সৈয়দ রেজাউল করিম

(খাকি উর্দি গায়ে কয়েক যুগ চষে বেড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত। রাজ্যের বিভিন্ন থানা ও ক্রাইম ব্রাঞ্চে কাজ করতে গিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠেছে সৈয়দ রেজাউল করিমের গল্পগুলির রসদ।)

হারটা হাতে নিতেই আমার চোখজোড়া আছড়ে পড়ল মৌ-এর দিকে। মৌ-এর গলায় হার নেই দেখে বুঝতে পারলাম মৃতদেহের সামনে কান্নাকাটি করার সময় গলার মনিহারটা খুলে পড়েছে তার। সন্দেহের বশে আমি উল্টে পাল্টে দেখলাম হারটা। আর দেখতে গিয়ে নজরে পড়ে গেল সেই ইংরেজিতে লেখা ‘এম’ ও ‘এস’ অক্ষর দুটো। ‘এস’ হল আমার বন্ধু শ্যামল বসুর নামের অদ্যাক্ষর। আমি বুঝতে পারলাম এই হারটি আমার বন্ধুর বিয়েতে উপহার দেওয়া সেই মনিহার। কিন্তু এই হার মৌ-এর গলায় কেন? সন্দেহ কাটাতে মৌকে প্রশ্ন করলাম— আপনারা কয় ভাই বোন?
মৌ বলল— আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
জবাব শুনে আমি কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারলাম না। আমি হারটা মৌয়ের হাতে তুলে দিয়ে অবশেষে জিজ্ঞাসা করি— এই হারটা আপনি কোথা থেকে কিনেছেন?
— হারটা আমি কিনিনি। তাই বলতে পারব না কোথা থেকে কেনা হয়েছে। বিয়ে উপলক্ষে আমার স্বামীর বন্ধু এই মনিহারটা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন।
আমার এই প্রশ্নবাণে মক্ষিকার মতো সে যে আটকে যাচ্ছে মাকড়সার জালে, তা একটুও বুঝতে পারল না মৌ।
আমি আর একটু গভীরে পৌঁছতে মৌকে জিজ্ঞেস করলাম— আপনি সেই বন্ধুকে চেনেন?
মৌ বলল— না, ঠিক চিনি না। একবারই দেখেছি তাঁকে।

ঠিক সেই সময় আমার খেয়াল হল গণেশ শর্মার কথা। গণেশ শর্মার বাড়ি মাদারিহাট প্রপারে। ফটো প্রিন্টিংয়ের ব্যবসা করে। বিভিন্ন স্টুডিও থেকে ফটোগ্রাফের রিল সংগ্রহ করে নেপাল থেকে প্রিন্টিং করে নিয়ে আসে। আমার একটা রিল দেওয়া আছে তার কাছে। সেই রিলে অন্যান্য ছবির সাথে আমার বন্ধু শ্যামল বসু, তার হবু স্ত্রী মৌমিতা এবং আমার কয়েকটা ছবি তোলা আছে। ছবিগুলো তোলা হয়েছিল ওদের বিয়ের বেশ কয়েকদিন আগে। ওদের বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবো না জেনে একটা হোটেলে মিট করেছিলাম আমরা। সেখানেই একটা ছোট অনুষ্ঠানে মনিহারটা বিয়ের আগাম উপহার হিসেবে দিয়েছিলাম মৌমিতাকে। নিশ্চয়ই সেই ছবিটা দেখে মৌমিতা আমাকে চিনতে পারবে। নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবে। সে যে এতক্ষণ আমার কাছে মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ছুটিয়েছে, ব্যাপারটা হাতেনাতে প্রমাণ হয়ে যাবে। কথাটা ভেবে পুলকিত হয়ে উঠলাম আমি।

একটু পরেই প্রিন্টিং ফটোগ্রাফগুলো নিয়ে এসে আমার হাতে দিল হোমগার্ড। আমি সেই ছবিগুলো থেকে পাঁচটা ছবি আলাদা করে মৌয়ের হাতে দিয়ে বললাম— দেখুন তো ছবিগুলো চিনতে পারেন কি না?

মৌ ছবিগুলো নিয়ে উল্টে পাল্টে ভাল করে দেখল। একরাশ বিস্ময়ের অভিব্যক্তি ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। বারবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। তা দেখে বুঝতে পারলাম ছবির সাথে আমার মুখটা মিলিয়ে দেখছে, সত্যিই আমি ছবিতে থাকা সেই লোকটা কিনা! এটা হয়েই থাকে। পুলিশি পোশাক পরা মানুষটাকে এক নজরে চেনা খুবই কষ্টকর হয় সাধারণ জামাকাপড় পরা অবস্থায় দেখলে। সেকথা বুঝে আমি বললাম— আমাকে চেনার অত প্রয়োজন নেই আপনার। নিজেকে চিনতে পারছেন তো? আপনার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আর একটি লোক যে আছে, তাকে চিনতে পারছেন তো?

প্রশ্নের কোনও জবাব না দিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকল মৌ। আমি কতকটা নির্দয়ের মতো বললাম— কুমিরের কান্না কেঁদে লাভ নেই। আপনি ধরা পড়ে গেছেন। আপনি যে একজন মিথ্যেবাদী, প্রতারক— সে ব্যাপারে আমার আর কোনও সন্দেহ নেই। এখন একটা সত্যি কথা বলুন তো। শ্যামলের সাথে আপনার বিয়েটা কি হয়নি? বর্বর, উল্লুকটা কি আপনার সঙ্গে কোন প্রতারণা করেছে? নাকি আপনিই…।

কান্না থামিয়ে চোখদুটো দু’টো আঁচলে মুছে চোয়াল শক্ত করে মৌ প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল— আমি আপনাকে একবর্ণও মিথ্যে কথা বলিনি। হ্যাঁ, আমার নাম মৌমিতা রায়। আমার ডাকনাম মৌ। একথা একশো ভাগ সত্যি যে আমি আমার বিবেকের তাড়নায় অনুপ কার্জির মতো একটা অনাথ ছেলেকে ভালোবেসে ছিলাম। এ কথাও সত্যি, শ্যামল বসুর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল। উনি আমার সঙ্গে কোনও প্রতারণা করেননি। আমিও কোন প্রতারণা করিনি ওঁর সঙ্গে। তাই ওঁকে বর্বর,উল্লুক বলাটা শোভনীয় নয়। আমার চোখে উনি একজন দেবতা। ওঁর মতো মানুষ এ পৃথিবীতে কম জন্মায়। বাসর রাতে আমি আমার এই মানসিক ভালবাসার কথা দ্বিধাহীন মনে জানিয়েছিলাম তাঁকে। সব শুনে তিনি আমাকে দু’টো প্রশ্ন করেছিলেন। কেন আমি আমার বাবা-মাকে এই ভালোবাসার কথা জানাইনি? উত্তরে আমি বলেছিলাম— বাবা মাকে আমি জানিয়েছিলাম। বাবা মা রাজি হননি অনুপের মতো একজন সামান্য বেতনভোগী অনাথ ছেলের হাতে আমাকে তুলে দিতে। তিনি আমাকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করেছিলেন— আপনি কি ওর কাছে ফিরে যেতে চান ? আমি মাথা নেড়ে বলেছিলাম— হ্যাঁ।

পরদিন অনুপের সাথে যোগাযোগ করে, সমস্ত কথা তাকে বুঝিয়ে আমাকে এসপ্লানেডে নিয়ে এসে ভুটান বাসে আমাদের তুলে দিয়েছিলেন। আমি আমার বিয়েতে পাওয়া সমস্ত গয়না ঘরে রেখে আসতে চাইছিলাম, উনি বললেন—ওগুলো আপনি নিয়ে যান। ওসব আপনাকে দেখে দিয়েছে, আমাকে দেখে দেয়নি। কথা বলতে বলতে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল মৌমিতা।

মৌমিতার মুখে নিজের বন্ধুর প্রশংসা শুনে গর্বে যেমন বুকটা ফুলে উঠল, তেমন তার জীবন কাহিনী শুনে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল আমার হৃদয়। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একটা সামান্য বাস অ্যাক্সিডেন্টের তদন্ত করতে গিয়ে, এ ভাবে যে জীবনের এক চরম সত্যের মুখোমুখি হতে হবে, এ আমার কল্পনারও অতীত ছিল। একটা মনিহার যে এরকম ভাবে আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলতে পারে— তা ছিল চিন্তা ভাবনার বাইরে। তা ছাড়া, মৌমিতার অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা শুনে শ্রদ্ধায় নত হয়ে গেল আমার মাথা। শুধু তাই নয়, সদ্য বিয়ে করা স্ত্রী-র প্রতি শ্যামলের এই উদারতাও আমাকে মুগ্ধ করল।
দেখতে দেখতে বেলা অনেকটা গড়িয়ে গেল। তাই লাঞ্চ করার জন্য মৌকে পাঠিয়ে দিলাম জলদাপাড়া লজে। আমি ফিরলাম কোয়ার্টারে।
জীবন কাহিনীর এই গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ সুচরিতাদি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল— আমি আসছি।
আমি ভাবলাম হয়তো বাথরুমে যাবে। কিন্তু বাথরুমে না ঢুকে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। খানিকক্ষণ পরে একটা অ্যালবাম হাতে নিয়ে আমার ঘরে এলো। পাতা উল্টে একটা গ্রুপ ছবি দেখিয়ে বলল— এই মেয়েটাই কি মৌমিতা?

(ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়