও জড়াও।
মাখম অবাক হয়ে দাঁড়ায় খানিক। পূর্ণিমাকে, তাদের বড় মানুষের বউটাকে দেখতে পায় না। পাশে পিছনে ঝাপসা। সামনে তল কিনারাহীন সমুদ্র। জলের মৃদু শব্দ।
—লও, আমি তো ডুববো
সামনে ধারালো হাওয়ায় জল বাড়ছে। পাশাপাশি স্নানার্থী বৃদ্ধ বৃদ্ধার দল পশ্চিমি গলায় বন্দনা গায়, বলিয়ে বাবা কপিল মুনি কি? —জয়, ইন্দ্রদেও কি?—জয়, সাগর রাজা কি? —জয়…
ভোরমুখো বালিচর কেঁপে ওঠে মানুষের গলায়। এই একটা দিন এমন ভোরের তিথির জন্যে সারা বছর গা ঢলিয়ে পড়ে থাকে জায়গাটা।
পূর্ণিমা গলা মিলোতে গিয়ে কোথায় যে আটকে যায়। ভাবে, আমি আমার জন্যে তো নয়… বলে পেট কাপড়ে রুপোর সিঁদুর কৌটোয় হাত বুলিয়ে আন্দাজ নেয়। শুধু মানুষটার শেষ অস্থি… শেষ ইচ্ছে…
পূবের আকাশে লালছে আভা কাটে।
হাঁটু ডুবি জল। ছোট ছোট ঢেউ। বালি ঘুলিয়ে পুণ্য বারি। দু-একখানা বোট ডিঙির নোঙর বাঁধা কাছি। বোটের গায়ে পিঠে জলের ঝাপটায় চাপাট চাপাট শব্দ।
—আর আগাবো?
—পারলে সারো, বলে মাখম।
কাঁধের পোঁটলাটা দিয়ে দেয় মাখমকে। সোয়েটার খুলে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ব্যাগে রাখো। একটা একটা করে প্রায় সব নিঃসঙ্কোচে দিয়ে দিচ্ছে বাবুর বউটা। ভেতরে ভেতরে কুঁচকে যায় মাখম। পূর্ণিমার কিছু বলতে গিয়েও কেমন ভালো লাগে না। সামনে ভোরের অমন সমুদ্র, কত পুণ্যপ্রার্থী মানুষ। এখনও হাত বাড়ায়নি মাথম। পূর্ণিমা মুখটা বাড়িয়ে ফিস ফিস করে বলে, নাও…
হাওয়া বেড়েছে, জল ফুলছে। বলল, দাও…
—ভয় কিসের…! সুমুদ্দুর ছাড়া আর তো কেউ নেই—
মাখম কোন উত্তর করে না।
পূর্ণিমা রুপোর কৌটোয় হাত বুলিয়ে একবার সমুদ্রটা দেখে, পরে বলে, বউ বাচ্চার জন্যে ভয়? মাখমদা তুমি যেমন ওদের তেমন থাকবে…
মাখমের মনে হ’ল, আশপাশে কোন মানুষজন নেই। একেবারে একলা সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে।
—আর দু-পা আগাই? মাথা ডুববেনি যে…
—তোমার চানের কাছে আমি…
—থাকলেই বা!
ছোটবড় ঢেউ জাগছে। সামনে সমুদ্র উথালপাথাল। ধস্ত হতে চাইছে সমস্ত শরীর নিয়ে।
সেই কোন যুগ থেকে এমন প্রতীক্ষা।
দু-হাতে ভর দিয়ে উবু হয়ে বসে এক পায়ের ঠেকনোয়। একেবারে অবলম্বনহীন একটা মেয়ে মানুষ। আবছা ভোরের অস্পষ্টতায় অতদিনের সঙ্গী পুরুষটার জন্যে বুক মুচড়ে যায়। দু-ফোঁটা জল চোখ ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ে। পেট কাপড়ে রুপোর কৌটোটা খুলে জলে মেলে ধরে। কত চেনা দেহের অবশেষটুকু জলে ভেসে যায়, সমুদ্র থেকে মহাসমুদ্রে, পঞ্চভূতে। একটা ডুব দিয়ে একেবারে ধুয়ে যায়। মানুষটার আর কোন কিছু কাছে নেই। একেবারে নিজের মতো একলা।
হাত বাড়ায়, মাখমদা ধরো—
ভিজে গা বুক। লেপটেসেপটে বালি, কপাল বেয়ে টুপটাপ নোনাজল।
শক্ত হাতে ধরে নেয় মাখম।
আস্তে আস্তে বড় মানুষের বউটা উঠে দাঁড়ায়। মাখমের কাঁধে হাত রেখে একটু দম নেয়। ভারী শরীরে। ভোর ফুটছে। হাওয়ায় শীত বাড়ছে। ক্র্যাচটা ধরিয়ে দিয়ে মাখম বলল, লও
—না
—কেন!
—আমি কি খুব ভারী…
ফরসা নরম হাতের চেটোয় যতটুকু পারে মাখমকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়ায় পূর্ণিমা। পূর্ণিমার মনে হল, লোহাপাতের জিনিসটা শুধু টাল সামলায়… মানুষের ভার সইতে তো মানুষ…!
অলংকরণ : দীপংকর ঘোষ ও রাতুল চন্দরায়