সৈয়দ রেজাউল করিম
(খাকি উর্দি গায়ে কয়েক যুগ চষে বেড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত। রাজ্যের বিভিন্ন থানা ও ক্রাইম ব্রাঞ্চে কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠেছে সৈয়দ রেজাউল করিমের লেখালেখির রসদ।)
যেভাবে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ উপভোগ করছিল কৌরব রাজদরবারে উপস্থিত জ্ঞানীগুণীরা, ঠিক সেভাবেই নিমন্ত্রিত অতিথিরা বিস্ফারিত চোখে দেখছিলেন সেই আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু এ দৃশ্য যখন চোখে পড়ল সন্ধ্যার, তখন সে আর নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। আমি আর যোগেশবাবু কোনওরকমে জলের গ্লাসে হাত ধুয়ে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। আইসি ডি.কে. সারকি সেখানে হাজির ছিল। সেও হাজির হল আমাদের পাশে। আমাদের দেখে কিছুটা উৎসাহের ভাটা পড়ল অতিথিবর্গের। বাসন্তীর গায়ে ভালো করে শাড়িটা জড়িয়ে দিল সন্ধ্যা। তারপর বাসন্তী ও কল্পনাকে আমরা নিয়ে গেলাম পাশের ঘরে। উদ্দেশ্য হল দুজনের মধ্যে বিবাদের কারণ জেনে তার একটা সমাধানসূত্র করে দেওয়া। নাহলে পরবর্তীতে খুনের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
জানা গেল, অভাবের তাড়নায় পড়ে এক এক করে সন্ধ্যা, বাসন্তী, কল্পনা, সাথী আর পাঁচজনের মতো হাজির হয়েছিল বালুরঘাটের ওই অন্ধগলিতে। তখন কর্মক্ষেত্রে সবাই সবার প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও তাদের মধ্যে কোথাও যেন একটা মনের মিল ছিল। সাধনবাবু যেদিন সন্ধ্যাকে স্ত্রীর সম্মান দিয়ে নিজের কোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে তোলে, তার কয়েকদিন আগে থেকেই ব্যাপারটা জানাজানি হয়েছিল। সে সময় কল্পনা ও বাসন্তী হাতজোড় করে সন্ধ্যা, সাধনবাবুর কাছে প্রার্থনা করেছিল— আমাদের দু’জনের জন্য দু’টো মনের মানুষ জোগাড় করে দে না। এই জীবন আর ভালো লাগছে না। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তারা তাদের বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কপাল মন্দ বাসন্তীর। অকালে মারা গেল তার স্বামী। কিন্তু কল্পনার কপাল ভালো। সে এখন কমলের রাজপুরীর একচ্ছত্র মালকিন। প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক কমল। গঙ্গারামপুরে তার বিরাট ব্যবসা। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার তাদের কোন ছেলেপুলে নেই। সেইজন্য স্বামীর প্রতি একটা সন্দেহ এসে জুটেছে তার মনে। তার স্বামী অন্য কোথাও সংসার পেতে বসেনি তো? কোথাও কিছু করে বেড়াচ্ছে না তো? এজন্য সবসময় সে তার স্বামীকে চোখে চোখে রাখে। বাড়ির কাজকর্ম ফেলে হুট করে চলে যায় স্বামীর অফিসে। একদিন অফিসে গিয়ে দেখে, তার স্বামী হেসে হেসে কথা বলছে বাসন্তীর সঙ্গে। তাতে একরাশ সন্দেহ এসে জড়ো হয় তার মাথায়। অনেক উল্টোপাল্টা কথা শুনিয়ে দেয় তাকে। মাথা নিচু করে বাসন্তী সেদিন ফিরে যায় তার বাড়িতে। আজ বিয়ে বাড়িতে একই টেবিলে খেতে বসে তাকে অনেক কড়া কথা বলে দেয় সে।
সন্ধ্যা বলে– বাসন্তী! কমলের অফিসে তুই কোন কাজে গিয়েছিলি?
খানিকটা অবাক হয়ে বাসন্তী বলল– কেন দিদি! তোমার মনে নেই? তুমি তো তোমার মেয়ের বিয়ের কার্ডটা কমলদার অফিসে পৌঁছে দিতে বলেছিলে। সেটা দিতে…।
যোগেশবাবু ব্যাপারটা অনুধাবন করে কল্পনাকে দিকে তাকিয়ে বললেন– কল্পনা! তোমরা তিনজনেই আমার মেয়ের মতো। তোমাদের দুটো কথা বলি। পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকরির শুরুতে আমাদের জ্ঞান দেওয়া হয়েছিল সবাইকে সন্দেহ করতে। সন্দেহের উর্ধ্বে কেউ নয়। সে নিজের বাবা হোক আর কাকা হোক। কর্মজীবনে তা প্রয়োগ করে খুব ভালো ফল পেয়েছিলাম আমরা। কারণ আমরা ভালোমত অবগত ছিলাম সন্দেহের গতি-প্রকৃতি, কাজকর্ম সম্পর্কে। সন্দেহের মাত্রাবোধ না থাকলে তা ক্রমশ মানসিক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর তার ফল হয় মারাত্মক। অনেক খুন, দাঙ্গার মতো সিরিয়াস ঘটনা ঘটতে দেখেছি আমাদের পুলিশি জীবনে। কল্পনা যদি তার স্বামী আর বাসন্তীকে আলাদা ভাবে জিজ্ঞসাবাদ করতো, ব্যাপারটা অনেক আগেই পরিস্কার হয়ে যেত তার কাছে। এভাবে খোলা ময়দানে এক নারীর হাতে অন্য নারীকে নিগ্রহ হতে হতো না। নিজে সে সমস্যার সমাধান করতে না পারলে কারোর সাহায্য নিলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?
যোগেশবাবুর কথা শুনে চোখে জল এসে গেল কল্পনার। ধরা গলায় সে বলল– আমার অন্যায় হয়ছে স্যার! আর কখনও…।
সে কথা আর শেষ করতে পারল না কল্পনা। যোগেশবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন– আমার কাছে আর ক্ষমা চেয়ে তোমার কি লাভ হবে? যার সঙ্গে…।
কল্পনা এবার বাসন্তীর হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল– আমাকে ক্ষমা করে দিও বাসন্তীদি। জীবনে আর কোনওদিন এরকম ভুল হবে না।
(ক্রমশ)
অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়