(অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রক্ত দিয়েছেন পূর্ববঙ্গের বহু বহু মানুষ। কিন্তু ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা আর দেশভাগ যখন একসঙ্গে এল, তাঁরা তখন পাকিস্তানের বাসিন্দা। ১৪ অগস্ট, ১৯৪৭-এ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে পূর্ববঙ্গের গ্রামেগঞ্জে ছিল উচ্ছ্বাসের ছবি। প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা পাওয়ার আনন্দে সেদিন মেতে উঠেছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষজন। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি গ্রামের এমনই একটি খণ্ডচিত্র উঠে এসেছে জীবন সাহা-র ‘যাপিত জীবন’ বইটিতে। লেখক অবশ্য পরে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসেন।)
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটি আমাদের অঞ্চলে কীভাবে উদযাপিত হয়েছিল সেকথা বলি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের কয়েক মাস আগে সৌরকলঙ্ক দেখা দিয়েছিল। এটা একটা স্বাভাবিক নৈসর্গিক ঘটনা। কিছু লোক এই নিয়ে গুজব সৃষ্টি করেছিল যে সূর্যের গায়ে পাকিস্তানের পতাকা দেখা দিয়েছে। এর ফলে অনেকেই নানা ভাবে সেটা দেখার চেষ্টা করছিল। অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ ছিল বেশি। কাঁচের টুকরোর ওপর প্রদীপের কালি ধরিয়ে তার মধ্য দিয়ে আমিও দেখেছি সে সৌরকলঙ্ক। সূর্যের গায়ে ছোট্ট একটা আয়তক্ষেত্রের মত দেখতে, এক চিলতে কালো ছাপ। এটা যে কী করে পাকিস্তানের নিশান হল, তা আমাদের মুসলমান সহপাঠীরাও ভেবে উঠতে পারছিল না। কারণ, নেপালস্যার বিজ্ঞানের ক্লাসে সৌরকলঙ্কের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সেটাকেই তারা সঠিক বলে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে এ নিয়ে বিতর্কে নামতে সাহস পাচ্ছিল না। ভয় ছিল ‘কানে বিড়ি মুখে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ মার্কা ছেলেরা তাহলে তাদের পেটাবে।
কিন্তু আসলে তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। আমাদের অঞ্চলে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটিতে এক অবিস্মরণীয় আনন্দ উৎসব হয়েছিল। তখন বর্ষায় দিগন্তবিস্তারী টইটম্বুর ভরা যমুনা নদী। নদীর বুকে শত শত নৌকোর ভীড়। কিছু পানসি ও গহনার নৌকোর ওপরে ট্যাবলো সাজানো হয়েছে। তাতে গ্রামীণ এবং ঐস্লামিক সংস্কৃতির কিছু বিষয় এবং কিছু রাজনৈতিক বিষয় উপস্থাপিত করা হয়েছে। কিছু নৌকো বাইচ প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। কিছু নৌকোয় উৎসাহী মানুষেরা ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ। কায়েদে আজম জিন্দাবাদ’ ধ্বনি তুলছে, সেই ধ্বনি সারাটা অঞ্চল জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। প্রতিটি নৌকোয় উড়ছে পাকিস্তানের পতাকা। নদীর সুদীর্ঘ তীর জুড়ে উদ্বেলিত মানুষের ভীড়। বকুলতলা থেকে বাজারের ঘাট পর্যন্ত রাস্তা জুড়ে বেঞ্চ ও চেয়ার পেতে বসেছেন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। মুসলিম যুবনেতারা বিনয়ের সঙ্গে পরামর্শ করছেন প্রবীণ এবং মান্য হিন্দুদের সঙ্গে। কয়েকটি হাইবেঞ্চে সাজিয়ে রাখা হয়েছে বড় বড় কাঁসার থালা আর পিতলের ঘড়া। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার স্বরূপ দেওয়া হবে ওগুলো। কয়েকটি ফুলদানিতে সাজানো রয়েছে ফুলের তোড়া। লম্বা টিনের চোঙা মুখে লাগিয়ে ভলান্টিয়াররা অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করছিল। সেই চোঙা মুখে লাগিয়েই বক্তারা বক্তৃতা করলেন। তারপর শুরু হল বাইচ। নদী এবং তার তীর জুড়ে তখন যেন হৈ-হৈ কাণ্ড রৈ-রৈ ব্যাপার। ইতিমধ্যে ফুটবল আর হা-ডু-ডু খেলা সাঙ্গ হলে দর্শক আর খেলোয়াড়রা এসে ভীড় জমালো নদীতীরে। তাদের বিজয়ীদেরও পুরস্কৃত করা হবে। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত, আনন্দে উদ্বেলিত অনুষ্ঠান সূর্যাস্তের পরেও প্রায় আধঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল।
আলিসাকান্দায় যে অনুষ্ঠান হয়েছিল তারও প্রকৃতি ছিল একই রকম। আমার বড়মামা শশধর রায় ছিলেন সেই অঞ্চলের বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি। স্বেচ্ছাসেবকেরা যখন ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি ধ্বনি দিচ্ছিল তখন তিনি নাকি তাদের বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, জোরে জোরে জিন্দাবাদ কর, তবে দুই-চাইরবার বন্দেমাতরমও কোইস।’ তখন মনের আনন্দে তারা নাকি বন্দে মাতরম ধ্বনিও দিয়েছিল। এই বিষয়টি আমি শুনেছি আমার মামাতো ভাই কমলকৃষ্ণের কাছে। সে তখন সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল।
এতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে তখন পর্যন্তও আমাদের গ্রামীণ সমাজে সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং ঘৃণার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়নি। এটা এসেছে আরও পরে, এসেছে বাইরে থেকে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের কাঁধে চেপে। ফলে ক্রমে বিষাক্ত হয়েছে গ্রাম্যজীবন।
(অলঙ্করণ -রাতুল চন্দ রায়)
[…] পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা Share WhatsApp Facebook Telegram Twitter Google+ Pinterest Linkedin Previous article‘সতী’ হলেও সম্মানের গ্যারান্টি নেই মোহসীন উল হাকিমhttps://balihas.com/ […]
[…] বন্দেমাতরম, রবীন্দ্রনাথ ও সরলা দেবী পূর্ববঙ্গের প্রথম স্বাধীনতা বিতর্কের পরেও জনগণমন আমাদের পতাকা […]