জলদস্যু ৪৯

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর থেকে অনেকগুলি জলদস্যু বাহিনী একে একে আত্মসমর্পণ করছিল। একের পর এক জলদস্যু দলের নেতার ফোন আসছিল আমার কাছে। দলবল নিয়ে তারা আত্মসমর্পণের আগ্রহ দেখাচ্ছিলেন। বিশেষ করে আমাদের এই উদ্যোগ সফল হওয়ায় নতুন ভাবে জীবন শুরু করার প্রয়াসে সাড়া দিচ্ছিলেন প্রায় সকলেই। কিন্তু এই সময়েই ঘটে গেল অন্য রকমের এক কাণ্ড। জলদস্যু দলের ভিতরে আত্মসমর্পণ নিয়ে আচমকাই গুলির লড়াইয়ের ঘটনা ঘটে গেল। একেবারে নাটকীয় ব্যাপার স্যাপার। আর আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ার মধ্যেই ওই ধরনের একটি ঘটনা ঘটিয়ে আমাকে ভয়াবহ দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলেন সুমন বাহিনীর এক সদস্য, সাত্তার।
এই সুমন বাহিনীকে যেদিন আত্মসমর্পণ করাতে গিয়েছিলাম, সেদিন সুন্দরবনের জঙ্গলে এলাহী ভুরিভোজের ব্যবস্থা হয়েছিল। জঙ্গলের ভিতরে প্যান্ডেল টাঙানো হয়েছে। রান্না হয়েছে হরেক রকমের মাছের পদ। বিরাট আয়োজন। ভুরিভোজের জন্য হরিণ শিকার করতেও গিয়েছিলেন ওদের বাহিনীর দু’জন। আর সেই সময়েই ঘটে গিয়েছিল গোলাগুলির ঘটনা। যা শুধু আমরা কেন, সুমন বাহিনীর অন্য সদস্যরাও আগে থেকে ভাবতে পারেননি।


সুমন বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে— কথাটা মেনে নিতে পারেননি এই সাত্তার। বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু সাত্তার জানতেন, সুমনের ডেরা থেকে পালিয়ে যাওয়া অত সহজ ব্যাপার নয়। কারণ, সুমন বাহিনীর সব সদস্যই তখন আত্মসমর্পণের জন্য মরিয়া। এই সময়ে যদি ভিন্ন ভাবনার কথা বলেন, তাহলে নির্ঘাত গুলি খেয়ে মরতে হবে। তাই ভিতরে ভিতরে একটা ছক কষলেন তিনি। রাস্তা বার করলেন পালানোর।
কিন্তু কী ভাবে? একদিকে যখন ভুরিভোজের আয়োজন চলছে, অন্যদিকে সেই আয়োজনকেই তাঁর পালানোর সুযোগ হিসেবে বেছে নিলেন সাত্তার। দলের সবাইকে বললেন, ভোরবেলাতেই তিনি জঙ্গলে হরিণ শিকার করতে যেতে চান। সাত্তারের আসল পরিকল্পনার কথা তখন কেউই বুঝতে পারেননি। ফলে সন্দেহের কোনও কারণ ছিল না। সাত্তারের সঙ্গে নৌকা নিয়ে শিকার করতে বের হলেন দস্যু নেতার বড় ভাই রিপন শরীফ। সকলে ভাবলেন, ওরা যদি হরিণ মেরে নিয়ে আসতে পারলে ভুরিভোজটা ভালই জমবে।
কিন্তু শিকারে গিয়ে অন্য ছক কষলেন সাত্তার। রিপন শরীফকে বললেন, ‘‘তোমার বন্দুকটা আমাকে দাও। আজ আমিই শিকার করবো।’’ কোনও কিছু না ভেবে তার হাতে নিজের দোনলা বন্দুকটা তুলে দিলেন রিপন। কিন্তু সেই বন্দুক হাতে পেয়েই অন্য মূর্ত্তি ধরলেন সাত্তার। যার থেকে বন্দুক নিলেন, তাকে মারতেই গুলি চালিয়ে দিলেন। রিপনের বুক লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিলেন সাত্তার। কিন্তু একটু সরে যাওয়ায় রিপনের হাতে এসে লাগল গুলি। আর্তনাদ করে পানিতে পড়ে গেলেন তিনি। এবার সেই নৌকা নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চললেন সাত্তার।

ভোর বেলা। পূর্ব সুন্দরবনের চাত্রী-ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের ভিতরের ছোট্ট খালে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে গেল। সাত্তার খুবই দক্ষ একজন দস্যু। পাকা শিকারী, আবার বনে চলাফেরায় সিদ্ধহস্ত। রিপন শরীফকে গুলি করে এক মুহুর্ত দেরি করেননি। নৌকা বেয়ে সোজা পশুর নদীতে উঠে পড়লেন। একা একাই পাড়ি দিলেন বিশাল পশুর নদী। উল্টো পাশের পাশাখালী খাল দিয়ে নৌকা নিয়ে চললেন তিনি। তারপর পাশাখালী বন টহল ফাঁড়ীর পাশে নৌকা রেখে উঠে পড়লেন। তখন তার
হাতে দু’টি বন্দুক। একটি একনলা বন্দুক ঘাড়ে আর ছিনিয়ে আনা দোনলা বন্দুকটি হাতে। বনকর্মী সেখানে ছিলেন দুইজন। সাথে অস্ত্র ছিলো না। তাই একজন বনদস্যু দুটো বন্দুক হাতে অফিসে উঠে পড়লেও কিছু করার ছিল না তাঁদের। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে
ড্রামে খাবার পানি নিয়ে সাত্তার ঢুকে পড়লেন গহীন বনে।

এদিকে, এসব ব্যাপারে কোনও ধারনাই করতে পারিনি আমরা। ঠিক ছিল, সেদিনই আমি সুমন বাহিনীর কাছে পৌঁছে যাবো। মোংলা থেকে সুন্দরবনের পশুর নদীর পাশে ঘসিয়াঙ্গারী খালে যেতে সময় লাগে ছয়-সাত ঘণ্টা। ওই খালের মুখে থাকতে বলা হয়েছিল সুমন বাহিনীকে। কথা হয়েছিল, দুবলার চর থেকে আমি সেখানে পৌঁছবো। তারপর ওদের সঙ্গে দেখা করে তুলে নেব আমাদের ট্রলারে। তারপর বাহিনীর সদস্যদের তুলে দেবো RAB-এর হাতে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, যেদিন আমি রওনা দেবো, সেই দিন সকালে দুবলার চরে হেঁটে বেড়াচ্ছি। জোয়ার আসলে রওনা দিবো সেখান থেকে। দুবলার চর এলাকাটা এমনিতেই আমার প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যে একটা। সকালবেলা খোলা আকাশের নীচে হাঁটতে বেশ ভালই লাগছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, এবার সুমন বাহিনীকে সারেন্ডার করাতে পারলে কাজ অনেকটাই এগিয়ে যাবে।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর এক। হঠাৎই বেজে উঠল আমার মোবাইল ফোন। ফোন ধরে দেখি, ওপাশে সুমন বাহিনীর সদস্য জুয়েল। ভাবলাম এমনিতে খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছে। যদিও ফোন দেয়ার কথা ছিল না।
জুয়েলের গলায় উদ্বেগ। আমাকে বললো, ‘‘মামা, এদিকে তো বিরাট বড় ঝামেলা হয়ে গেছে।’’ অবাক হয়ে আমি বললাম, ‘‘কি ঝামেলা?’’ জুয়েল বললো, ‘‘আমাদের মধ্যে বন্দুক নিয়ে লড়াই হয়ে গেছে। সাত্তার সকালে হরিণ শিকারে বের হয়েছিল একজনকে নিয়ে। তারপরে একজনকে মেরে বন্দুক নিয়ে পালিয়ে গেছে।’’ গোটা ঘটনাটা আমাকে জানালো জুয়েল।


আমি জানতাম, সুমন বাহিনীতে সাত্তার ছিলেন রামপালের অধিবাসী। বাহিনীর অন্যদের বাড়ি মোড়েলগঞ্জে। সাত্তারের ঘটনা শোনার পর মনের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা দানা বেঁধে উঠল। ভাবলাম, সুমন বাহিনীর অন্যরা সারেন্ডার করবে তো? এমনিতেই দস্যু দলটিকে রাজি করাতে প্রায় বছর খানেক লেগেছে। কী হবে শেষ পর্যন্ত! বন্দুক যুদ্ধে কে মরলো, কে বাঁচলো কিছুই তথনও বুঝতে পারছিলাম না। জুয়েল বলছিলো দ্রুত তাদের ওখানে যেতে। ভিতরে ভিতরে আরও কোনও ছক কষছে না তো কেউ?
(ক্রমশ)