দীপংকর ঘোষ
বৃষ্টি হয়েই চলেছে। কখনও ধীরে, কখনও জোরে। বর্ষার মরসুমে এই শুখা বাঁকুড়া অতি বর্ষণে লাল মাটি, বাদামী ঘাসকে ঢেকে দিয়ে সবুজ হয়ে উঠেছে। এ যেন মালভূমি এলাকা নয়। চব্বিশ পরগনার উর্বর শস্যশ্যামলা ভূমির বুকেই যেন হেঁটে চলেছি। চাষিরা নেমে পড়েছে মাঠে। তাদের মন তবু অবিশ্বাসী! রুক্ষ মালভূমির বুকে এত বৃষ্টি তো কখনও হয়না। বৃষ্টি দেখে বীজ তো ছড়িয়ে দিলাম মাঠে। কাল বৃষ্টি থাকবে তো? প্রকৃতির ভাব কিন্তু অন্যরকম।
চাষি কী ভাবলো না ভাবলো তাতে তার বয়েই গেছে। সে খেলতে নেমেছে সৃষ্টির খেলা। রুক্ষ নিষ্প্রাণ মাটির বুকে প্রাণ সঞ্চারের খেলা। এই খেলার তেজ বাড়লে বাঁকুড়া হয়তো বাঁচবে, কিন্তু প্রাণসংশয় হবে মেদিনীপুরের। শুশুনিয়া(shushunia), বাঁকুড়ার উচ্চভূমি থেকে নেমে আসা জল যে প্লাবন ঘটাতে পারে দুই মেদিনীপুরের বুকে— সেদিকে যেন ভ্রুক্ষেপই নেই প্রকৃতির। তার শুধু একটাই লক্ষ। রুখা, শুখা বাঁকুড়াকে সবুজ করে তোল।
শেষ পর্যন্ত আমরা সেই রাধাকৃষ্ণ লজে এসেই উঠেছি। তবে আসার আগে শেষ চেষ্টা করেছিলাম পাশের একটা হোটেলে। কিন্তু সেই সময়ে হোটেল বন্ধ। আর স্থানীয় লোকজনও জানাল, এর ব্যবস্থাপনা মোটেই ভাল নয়। তাই রাধাকৃষ্ণেই আমরা নিজেদেরকে সমর্পিত করেছি। প্রথমে যে ঘরগুলো দেখানো হয়েছিলো— সেগুলো নয়, এবার আমাদের জন্য বরাদ্দ হল তিন তলায় ডর্মেটরি। ঘরটা বড়। এ ঘরে কোনও বেড নেই। ফ্যান আছে, জানলা আছে, হাওয়া খেলার জায়গা আছে।
মেঝেতে তোষক, চাদর, বালিশ পেতে পাঁচজনের জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। ঘর পেয়ে এতক্ষণে একটু শান্তি বোধ করছি। সেই ভোরবেলা থেকে তো খালি চক্করই খেয়ে গেলাম। এতক্ষণে একটু সুযোগ পাওয়া গেছে। একে একে সবাই প্রাতঃকৃত্য সারবার পর যেন একটু চাঙ্গা বোধ করতে লাগলাম। খানিক বাদে ঘরেই চলে এলো জলখাবার। অবশেষে ধাতস্থ হলাম আমরা।
শুশুনিয়ার (shushunia) বয়স অতি সুপ্রাচীন। সৃষ্টির সেই আদি দিনগুলোর থেকে শুরু করে আজও যে দাঁড়িয়ে আছে একই ভাবে। যুগ যুগান্তরের কত কত ইতিহাস এই পাহাড়ের পরতে পরতে জমে রয়েছে কে জানে। ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা এখানে দেখতে আসেন ঝর্ণা, দেখতে আসেন শিলালিপি। পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসা ঝর্ণার জলকে বড় পবিত্র বলে মানে এলাকার মানুষ। গোটা এলাকায় এই ঝর্ণার জলই পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শুশুনিয়ার (shushunia) পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে রয়েছে এই বাংলার প্রাচীন এক শিলালিপি। এই শিলালিপি থেকে জানা যায়— রাঢ় অঞ্চলের রাজা চন্দ্রবর্মনের রাজধানী ছিল পুস্করনা।
বড়জোড়া থানার অধীন পখোরনা বা পাখাননা গ্রামকেই প্রাচীন সেই পুস্করনা বলে মনে করা হয়। সে বহুকাল আগের, খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের কথা। এই শিলালিপি প্রাচীন রাঢ় অঞ্চলের রাজা সিংহবর্মনের পুত্র চন্দ্রবর্মনের কীর্তি। ইতিহাস বলে, চন্দ্রবর্মন শুশুনিয়া (shushunia) পাহাড়ে একটি কেল্লা তৈরি করিয়েছিলেন। এলাহাবাদ প্রশস্তি অনুসারে, গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত চন্দ্রবর্মনকে হারিয়ে তাঁর রাজ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
শুধুমাত্র ষোল-সতেরশো বছর আগের নয়, শুশুনিয়ার (shushunia) ইতিহাস আরও অনেক অনেক প্রাচীন। শুশুনিয়াকে বলা হয় পুরাতাত্ত্বিক ও ফসিল ক্ষেত্র। শুনেছি, এখান থেকে হায়না, সিংহ আরও নানারকম জন্তুজানোয়ার, এমনকি জিরাফেরও নাকি ফসিল পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে প্রস্তর যুগের মানুষের ব্যবহার্য সামগ্রী। চারশো বিয়াল্লিশ মিটার উঁচু এই শুশুনিয়া (shushunia) পাহাড় বহু ভেষজ উদ্ভিদেরও ভাণ্ডার। শুশুনিয়া (shushunia) সম্বন্ধে আরও একটা তথ্য, এখানে পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বহু নামকরা পর্বতারোহী তাঁদের যাত্রা শুরু করেছেন এখান থেকেই।
জলখাবার খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়ে আমরা পাঁচজন ঘর থেকে নেমে আসি রাস্তায়। লজের পাশেই খাবারের একটা হোটেল। উনুনে কড়াই চাপিয়ে তখন তেলেভাজা বসেছে। স্থানীয় বেশ কয়েকজন লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে বেঞ্চে। চায়ের অর্ডার দিয়ে আমরাও বসলাম। বৃষ্টি নেই, কিন্তু আকাশে মেঘ রয়েছে। আমরা শুনেছি ঝর্ণার কথা।
চা দিতে আসা দোকানের কর্মীকে তা নিয়ে জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, ঝর্ণায় স্নান তো করা যাবেই, খাওয়াও যাবে সেই জল। এলাকার সবাই খাবার জল বলতে ঝর্ণার জলই বোঝে। আবও একটা ব্যাপার, এই অঞ্চলে মাটির তলার জলস্তর অনেক নীচে। একটা টিউবওয়েল বসাতে খরচও অনেক। স্বাভাবিক ভাবেই অত পয়সা, অত পরিশ্রম করে মাটির তলা থেকে জল না তুলে ঝর্ণার জল খাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এলাকার মানুষের অভিজ্ঞতা হল, এই জল থেকে কোনও ভয় নেই। জলের যোগান বন্ধ হয়ে যাবারও সম্ভাবনা নেই। ঝর্ণার জল সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞানলাভ করে বেরিয়ে আসি হোটেল থেকে।
একটা প্রশ্ন অবশ্য মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। হিমালয় থেকে নেমে আসা নদীগুলোতে সারা বছর জল থাকে কী ভাবে— সে তো জানি। কিন্তু এই শুখা অঞ্চলে এই সামান্য উচ্চতার পাহাড়ে ঝর্ণার জলের উৎস কোথায়? এই মালভূমি অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের যা হাল, তাতে সেই জল পাহাড়ের খাঁজে ভাঁজে আটকে থেকে সারা বছর ধরে জলের যোগান দিয়ে যাবে অবিশ্রান্ত ধারায় এই ভাবনাটাও বেশ বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়। তবে? এটা তো সত্যি যে এই পাহাড়ে একটা ঝর্ণা রয়েছে আর তা থেকে বারোমাস জল ঝরে চলেছে। কত বড় প্রাকৃতিক জলের ট্যাঙ্ক আছে এই পাহাড়ে কে জানে!
(ক্রমশ)
অলংকরণ – রাতুল চন্দরায়
ভালো লাগল।