কমন ম্যান কান্তি

খেলতেন ডিফেন্ডার হিসেবে। কিন্তু আক্রমণে যাওয়ার দক্ষতাই বিশ্ব জোড়া খ্যাতি দিয়েছিল তাঁকে। জার্মানির হয়ে দু‌’টি বিশ্বকাপ (১৯৭৪ এবং ১৯৯০), তিনটি ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ (১৯৭২, ১৯৮০ এবং ১৯৯০) এবং এক বার ক্লাব পর্যায়ে ইউরোপীয় কাপ উইনার্স কাপ (১৯৭৪) জিতেছিলেন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার। এই কিংবদন্তি ফুটবলার রবিবার রাতে (৮ জানুয়ারি, ২০২৪) ঘুমের মধ্যে বরাবরের জন্য মাঠের ও-পারে চলে গেলেন। ৭৮ বছর বয়সে।

পার্কিনসন্স রোগে ভুগছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে ছেলে স্টিফেন মারা যাওয়ার পর থেকে বেকেনবাওয়ারের শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে পরে। উজ্জ্বল বর্ণময় জীবনের অনেক কথাই আর তাঁর মনে ছিল না শেষ দিকে। হৃদযন্ত্রের চিকিৎসাও চলছিল। তবু জীবনের প্রতি বরাবর ছিলেন ইতিবাচক।

তাঁর মৃত্যুতে বিশ্ব ফুটবল জগৎ শোকাহত। জন্ম জার্মানির মিউনিখে, ১৯৪৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। বাবা ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার সিনিয়র ছিলেন একজন অস্ত্র নির্মাতা এবং মা অ্যান মাইকেল। বেকেনবাওয়ারের তিনটি ভাই ছিল, যার মধ্যে একজন অল্প বয়সে মারা যায়।

খেলোয়াড় জীবন

  • বেকেনবাওয়ার তাঁর খেলোয়াড় জীবন শুরু করেন ১৯৬৪ সালে জার্মানির বুন্দেসলিগা ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত বায়ার্ন মিউনিখে খেলেন এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি পাঁচটি বুন্দেসলিগা শিরোপা, চারটি ডিএফবি-পোকাল শিরোপা এবং একটি ইউরোপীয় কাপ উইনার্স কাপ জেতেন।
  • ১৯৭৭ সালে বেকেনবাওয়ার বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগ দেন। নাপোলিতে তিন বছর খেলেন এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি একটি ইতালিয়ান সিরি এ শিরোপা জিতেছেন।
  • ১৯৮০ সালে বেকেনবাওয়ার ফ্রান্সের ক্লাব অলিম্পিক মার্সেইয়ে যোগ দেন। মার্সেইয়েতে এক বছর খেলেন এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি একটি লিগ ওয়ান শিরোপা জিতেছেন।
  • ১৯৮১ সালে বেকেনবাওয়ার জার্মানিতে ফিরে আসেন এবং বায়ার্ন মিউনিখে যোগ দেন। বায়ার্ন মিউনিখে আরও চার বছর খেলেন এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি আরও তিনটি বুন্দেসলিগা শিরোপা, তিনটি ডিএফবি-পোকাল শিরোপা এবং একটি ইউরোপীয় কাপ জিতেছেন।
  • আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে বেকেনবাওয়ার অবসর নেন ১৯৮৪ সালে। তিনি জার্মানির হয়ে ৯১টি ম্যাচ খেলেছেন এবং ৩৩টি গোল করেছেন।

কোচিং জীবন

  • বেকেনবাওয়ার ১৯৮৪ সালে বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে যোগ দেন। বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে দুই বছর ছিলেন এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি একটি বুন্দেসলিগা শিরোপা, একটি ডিএফবি-পোকাল শিরোপা এবং একটি ইউরোপীয় কাপ জিতেছেন।
  • ১৯৮৬ সালে বেকেনবাওয়ার জার্মানি জাতীয় দলের কোচ হিসেবে যোগ দেন। জাতীয় দলের কোচ হিসেবে চার বছর ছিলেন এবং এই সময়ের মধ্যে ১৯৯০ সালে তিনি বিশ্বকাপ এনে দেন দেশকে।
  • বেকেনবাওয়ার ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন। তাঁর কোচিংয়ে জার্মানির জাতীয় দল খেলেছিল ৬৮টি ম্যাচ। জয় পেয়েছিল ৩৯টিতে।

খেলোয়াড় জীবনের সেরা দশ সাফল্যের মুহূর্ত

১. ১৯৭২ সালে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জয়

বেকেনবাওয়ারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুটা হয় ১৯৭২ সালের ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ দিয়ে। এই টুর্নামেন্টে তিনি জার্মানির হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হয়।

২. ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপ জয়

১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপ ছিল বেকেনবাওয়ারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত। এই টুর্নামেন্টে তিনি জার্মানির অধিনায়ক ছিলেন এবং জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হয়। বেকেনবাওয়ার এই টুর্নামেন্টে তার অসাধারণ খেলার জন্য “ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট” নির্বাচিত হন।

৩. ১৯৭৫ সালে ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হওয়া

বেকেনবাওয়ার ১৯৭৫ সালে ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। তিনি এই পুরস্কার জয়ী প্রথম জার্মান ফুটবলার।

৪. ১৯৮০ সালে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জয়

১৯৮০ সালের ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বেকেনবাওয়ার আবারও জার্মানির হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং জার্মানি চ্যাম্পিয়ন হয়।

৫. ১৯৮১ সালে ইউরোপীয় কাপ জয়

বেকেনবাওয়ার ১৯৮১ সালে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ইউরোপীয় কাপ জয় করেন। এই টুর্নামেন্টে তিনি বায়ার্ন মিউনিখের অধিনায়ক ছিলেন।

৬. ১৯৮২ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছানো

১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বে জার্মানি সেমিফাইনালে পৌঁছায়। এই টুর্নামেন্টে তিনি আবারও তার অসাধারণ খেলার জন্য প্রশংসিত হন।

৭. ১৯৮৪ সালে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে পৌঁছানো

১৯৮৪ সালের ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বে জার্মানি সেমিফাইনালে পৌঁছায়। এই টুর্নামেন্টে তিনি আবারও তার অসাধারণ খেলার জন্য প্রশংসিত হন।

৮. ১৯৯০ সালে বিশ্বকাপ জয়

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে বেকেনবাওয়ার জার্মানি জাতীয় দলের কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয় করেন। এই টুর্নামেন্টে তিনি জার্মানি দলের খেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

৯. ফিফা ১০০-তে নির্বাচিত হওয়া

২০০৪ সালে ফিফা ১০০ নির্বাচিত হয়। এই তালিকায় বিশ্বের সেরা ১০০ জীবিত ফুটবলারের নাম রয়েছে। বেকেনবাওয়ার এই তালিকায় স্থান পান।

১০. বায়ার্ন মিউনিখের ক্লাব কিংবদন্তি হিসেবে স্বীকৃতি

বেকেনবাওয়ার বায়ার্ন মিউনিখের ক্লাব কিংবদন্তি হিসেবে স্বীকৃত। তিনি বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে পাঁচটি বুন্দেসলিগা শিরোপা, চারটি ডিএফবি-পোকাল শিরোপা এবং একটি ইউরোপীয় কাপ উইনার্স কাপ জিতেছেন।

জীবনের অভিনব বা বৈচিত্রময় কিছু ঘটনা

১. একজন ডিফেন্ডার হিসেবে গোল্ডেন বল জয়

বেকেনবাওয়ার একজন ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতেন, কিন্তু তাঁর আক্রমণাত্মক দক্ষতার জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে তার অসাধারণ খেলার জন্য “ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট” নির্বাচিত হন। এই পুরস্কারটি সাধারণত একজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে দেওয়া হয়। বেকেনবাওয়ার একজন ডিফেন্ডার হিসেবে এই পুরস্কার জয় করেন, যা ছিল একটি অভিনব ঘটনা।

২. বিশ্বকাপ জয়ের পর বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগদান

বেকেনবাওয়ার ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগদান করেন। এই সিদ্ধান্তটি ছিল অনেকের জন্য অপ্রত্যাশিত। বেকেনবাওয়ার বিশ্বের সবচেয়ে সফল ক্লাবগুলির মধ্যে একটিতে খেলছিলেন এবং তিনি বিশ্বকাপ জয়ের পর তাঁর ক্যারিয়ারের শিখরে ছিলেন। তার এই সিদ্ধান্তটি অনেকে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছিলেন।

৩. বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে তার প্রথম মরসুমেই বুন্দেসলিগা শিরোপা জয়

বেকেনবাওয়ার ১৯৮৪ সালে বায়ার্ন মিউনিখের কোচ হিসেবে যোগ দেন। প্রথম মরসুমেই তিনি বায়ার্ন মিউনিখকে বুন্দেসলিগা শিরোপা জিতিয়ে দেন। এই সাফল্যটি ছিল একটি অভিনব ঘটনা। বেকেনবাওয়ার একজন নতুন কোচ ছিলেন এবং তিনি একটি নতুন দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর এই সাফল্য অনেকের কাছে ছিল একটি অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা।

৪. ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে জার্মানি জাতীয় দলের কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়

বেকেনবাওয়ার ১৯৯০ সালে জার্মানি জাতীয় দলের কোচ হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর নেতৃত্বে সে বছরই জার্মানি বিশ্বকাপ জয় করে। এই সাফল্যটি ছিল একটি বিশাল অর্জন। বেকেনবাওয়ার একজন ডিফেন্ডার হিসেবে তার কেরিয়ার শুরু করেছিলেন এবং একজন সফল কোচ হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এ ভাবে।

বেকেনবাওয়ারের জীবনের দুঃসময়ের দিনগুলি

পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হওয়া

  • বেকেনবাওয়ারের জীবনে কিছু দুঃসময়ের দিনও ছিল। পুত্রবিয়োগের পরে বড় ছন্দপতন ঘটে জীবনে। ২০১৫ সালে পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হন। তিনি তাঁর খেলোয়াড় এবং কোচিং জীবনের অনেক স্মৃতি ভুলে যান। যদিও পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরেও তিনি তাঁর জীবনের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব বজায় রেখেছিলেন।
  • ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে জার্মানি সেমিফাইনালে পরাজিত হয়। এই পরাজয়টি বেকেনবাওয়ারের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। তিনি এই পরাজয়ের জন্য নিজেকে দায়ী করেছিলেন।
  • ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে জার্মানি চতুর্থ স্থানে থাকে। এই পরাজয়টিও বেকেনবাওয়ারের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। এই পরাজয়ের জন্যও তিনি নিজেকে দায়ী করেছিলেন।

বেকেনবাওয়ারের জীবনে বিতর্ক

  • বেকেনবাওয়ারের জীবনে কিছু বিতর্কও ছিল। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের পর তিনি বায়ার্ন মিউনিখ ছেড়ে ইতালির ক্লাব নাপোলিতে যোগদান করেন। এই সিদ্ধান্তটি অনেকের জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল এবং এটিকে অনেকে বেকেনবাওয়ারের আর্থিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখেছিলেন।
  • ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে জার্মানির সেমিফাইনাল পরাজয়ের পর বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকে মনে করেছিলেন যে বেকেনবাওয়ার একজন দুর্বল নেতা এবং তিনি জার্মানির পরাজয়ের জন্য দায়ী।
  • ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে জার্মানির কোচ হিসেবে বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্ব নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠেছিল। অনেকে মনে করেছিলেন যে, বেকেনবাওয়ার একজন পুরনো ঘরানার কোচ এবং তিনি জার্মানির পরাজয়ের জন্য দায়ী।

তবে এই বিতর্কগুলি বেকেনবাওয়ারের প্রতিষ্ঠা বা খ্যাতিকে ক্ষুণ্ন করতে পারেনি। একজন অসাধারণ ফুটবলার এবং একজন সফল কোচের অবদানকে ম্লান করতে পারেনি এ সব বিতর্ক।

বেকেনবাওয়ারের কোচেদের প্রভাব

  • বেকেনবাওয়ারের জীবনে তাঁর কোচদের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রথম কোচ ছিলেন হেলমুট শেন। শেন বেকেনবাওয়ারকে একজন সফল ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
  • বেকেনবাওয়ারের কেরিয়ারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কোচ ছিলেন জার্মান কোচ ভিলহেলম ল্যুবেক। ল্যুবেক বেকেনবাওয়ারকে একজন ডিফেন্ডার হিসেবে তাঁর দক্ষতা উন্নত করতে সাহায্য করেন।
  • বেকেনবাওয়ারের কেরিয়ারের শেষের দিকে তাঁর কোচ ছিলেন ইতালীয় কোচ জুসেপ্পে মারিয়া মারিয়ানি। মারিয়ানি বেকেনবাওয়ারকে একজন সফল কোচ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।
  • বেকেনবাওয়ার তাঁর কোচদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছেন। তারা তাকে একজন সফল ফুটবলার এবং একজন সফল কোচ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন।

বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে তুলনা

বিভিন্ন সময় বেকেনবাওয়ারের সঙ্গে তাঁর আগে-পরের এবং সমসাময়িক অনেক সফল ফুটবলারের মধ্যে কয়েক জনের তুলনা করেছেন কেউ কেউ। এমন কয়েক জন হলেন:

পল ব্রাইটনার (ইংল্যান্ড)

পল ব্রাইটনার বেকেনবাওয়ারের মতোই ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতেন, কিন্তু আক্রমণাত্মক দক্ষতার জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত ছিলেন। উভয়েই তাঁদের দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। ব্রাইটনার ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন।

কার্ল-হাইনজ রুমেনিগে (জার্মানি)

কার্ল-হাইনজ রুমেনিগে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন। ১৯৭২ সালে জার্মানির ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন এবং ১৯৭৪ সালে জার্মানির বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন। বেকেনবাওয়ার এবং রুমেনিগে উভয়ই জার্মানি জাতীয় দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁরা উভয়েই বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন।

দিয়েগো মারাদোনা (আর্জেন্টিনা)

দিয়েগো মারাদোনা স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন। ১৯৮৬ সালে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন। বেকেনবাওয়ার এবং মারাদোনা উভয়েই বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন। তাঁরা উভয়েই তাঁদের দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

পেলে (ব্রাজিল)

পেলে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতেন। তিনি তিনটি বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। তবে খেলায় অবস্থান ছিল ভিন্ন।  পেলে স্ট্রাইকার হলেও বেকেনবাওয়ার একজন ডিফেন্ডার হিসেবে মাঠে নামতেন।

ফাইল ফটো

বেকেনবাওয়ারের তুলনায় ব্রাইটনার এবং রুমেনিগে ছিলেন আরও আক্রমণাত্মক ফুটবলার। মারাদোনা ছিলেন একজন আরও প্রতিভাবান ফুটবলার। কিন্তু বেকেনবাওয়ার ছিলেন একজন আরও সমন্বিত ফুটবলার। তিনি ডিফেন্সে এবং আক্রমণে সমান ভাবে দক্ষ ছিলেন। পেলে ছিলেন একজন আরও বড় তারকা। তিনি তিনটি বিশ্বকাপ জয় করেছিলেন, যা বেকেনবাওয়ারের চেয়ে বেশি। কিন্তু বেকেনবাওয়ার ছিলেন একজন আরও কঠিন এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক খেলোয়াড়।

বেকেনবাওয়ারের প্রশংসায় একসুর

 ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের খেলা, ক্যাপ্টেন্সি ও কোচিংয়ের ধরন নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেকেই প্রায় এক সুরে প্রশংসা করেছেন। এখানে কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মতামত তুলে ধরা হল:

খেলা

পেলে: বেকেনবাওয়ার একজন পূর্ণাঙ্গ ফুটবলার। তিনি ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতেন, কিন্তু আক্রমণাত্মক ফুটবলার হিসেবেও সমান দক্ষ ছিলেন। তাঁর পাসিং এবং ড্রিবলিংয়ের দক্ষতা ছিল দুর্দান্ত। তিনি গোল করার ক্ষমতাও রাখতেন।

দিয়েগো মারাদোনা: বেকেনবাওয়ার অত্যন্ত প্রতিভাবান ফুটবলার ছিলেন। তিনি ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতেন, কিন্তু আক্রমণাত্মক ফুটবলার হিসেবেও একই রকম দক্ষ ছিলেন। দুর্দান্ত পাসিং এবং ড্রিবলিং করতেন, গোল করার ক্ষমতা রাখতেন। তিনি একজন কিংবদন্তি ফুটবলার।

ইয়োহান ক্রুইফ: বেকেনবাওয়ার একজন অনন্য ফুটবলার। তিনি একজন ডিফেন্ডার, যিনি আক্রমণে সমান দক্ষ। পাসিং এবং ড্রিবলিংয়ে অসাধারণ দক্ষতা। গোল করার ক্ষমতাও রাখতেন এই কিংবদন্তি ফুটবলার।

ক্যাপটেন্সি

ফ্রাঞ্জ বুট্রাঘার: দুর্দান্ত ক্যাপ্টেন। নেতৃত্বে দৃঢ়, দলকে জয়ের দিকে পরিচালিত করতে সক্ষম ছিলেন।

কার্ল-হাইনজ রুমেনিগে: দৃঢ় নেতৃত্বের পাশাপাশি তিনি একজন দক্ষ কৌশলবিদ ছিলেন। দলের খেলাকে উন্নত করে তুলতে সক্ষম ছিলেন।

উলফগ্যাং নেয়ার: কড়া ধাঁচের ক্যাপ্টেন। আত্মবিশ্বাসী। দলকে জয়ের জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারতেন।

কোচিং

ইয়োহান ক্রুইফ: সফল কোচ, দুর্দান্ত কৌশলবিদ, দলের খেলাকে উন্নত করতে সক্ষম ছিলেন।

ফ্রাঞ্জ বুট্রাঘার: বেকেনবাওয়ার একজন সফল কোচ ছিলেন। তিনি একজন দক্ষ ম্যানেজার ছিলেন এবং দলকে জয়ের জন্য নেতৃত্ব দিতে সক্ষম ছিলেন।

কার্ল-হাইনজ রুমেনিগে: একজন সফল কোচ হিসেবে দলকে উন্নত করে তুলতে দক্ষ ছিলেন।

বেকেনবাওয়ারের সবচেয়ে বড় নিন্দুক

বেকেনবাওয়ারের সবচেয়ে বড় নিন্দুক বা সমালোচক হলেন ইংরেজ ফুটবল কিংবদন্তি ববি চার্লটন। চার্লটন বেকেনবাওয়ারের খেলার ধরন নিয়ে সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, বেকেনবাওয়ার একজন ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতেন, কিন্তু তিনি একজন আক্রমণাত্মক ফুটবলার হিসেবে খেলার চেষ্টা করতে এটি জার্মানি জাতীয় দলের জন্য ক্ষতিকর ছিল।

চার্লটন ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে জার্মানি-নেদারল্যান্ডস ম্যাচের পরে বেকেনবাওয়ারের তীব্র সমালোচনা করেন। ম্যাচটিতে জার্মানি ৩-২ গোলে জয়লাভ করে। কিন্তু ম্যাচের শেষ দিকে বেকেনবাওয়ার আক্রমণাত্মক দিকে খেলতে গিয়ে ডিফেন্সে ফাঁক তৈরি করেছিলেন। এই ফাঁক দিয়ে নেদারল্যান্ডসের স্ট্রাইকার জোহান ক্রুইফ গোল করেছিলেন।

ফাইল ফটো

চার্লটন ম্যাচের পরে বলেন, “বেকেনবাওয়ার একজন দুর্দান্ত খেলোয়াড়। কিন্তু তিনি একজন ডিফেন্ডার হিসেবে খেলতে পারেন না। তিনি একজন আক্রমণাত্মক ফুটবলার। তিনি ডিফেন্সে ফাঁক তৈরি করেন।”

চার্লটন বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বের গুণাবলী নিয়েও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, “বেকেনবাওয়ার একজন দুর্বল নেতা। তিনি তাঁর দলকে জয়ের দিকে পরিচালিত করতে পারেন না।”

বেকেনবাওয়ার অবশ্য চার্লটনের এ সব সমালোচনাকে উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “চার্লটন একজন দুর্দান্ত খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু তিনি একজন দুর্বল সমালোচক।”

ফুটবলের বাইরেও বর্ণময়

ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ছিলেন একজন সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্ব। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আগ্রহ ছিল তাঁর। সব সময় নতুন জিনিস শিখতে এবং অভিজ্ঞতা অর্জন করতে আগ্রহী ছিলেন। ফুটবল বাদে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের বিশেষ পছন্দ, শখ বা নেশাগুলি এই রকম:

ভ্রমণ: বেকেনবাওয়ার একজন ভ্রমণপিপাসু ছিলেন। কেরিয়ারের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের পরে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপের পরে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে আগ্রহী ছিলেন।

ফ্যাশন: খুব ফ্যাশন সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। একজন ফ্যাশন আইকন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি সব সময় আধুনিক এবং স্টাইলিশ পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। তিনি বিভিন্ন ফ্যাশন ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করেছেন।

সঙ্গীত: সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত শুনতে পছন্দ করতেন, বিশেষ করে রক এবং পপ সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন। তিনি দ্য রোলিং স্টোনস, দ্য বিটলস এবং এলভিস প্রেসলি-সহ বিভিন্ন রক এবং পপ তারকাদের গান শুনতেন।

শিল্প: বেকেনবাওয়ার একজন শিল্পপ্রেমী ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতেন, বিশেষ করে চিত্রকর্ম এবং ভাস্কর্য। তিনি তাঁর বাড়িতে একটি ব্যক্তিগত শিল্প গ্যালারি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

গাড়ি: বেকেনবাওয়ার গাড়িপ্রেমী ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধরনের গাড়ি চালানো উপভোগ করতেন, বিশেষ করে স্পোর্টস কার। তিনি বিভিন্ন ধরনের গাড়ি সংগ্রহ করতেন, বিশেষ করে স্পোর্টস কার। বাড়িতে গ্যারেজে শোভা পেত বহু রকমের গাড়ি।

বেকেনবাওয়ারের জীবনে প্রেমদুই স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক

ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার একজন আকর্ষণীয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তাঁর খেলার দক্ষতার পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্বের জন্যও পরিচিত ছিলেন। তিনি একজন সুদর্শন পুরুষ ছিলেন এবং তিনি মহিলাদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। বেকেনবাওয়ারের জীবনে দু’টি বিবাহ হয়েছিল।

প্রথম প্রেম ও বিচ্ছেদ

প্রথম স্ত্রী ছিলেন অ্যানিলা হেন্ডার। অ্যানিলা ছিলেন বায়ার্ন মিউনিখের একজন টিম মেড। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। তাঁরা ১৯৬৯ সালে বিয়ে করেন। বেকেনবাওয়ারের জীবনীকার ব্রায়ান ডেভিস লিখেছেন, অ্যানিলা হেন্ডার ছিলেন বেকেনবাওয়ারের প্রথম প্রেম। তাঁরা একটি সুখী বিবাহিত জীবন কাটিয়েছিলেন। কিন্তু বেকেনবাওয়ারের ফুটবল কেরিয়ারের সাফল্য এবং জনপ্রিয়তা তাঁদের সম্পর্কের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিল।

ফাইল ফটো

বেকেনবাওয়ার এবং অ্যানিলা হেন্ডারের বিবাহবিচ্ছেদের কারণ নিয়ে অনেক গুঞ্জন রয়েছে। কিছু লোক মনে করেন যে, বেকেনবাওয়ার তাঁর কেরিয়ারের উপর বেশি মনোযোগ দিতেন এবং তার স্ত্রীকে পর্যাপ্ত সময় দিতেন না। অন্যরা মনে করে যে অ্যানিলা হেন্ডার বেকেনবাওয়ারের জনপ্রিয়তা এবং সাফল্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। বিয়ের  সাত বছর পরে, ১৯৭৬ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।  তাঁদের একটি মেয়ে আছে, ডিনারা।

 দ্বিতীয় প্রেম আমৃত্যু

বেকেনবাওয়ারের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন ক্রিস্তিন বেকেনবাওয়ার। তাঁরা ১৯৮২ সালে বিয়ে করেন এবং ২০১৫ সালে মৃত্যু পর্যন্ত একসাথে ছিলেন। বেকেনবাওয়ার এবং ক্রিস্তিনের পরিচয় হয়েছিল ১৯৮২ সালে, একটি পার্টিতে। বেকেনবাওয়ারের জীবনীকার ব্রায়ান ডেভিস লিখেছেন, ক্রিস্তিন ছিলেন বেকেনবাওয়ারের দ্বিতীয় প্রেম। তাঁরাও একটি সুখী বিবাহিত জীবন কাটিয়েছিলেন। বেকেনবাওয়ারের কেরিয়ারের সাফল্যে ক্রিস্তিন তাঁর পাশে ছিলেন এবং সব সময় স্বামীকে সমর্থন জুগিয়ে গিয়েছেন। তাঁদের তিন সন্তান আছে, কেভিন, মার্কো এবং ফ্রান্স। কেভিন ছিলেন একজন ফুটবলার। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে খেলেছেন।  মার্কো ব্যবসায়ী এবং ফ্রান্স একজন অভিনেতা।

বেকেনবাওয়ার এবং অ্যানিলা হেন্ডার বিবাহবিচ্ছেদ ঘোষণা করেছিলেন ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপের পরে। এই বিবাহবিচ্ছেদ ছিল ফুটবল বিশ্বে একটি বড় খবর।

বেকেনবাওয়ার এবং ক্রিস্তিন বেকেনবাওয়ার বিয়ে করেছিলেন ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপের পরে। এই বিয়ে ছিল ফুটবল বিশ্বে আরও বড় একটি খবর।

এ বার ঘুমের মধ্যে শেষ খবরটি রেখে চলে গেলেন কিংবদন্তি অ্যাটাকিং ডিফেন্ডার।

অলংকরণ – রাতুল চন্দরায়