মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন।২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন।প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন।

ফিরে এলাম সুন্দরবন থেকে। কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। এর মধ্যে কর্মস্থলের জায়গায় একটু পরিবর্তন হয়েছে। দেশ টিভি ছেড়ে এটিএন নিউজ চ্যানেলে যোগ দিয়েছি। কর্মস্থলের পরিবর্তন হলেও মনের ভিতরে যে চিন্তা সেটার কোনো রূপ বদল হয়নি। সাংবাদিকতা করি, কিন্তু চিন্তায় থাকি সুন্দরবনের ওই মানুষগুলিকে নিয়ে। কী ভাবে এই সমস্যার গোঁড়ায়  পৌঁছনো যায়! ঠিক করলাম, জলদস্যুদের সাথে যোগাযোগ করবো। কথা বলতে হবে ওদের সঙ্গে। খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে। কারও কাছে যদি কোনও লিংক থাকে। এক এক করে সবাইকে নক করলাম আমি।

অবশেষে একদিন একটা সূত্র পেয়ে গেলাম। সাতক্ষীরার সালাহউদ্দিন বাপ্পী। ওই অঞ্চলের একজন গণমাধ্যমের কর্মী। উনি দিয়েছিলেন একটি লিংক। একটা ফোন নম্বর। এক জলদস্যুর ফোন নম্বর। যে কেউ নয়, পশ্চিম সুন্দরবন এলাকার সবচেয়ে বড় বাহিনীর দস্যু সর্দার মোতালেবের ফোন নম্বর সেটা। নম্বরটা হাতে পেয়ে আর দেরি করলাম না। কল করলাম। কেউ ধরলো না। আবার ফোন করলাম। তারপর আবার। কিন্তু কেউ ধরলো না। কী করা যায়!  নিজের নাম ও পরিচয় জানিয়ে একটি মেসেজ পাঠালাম ওই নম্বরে। সেই সাথে যোগ করলাম—’দেখা করতে চাই। কথা বলতে চাই।’

এবার উত্তর পেলাম। পাল্টা বার্তায় জানালেন, কথা বলবেন উনি। কাল ফোন করবেন। সময়টাও বলে দিলেন।

মনের ভিতরে কেমন যেন একটা টেনশন। কিছুতেই মন বসছে না। রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করলাম আমি। ঘুম আসছে না। কখন সকাল হবে। কখন ফোন আসবে। কখন কথা হবে ভয়ঙ্কর দস্যু সর্দারের  সাথে।

সকাল হল। আমি সাত তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে পৌঁছে গেলাম কলবাড়ি আশ্রয়ন প্রকল্পের সামনে। সঙ্গে এটিএন নিউজের ভিডিওগ্রাফার সোহেল রানা। অপেক্ষায় আমরা। ধীরে ধীরে বেলা বাড়ছে। পেরিয়ে গেল নির্ধারিত সময়। কই, ফোন তো এলো না! এক একটা মুহূর্ত যেন কাটতে চাইছে না। আগের দিন এতবার ফোন করলাম, ফোন ধরেন নি। তারপর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মেসেজটি করার পরে রাজি হয়েছিলেন কথা বলতে। আজ কী হল? ফোন করবেন তো। নাকি …

সাতপাঁচ চিন্তা চেপে বসেছে আমার মাথায়। আরও বেশ কিছু সময় কাটার পরে অবশেষে এল সেই প্রতীক্ষিত ফোন। কথা হল মোতালেবের সাথে।  আমি এইবার পুরো পরিচয় দিলাম। এটিএন নিউজের সিনিয়র রিপোর্টার। দেখা করতে চাই, কথা বলতে চাই মোতালেবের সাথে।

এড়িয়ে গেলেন দেখা করে কথা বলার প্রসঙ্গ। কিন্তু ফোনে কথা বললেন দীর্ঘক্ষণ। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা মানে ৪৫ মিনিট।

আমি কোনওদিন জলদস্যু দেখিনি। হয়তো দেখেছি কোনো খবরের কাগজে কিংবা বইয়ের পাতায়। তাই কল্পনার একটা ছবি এঁকে কথা বলা শুরু করলাম মোতালেবের সঙ্গে। 

অনেক কথা বললাম সেদিন—কেন মোতালেব জলদস্যু হল, কীভাবে তাঁদের দিন রাত কাটে, কীভাবে অস্ত্র পায়, কীভাবে বাজার সদাই আসে—এসব। উঠে এসেছিল জেলেদের সঙ্গে তাঁদের অমানুষিক ব্যবহারের কথাও। কিন্তু ওই দীর্ঘ আলাপচারিতায় যেটা সবচেয়ে বেশি করে উঠে এসেছিল, সেটাই অবাক করেছিল আমাকে—আমরা জলদস্যুরা কেউ ভাল নেই।

মজনু বাহিনীর আস্তানায়। এই বাহিনীর সর্দার ছিলেন মোতালেব

কী বলছে এইসব! যাদের ভয়ে সারা সুন্দরবন কাঁপছে, যাদের জন্য ঘুম নেই সুন্দরবনের ৩০ লক্ষ মানুষের… তারা ভাল নেই। কেন ?

-প্রতি মুহূর্তে ভয়ে কাটাতে হয়। কখনও আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষা বাহিনীর, কখনও প্রতিদ্বন্দ্বীদের। 

-কেন ?

– ক্রসফায়ারের ভয়। দেখলেই গুলি চালাবে ওঁরা।

– ছেড়ে দিচ্ছেন না কেন এই কাজ? কী পাচ্ছেন দস্যুতা করে?

– কী করে ফিরবো? সব পথ বন্ধ।

-কেন? আত্মসমর্পণ করুন।

-কার কাছে করবো? আমরা তো ক্রসফায়ারের আসামি। আমাদের কাছে পেলে মেরে ফেলবে। এখানে কাউকে বিশ্বাস নেই। 

– আদালতে করেন।

-আমাদের আদালত পর্যন্ত যেতে দেবে না। তার আগে খবর চলে যাবে। ধরা পড়ে যাবো আমরা। ওখানেই গুলি করে মেরে ফেলবে আমাদের।

কে জানতো একদিন সত্যি হবে মোতালেবের কথাগুলি। মরতে হবে মোতালেবকে।

মোতালেবের সাথে কথা বলার পরেও আমি অনেক জলদস্যুর সঙ্গে কথা বলেছি, এদের বেশির ভাগই আমাকে বলছে, তারা ভাল নেই। আমি ভাবলাম, এমন একটা অবস্থা, যেখানে কেউ ভাল নেই। না ভাল আছে সুন্দরবনের সাধারণ মানুষ না সুন্দরবনের এই ভয়ঙ্কর দস্যুরা। তাহলে ভাল আছে কারা ?

-আমি যদি আপনাদের মাঝখানে থাকি ?

-আপনি সাংবাদিক। আপনার কথা ভিন্ন। তখন চিন্তা করা যাবে।

আমি যেন একটা গোলাপি আলোর রেখা দেখতে পেলাম। যদি কাজটা করতে পারি তবে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে সুন্দরবনের মানুষগুলি। নিশ্চিন্তে জঙ্গলে যেতে পারবেন জেলেরা।

আমার সাথে মোতালেবের আলাপ জমে উঠেছিল। প্রথমদিনেই। জানি না কেন। হয়তো ভাল লেগেছিল আমাকে। মন খুলে সবটাই বলেছিলেন আমাকে।

আর একটা অবাক করা কাণ্ড ঘটেছিল সেদিন। মোতালেবের সঙ্গে কথা বলার সময়েই বেজে উঠেছিল আমার অন্য ফোনটি। ফোন করেছেন আর একজন দস্যু সর্দার। এর মধ্যে খবর পৌঁছে গেছে! কি অসাধারণ নেটওয়ার্ক!

হয়তো জলদস্যুরা ফিরতে চায় সাধারণ জীবনে। কিন্তু তার পরিবার কি চায়? সবাই কি খুশি হবে যদি জলদস্যুরা আত্মসমর্পন করে?

আগামী পর্বে শোনাবো এক বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনি। কেন মারা গেল মোতালেব…।

(ক্রমশ)

8 COMMENTS

  1. ভাইয়া আমি কিছু পর্ব মিস করে গেছি! কিভাবে পাবো ঐ পর্ব গুলো???

  2. ভাইয়া, আমি মিস করা পর্ব গুলো পড়তে চাই

  3. অনেক ধন্যবাদ আমাদেরকে এই বিষয়গুলো তুলে ধরবার জন্য

Comments are closed.