সৈয়দ রেজাউল করিম

ঘড়িতে রাত তখন ন’টা। সাধনবাবু ডাকতে এলেন আমাদের। আমি আর সুচরিতাদি বিন্দুমাত্র দেরি না করে হাজির হলাম সাধনবাবুর কোয়ার্টারে। আমাদের দেখে সন্ধ্যা বৌদি তাড়াতাড়ি করে রাতের খবার বেড়ে দিল। খেতে খেতে অনেক কথাই হল ওদের সঙ্গে। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে কোথায় বিয়ে বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, কত বরযাত্রীর আয়োজন করা হয়েছে। যৌতুক হিসেবে কী কী দেওয়া হচ্ছে, এমনই আরও অনেক কিছু। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা ফিরলাম পাশের কোয়ার্টারে। সুচরিতাদির আবার পান খাওয়ার নেশা। আমাকে জিজ্ঞাসা করল— একটা পান বানিয়ে দেব, খাবি?

আমি বিয়েবাড়িতে, আড্ডা মারার সময় দু’ একটা পান যে কখনও খাইনি, তা নয়। সুচরিতাদিকে বললাম— দিতে চাইছ যখন দাও।
সুচরিতাদি পরিমাণ মত চুন, সুপারি,খয়ের,জর্দা এবং অন্যান্য মশলা দিয়ে ভালো করে দুটো পান বানালো। একটা নিজের মুখে পুরে অন্যটা নিয়ে এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিছানায় বসে বলল—খেয়ে দেখ, কেমন লাগে?
আমি পানটা গালে পুরে দিলাম। ঠিক সেইসময় সুচরিতাদি পান চিবাতে চিবাতে বলল— মনিহার নিয়ে কি একটা কাহিনি শোনাবি বলছিলি?
আমি বললাম— কথাটা এখনও মনে রেখেছ?
সুচরিতাদি বলল— বা-রে, মনে থাকবে না কেন?
–‘শোনো তাহলে’ বলে আমি শুরু করলাম সেই কাহিনি…

কথায় বলে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে— তিন বিধাতা নিয়ে। কথাটা এতই বহুল প্রচলিত যে ক্রমে তা প্রবাদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সেই প্রবাদে এতটুকু বিশ্বাস ছিল না আমার। আমার ধারণা, এই প্রবাদ আগে যদিও লোকজন একটু আধটু বিশ্বাস করে চলত, এখন তা সমাজে একেবারে অচল। এখন বৈজ্ঞানিকেরা টেস্টটিউবে বাচ্চার জন্ম দেন। আর অকাল মৃত্যু নিয়ে তো প্রতিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বী, বিচার ব্যবস্থা ঠিক করে দেয়, কার মৃত্যু কখন হবে! আর আজকাল তো ভালোবাসা করে, দেখাশোনা করে, কোর্টকাছারিতে, ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে, প্রথাগত রীতিনীতি মেনে বিয়ে হয়। এতে ভগবানের হাত কোথা থেকে আসবে? নিজেরা সব ক্রিয়াকর্ম করে ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবানের নামে দোষ চাপায়। এটা কি কোনও যুক্তির কথা হলো?

এত বছর এই বিশ্বাসের উপর ভর করে আমার জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল। কিন্তু সেই বিশ্বাস, সেই ধ্যান-ধারণা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল একটা ঘটনায়। যদিও ঘটনাটা ঘটেছিল একেবারে অকস্মাৎ। যা আমার কল্পনার অতীত ছিল। কাহিনি যাতে হঠাৎ বেসুরো হয়ে না পড়ে, তাই তাল মেলাতে সুচরিতাদি বলল— কী ভাবে পাল্টে গেল তোর সেই ধ্যানধারণা?

সেই ঘটনার রেশ টেনে বলতে শুরু করলাম—

আমি তখন জলপাইগুড়ি জেলার মাদারিহাট থানার বড়বাবু। একদিন সন্ধেবেলায় থানায় বসে টুকিটাকি কাজ করছি, এমন সময় আরএসপি পার্টিঅফিস থেকে একটা ফোন পেলাম। পরিচয় দিতেই অত্যন্ত বিনয়ের সাথে পার্টি সম্পাদক মানিক সান্যাল বললেন— বড়বাবু! এইমাত্র ছেঁকামারি থেকে একটা ফোন পেলাম। ওখানে একটা গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। একটা ট্রাভেলিং বাস রাস্তায় চাকা ভেঙে লরির পিছনে ধাক্কা মেরে উল্টে পড়ে গেছে। অনেক প্যাসেঞ্জার আহত হয়েছে। মারাও যেতে পারে অনেকে। আপনি তাড়াতাড়ি ওখানে কিছু পুলিশ পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। আহত যাত্রীরা যাতে মাদারিহাট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা পায় তার জন্য ডাক্তারবাবুকে বলে রেখেছি। এখন প্যাসেঞ্জারদের জিনিসপত্র যাতে চুরিচামারি না হয়— সেদিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন।
আমি অত্যন্ত গভীর উদ্বেগের সঙ্গে তাঁকে আশ্বস্ত করে বললাম— ঠিক আছে মানিকবাবু! আমি দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না।

কথাটা বলে ফোন রেখে দিলাম। ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে লোকলস্কর নিয়ে সাথে সাথে বেরিয়ে পড়লাম। থানা থেকে ছেঁকামারির দূরত্ব মাত্র তিন-চার কিলোমিটার। তাই মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ঘটনাস্থলে। গিয়ে দেখি আশপাশের গ্রামের লোকজন জড়ো হয়ে বাসযাত্রীদের উদ্ধার করছে। একটা মাত্র হ্যাজাক লাইটে কাজ করতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমি আলোর ব্যবস্থা করলাম। বাসটাকে তোলার জন্য ক্রেন ডেকে নিলাম। আমাদের লোকজনও লেগে পড়ল কাজে। আহতদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর বাসটিকে টেনে থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম।

বাসটা রাস্তার পাশের খাদ থেকে তুলতে গিয়ে পাওয়া গেল দু’টো মৃতদেহ। একটি পুরুষ এবং একজন মহিলার। পুরুষের বয়স বছর পঁচিশ। বাঙালি। মহিলাটি নেপালি। মৃতদেহ দু’টি থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। অন্ধকারে তাদের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করা সম্ভবপর হচ্ছিল না। তার উপরে মৃতদেহের আইডেন্টিটি নির্ধারণ করার মত উপযুক্ত লোকজন ঘটনাস্থলে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই মৃতদেহ দু’টি থানায় পাঠিয়ে দিলাম।
তারপর ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে গেলাম মাদারিহাট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে ডাক্তারবাবুদের সঙ্গে কথা বললাম। আহতদের সঙ্গেও কথাবার্তা হলো। তাদের নাম ঠিকানা সব লিখে নিলাম। আহতদের বাড়িতে খবর দেওয়া ব্যবস্থা করলাম। কারণ, একটু পরেই জলপাইগুড়ি থেকে সাহেবরা অ্যাক্সিডেন্টের খুঁটিনাটি সব জানতে চাইবেন। উত্তর দিতে না পারলে অযোগ্য বড়বাবু হিসাবে গণ্য করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করবেন না সাহেবেরা। ফলে মোটামুটি সব খোঁজখবর নিতে হল আমাকে।

এক্সপ্রেস বাসটি আসছিল কলকাতা থেকে। আর গন্তব্যস্থল ছিল ফুন্টসলিং, ভুটান। পোশাকি নাম ভুটান-কলকাতা এক্সপ্রেস বাস। সেদিন জনা পঞ্চাশ যাত্রী ছিলেন বাসে। তাঁদের অধিকাংশই ভুটানবাসী। যাত্রীদের একটা লিস্ট পেয়ে গেলাম কন্ডাক্টরের কাছে। সেটার সঙ্গে চিকিৎসারত লোকজনদের হিসাব মিলিয়ে দেখলাম। তাতে দশ বারো জনের মতো যাত্রী কম ছিল। তারা নিশ্চয়ই স্থানীয় লোকজন হবে। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি বা অন্য কোথাও নেমে গেছে। এইসব ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিলাম। কারণ, ঘটনাস্থলে দুটি মৃতদেহ ছাড়া আর কোন মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।

সব কাজকর্ম সেরে থানার কোয়ার্টারে ফিরলাম রাত তিনটে নাগাদ। টিফিনবাক্সে খাবার নিয়ে এসে রেখে দিয়েছিল হোমগার্ড। কোন রকমে দু’চারটে মুখে গুঁজে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়লাম কে জানে!

সুচরিতাদি এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে গল্পটা শুনছিল। হঠাৎ অভিযোগের ভঙ্গিতে আমাকে বলে বসল— তোর কাছে মনিহারের গল্প শুনতে চাইলাম, আর তুই এখন কোথা থেকে একটা অ্যাক্সিডেন্টের গল্প আমদানি করে আনলি!

সুচরিতাদি ছিল একজন লেডি সাব-ইন্সপেক্টর। আমার চেয়ে দু’বছরের সিনিয়র। বালুরঘাট থানায় বছরখানেক আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি । তাই তার কথা শুনে একটু রসিকতা করে বললাম— সুচরিতাদি! মনিহার বলে কথা। বড় দামী জিনিস। তাই আয়রনচেস্ট থেকে বার করতে সময় লাগছে।
সুচরিতাদি সে কথার রসাস্বাদন করল বটে, কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টে আমাকে বলল— চা খাবি নাকি?
আমি বললাম— হলে তো ভালো হয়।
সুচরিতাদি কালবিলম্ব না করে কিচেনে গিয়ে ঢুকল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দু’কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এলো। গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আমেজে বলতে শুরু করলাম—

পরদিন সকালে সেই ঘুম ভাঙলো হোমগার্ডের ডাকে। থানায় একজন মহিলা আমার অপেক্ষায় বসে আছে শুনে আমি তাড়াতাড়ি প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে হাজির হলাম থানায়। চেম্বারে ঢুকতেই দেখতে পেলাম তেইশ-চব্বিশ বছরের এক বিবাহিত মহিলা বসে আছেন আমার অপেক্ষায়। আমাকে সামনের চেয়ারে বসতে দেখে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। মেয়েটির মুখের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে অবাক হলাম আমি। দেখতে পেলাম মহিলা বেশ উদভ্রান্ত। তার চোখেমুখে ছড়িয়ে আছে বিষন্নতার ছাপ। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। পরনের দামি কাপড়, লাল রঙের ব্লাউজে শুকনো কাদার ছাপ। আমার বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না, গতকাল অ্যাক্সিডেন্টের কবলে পড়া তিনি একজন ভিকটিম মহিলা। কিন্তু এই সাতসকালে হঠাৎ থানায় কিসের প্রয়োজন হল তাঁর?

মহিলার মুখটা দেখে আমার মনে হচ্ছিল যেন তার সাথে আমার বহুদিনের চেনা জানা। কিন্তু স্মৃতির অতল গহ্বর রোমন্থন করেও বুঝতে পারলাম না, কবে কোথায় তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল! সেইসময় হঠাৎ আমার নজরে পড়লো মহিলার গলার হারটার দিকে।

(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়