সুখেন্দু হীরা

আবাসনের তিনতলায় উত্তমদা’দের ঘর। সাইকেলটা তাই একতলায় সিঁড়ির নীচে মিটার ঘরের সামনে রেখে দেন।

তিন তলায় তো সব সময় সাইকেল তোলা সম্ভব নয়। সাইকেলে তালা চাবি দেওয়া থাকে। এমন কি কোনও তালা আবিষ্কার হয়েছে, যা চোরেরা খুলতে পারে না? উত্তমদা একদিন তিন তলার ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলেন, নীচে তাকিয়ে দেখেন তাঁর সাইকেলটা একটা অচেনা ছেলে চালিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। দেখে উত্তমদা চিৎকার করে উঠলেন, “ও দাদা! ও দাদা!”

ছেলেটি পিছনে না তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে উত্তর দিল, “পরে আসব। আজ আমার সময় নেই।”

আবাসনের একঝাঁক লোকের সামনে দিয়ে তস্কর মহাশয় সাইকেল নিয়ে চলে গেলেন। সকলেই ভাবল এই ছেলেটি উত্তম’দার পরিচিত। তস্কর মহাশয় তার উপস্থিত বুদ্ধি নিয়ে বা দীর্ঘদিনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান দিয়ে সকলকে বোকা বানিয়ে অর্থাৎ ঠকিয়ে সাইকেলটি সাতসকালে চুরি করে পালাল।

এই ঘটনাটি আমার ছেলেবেলায় ঘটা আমাদের পাড়ার ঘটনা। এই প্রসঙ্গে আরেকটি মজার ঘটনা আমার মনে পড়ছে। এটা অবশ্য আমি কোচিং ক্লাসে গিয়ে শুনেছিলাম। তখন আমি সম্ভবত একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ি। এটা অন্য পাড়ার গল্প। চরিত্রগুলোকে আমি চিনি না। তাই কাল্পনিক নাম ব্যবহার করলাম।

চন্দন’দার বাড়ির সোফাকামবেডটার বেশ বয়স হয়েছে। সোফার ‘কভার’টি বিবর্ণ হয়েছে, কভার ছিড়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। জায়গায় জায়গায় স্প্রিং গুলো ঢিলা হয়ে ‘হেমাটোবা’র মতো ফুলে উঠেছে। বৌদি অর্থাৎ চন্দনদার বৌ প্রায় চিৎকার চেঁচামেচি করেন, এটাকে কেন সারানো হচ্ছে না বলে।

একদিন চন্দন’দা বাজারে গেছেন। তখন একটি অপরিচিত ছেলে এসে বলল, “বৌদি আপনাদের সোফা সারাই করতে হবে? দাদা পাঠালো!”

বৌদি বললেন” হ্যাঁ”!

“দেখি সোফাটা কোথায়? বলে ছেলেটি ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। সোফাটা দেখে ছেলেটি বলে, “বৌদি আমি তো যন্ত্রপাতি আনিনি। দাদার সাইকেল নিয়ে যাচ্ছি, পাঁচ মিনিটের মধ্যে যন্ত্রপাতি নিয়ে ফিরে আসছি। আমি তো দেখে নিলাম, ঘরে বসেই সারাই করে দিতে পারব।”

ছবি: অভীক চক্রবর্তী

সেই পাঁচ মিনিট পঁচিশ মিনিট হয়ে গেল। কিন্তু সেই সোফাসারাইওলার পাত্তা নেই। ইতিমধ্যে চন্দন’দা বাজার থেকে ফিরে এসেছেন। সব শুনে নিজেই বৃদ্ধ সোফার ওপর ‘ধপ’ করে বসে পড়লেন। সোফা সারাই তো দুরের কথা। সাধের এবং কাজের সাইকেলটাও গেল।

এই দু’টো গল্প আমাদের ছোটবেলার হাসির খোরাক ছিল। চোরদের এই বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে আমরা চমৎকৃত হয়েছিলাম। এত সহজ ভাবে লোক ঠকানো যায় ভেবে অবাক হতাম। এই লোক ঠকানো বিষয়টাকে শুদ্ধ বাংলায় প্রতারণা বলে। যারা এই প্রতারণা করে, তাদের বলে প্রতারক। আমার দেখা এরাই ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতারক। তার পর জীবনে এত প্রতারক দেখেছি যে, ‘ঠগ বাছতে গা উজাড়’ হয়ে যাবে।

আমাদের এই নতুন সিরিজ প্রতারণার ফাঁদ নিয়েই, অন্য ভাবে বললে প্রতারকদের গল্প ঘিরেই। সারা বিশ্বে মানুষ প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হচ্ছে। নানা ভাবে আমরা প্রতারিত হচ্ছি। সব প্রতারণা অবশ্য আর্থিক নয়। অনেক মানসিক প্রতারণা ও থাকে। সেগুলোকে যদি বাদও রাখি, তবে দেখা যাবে আমাদের চারপাশে অজস্র প্রতারক ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুধু চারপাশে নয় সুদূর দেশে বসে, মোবাইল ফোনের ওপারে বসেও টোপ ফেলছে প্রতারণার। তাই বলতে ইচ্ছা করে, “এ জগৎ প্রবঞ্চকময়।”

(ক্রমশ)

অলংকরণ – রাতুল চন্দরায়