সে সময়ে, কালেভদ্রে প্লেনে চড়তে পারা শিশুটির জন্যে ট্রেতে করে বিভিন্ন রঙের চকলেট নিয়ে আসতেন গুছিয়ে শাড়ি পরা বিমানবালা। লজ্জা লজ্জা মুখে দু-চারটে চকলেট নেওয়া হাতে আরও কয়েকটি গুঁজে দেওয়া। তারপর হাল্কা জলখাবার …প্লেনে বিক্রিবাটা নয়। দরজায় দাঁড়িয়ে, মুখে কোনও কথা না বলা হাসি দিয়ে…বিদায় জানানো।
সময়ে পাল্টেছে। বিমান সফরেও বদলেছে অনেক কিছু। ভারিক্কি মুখে, সিট নিশ্চিন্ত, তল্লাশি পর্ব শেষ হওয়ার পর, ঘুরে দেখি চারপাশ। ব্র্যান্ডেড মিষ্টির দোকান, কিন্তু চোখে দামটাই ভাসে। পোশাকের দোকানে বেশ কিছু মহিলা… তবে অভিজ্ঞতা বলে, সেটা তাঁদের সময় কাটানোর প্রকৃষ্ট উপায়। রেস্তোরাঁ আছে দু চার খানা… একটাই বইয়ের দোকান … প্রচুর স্টক… কিন্তু সবই ইংরেজি।
একটা ম্যাগাজিন রাখার স্ট্যান্ড । তাতে রাখা, একটি ইংরেজি ও হিন্দির যুগলবন্দি পত্রিকা এবং ঘোষণা… ইচ্ছে করলেই আপনি এটি নিয়ে যেতে পারেন। বিলকুল বিনামূল্যে। চমৎকার প্রচ্ছদ, ঝকঝকে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন। কিন্তু শুধু তা দিয়েই নয়। দু-চারটে লেখাও আছে। তার মধ্যে একটি, এই এয়ারপোর্টের গল্প।
বেঙ্গল আর্টিলারি রেজিমেন্টের ১৬৪১.৩৪ একর জমির প্যারেড গ্রাউন্ড খালি করে, সেখানে তৈরি হয় দমদম এয়ারপোর্ট। ১৯২৭ সালে KLM, আমস্টারডাম থেকে জাকার্তা যাওয়ার পথে এই এয়ারপোর্টে একটা স্টপ ওভার দেওয়া শুরু করে। এছাড়া ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স তো ছিলই। ১৯৯৫ সালে, এয়ারপোর্টের নাম বদলে রাখা হয় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট (NSCBI Airport)।
কিন্তু, চোখ আটকে গেল একটি তথ্যে। ১১ এপ্রিল ১৯৩২ সালে, এই এয়ারপোর্ট থেকেই পারস্য দেশে উড়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সকাল সাড়ে তিনটেয় এয়ারপোর্ট পৌঁছে, সকাল চারটেয় Trimotor Fokker F 12 প্লেনে করে উড়ে যাওয়া। সঙ্গে গিয়েছিলেন পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, সেক্রেটারি অমিয় চক্রবর্তী, আর্ট সমালোচক কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট পন্ডিত দিনশাহ জে ইরানি।
তখন কবির বয়েস তিয়াত্তর । প্রায় ৪০০০ কিলোমিটার সফরের ধকল সামলাতে পারবেন কিনা, সেই সন্দেহ ছিল। সে জন্যই সেই বছরে, ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে, ডাচ কোম্পানির এরোপ্লেন করে কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে আধ ঘণ্টা আকাশে উড়ে বেড়ালেন। সঙ্গে ছিলেন ডাচ কনসাল জেনারেল, তাঁর পত্নী এবং অমিয় চক্রবর্তী।
তবে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম আকাশপথ সফর অবশ্য এর বেশ কিছু বছর আগেই। ১৯২১ সালের ১৬ এপ্রিল, লন্ডনের Croyden এয়ারপোর্ট থেকে প্যারিসের Le Bourget এয়ারপোর্ট অবধি গেলেন ছোট Goliath প্লেনে করে। যে কোম্পানি এই প্লেন চালাতো, তার নাম ছিল Compagnie des Grands Express Aeriens। প্যারিসে, এয়ারপোর্টে নামার দৃশ্য নাকি মুভি ক্যামেরায় তোলা হয়েছিল।
তবে পারস্য সফর, আকাশপথে কবির জীবনে সবচেয়ে লম্বা যাত্রা। তবে একটানা নয় । প্রথম থামা এলাহাবাদ। তারপর যোধপুর। পরের দিন সন্ধেবেলার ফ্লাইটে করাচি, তারপরে জাসক। শেষ থামা bushire। তুমুল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখে সকাল দশটায় অবতরণ। সেই ভাবেই ফিরে আসা , তবে এবার কবি উঠেছিলেন বাগদাদ থেকে আর পৌঁছন জুনের ৫ মতান্তরে ৬ তারিখে। এটাই অবশ্য আকাশপথে রবীন্দ্রনাথের শেষ যাত্রা। সবমিলিয়ে চার বার। …সেই একই এয়ারপোর্ট থেকে।
একটু অন্য চোখে ফের চারপাশটা দেখি। না… একটা ঐতিহাসিক এয়ারপোর্ট থেকেই উড়ছি তাহলে।
তথ্য সূত্র—
sudip basuর লেখা প্রবন্ধ।
আন্তর্জালে থেকে প্রাপ্ত তথ্য
এবং Airports India November 2019 Vol 8