সুখেন্দু হীরা

প্রতারকের আভিধানিক অর্থ, যে ঠকায়। অর্থাৎ যে প্রতারণা করে। প্রতারণা শব্দের ব্যুৎপত্তি ‘প্রতার’ নামধাতু থেকে। যার অর্থ, ঠকানো বা বঞ্চিত করা। প্রতারণার আভিধানিক অর্থ- ছলনা, শঠতা, ঠকানো। আরও আছে, জুয়াচুরি, প্রবঞ্চনা। জুয়াচুরি কথাটি ‘জুয়া খেলাতে চুরি করা থেকে এসেছে কি না, বলতে পারব না। তবে জুয়াতেও ছল, কপটতার আশ্রয় নেওয়া হয়। সে বিষয়ে বিস্তারে পরে আলোচনা করা যাবে। তবে প্রতারকের আরেকটা সমার্থক শব্দ হল, জুয়াচোর। যাকে আমরা কথ্য ভাষায় জোচ্চোর বলি। প্রবঞ্চনা অর্থাৎ প্রকৃষ্ট রূপে বঞ্চনা করা। বঞ্চনা শব্দের ব্যুৎপত্তি বঞ্চ ধাতু থেকে। বঞ্চ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ। বঞ্চ শব্দের অর্থ বঞ্চনা করা। তাই প্রতারকের একটি সমার্থক শব্দ হল প্রবঞ্চক।

নারায়ণ স্যান্যালের একটি বিখ্যাত বই আছে ‘প্রবঞ্চক’ নামে। এই বইতে দু’টি প্রবঞ্চনার গল্প আছে, দু’টিই চিত্রশিল্প জগতের। প্রথম গল্প ‘মোনালিসার প্রেমে’। প্রবঞ্চক প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে লা জ্যাকোন্ডা অর্থাৎ লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা ‘মোনালিসা’ ছবি মিউজিয়ামের কর্মচারীকে দিয়ে সরিয়ে রাখেন। সারা বিশ্বে রটে যায়, জগৎবিখ্যাত ‘মোনালিসা’ গায়েব। এই সুযোগে প্রবঞ্চক ছ’টি নকল মোনালিসার ছবি বিক্রি করে দিলেন বিপুল দামে।

দ্বিতীয় গল্পে এক প্রবঞ্চক বিখ্যাত শিল্পী ভেরমিয়ারের ছবির অনুকরণে আঁকতেন। সবাই সেগুলি ভেরমিয়ারের ছবি বলে কিনত। শুধু তাই নয়, ভেরমিয়ার বিশেষজ্ঞ পর্যন্ত প্রবঞ্চকের আঁকা ছবিগুলোকে ভেরমিয়ারের ছবি বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় গল্পের প্রবঞ্চনার মাত্রা বেশি হয়েও প্রথম গল্পের ক্ষেত্রে প্রবঞ্চকের বুদ্ধিমত্তার তারিফ না করে পারা যায় না।

এই বুদ্ধিমত্তার কারণে বিশ্বখ্যাত প্রতারক চার্লস শোভরাজ সিরিয়াল কিলার, চোরাচালানকারী ডাকাত হওয়া সত্ত্বেও ‘সেলিব্রিটি’র মর্যাদা পেয়েছিলেন। তিনি যেসব মহিলাদের হত্যা করতেন তাঁদের বিকিনি পরিহিত অবস্থায় পাওয়া যেত। তাই তাঁর আরেক নাম ছিল ‘বিকিনি কিলার’। তাঁর জীবন নিয়ে চারটি জীবনী গ্রন্থ, তিনটি তথ্যচিত্র, ম্যায় অর চার্লস (২০১৫) নামে বলিউড মুভি, নেটফ্লিক্স সিরিজ ‘দ্য সার্পেন্ট’ (২০২১) নির্মিত হয়েছে। এতেই তাঁর জনপ্রিয়তার বহর বোঝা যায়।

শোভরাজ পালানোর জন্য অসুস্থতার ভান করতেন। দশটি চুরি করা পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন। পর্যটকদের প্রতারিত করতে ট্যুর গাইড, রত্নবিক্রেতা বা মাদক বিক্রেতার ভেক ধরতেন। তিনি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য প্রকৃত পাসপোর্ট ধারককে হত্যা করতেন। ভারত, নেপাল, আফগানিস্তান, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স জুড়ে ছিল তাঁর গতিবিধি। এক কথায় চার্লস শোভরাজ ছিলেন নামকরা ঠগ।

ঠক বা ঠগ একই কথা। যারা ছলনা করে তাদের ঠক বলে। ব্রিটিশ আমলে ঠগ বা ঠগী নামে এক দস্যু সম্প্রদায় ছিল। এরা বণিক বা তীর্থযাত্রী সেজে, ছদ্মবেশে পথিকদের সঙ্গে মিশে, সুযোগ বুঝে পথিকের গলার রুমাল বা অন্য কোনও ফাঁস জড়িয়ে হত্যা করত এবং সর্বস্ব লুঠ করত। ১৮৩০ সালে ক্যাপ্টেন স্লীম্যানের নেতৃত্বে বিশেষ ‘ঠগী পুলিশ’ দিয়ে এই ‘ঠগী’ খুনি ডাকাতদের নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল।

ছল, কপট দু’টি কাছাকাছি শব্দ। দু’টোর একটাই অন্তর্নিহিত অর্থ, মিথ্যা বা অসত্য। ছলনা, কপটতা, শঠতা, চাতুরী সবই প্রতারকের বিশেষ গুণ। চাতুরী কথাটির এসেছে চতুর কথা থেকে। চতুর অর্থে সাধারণত চালাক ব্যক্তিকে বোঝায়। শঠ শব্দের আর একটি অর্থ আছে ‘যে নায়ক মুখে পত্নীকে বাহ্য ভালোবাসা জানিয়ে অন্তরে অন্য কাউকে ভালোবাসে।’ প্রতারকদের এটা প্রধান গুণ। মুখে বলবে এক, কাজে করবে আর এক। তাদের মুখের কথা বিশ্বাস করলে ঠকতে হবেই।

এই প্রসঙ্গে আমরা একটা কথা খুব শুনি, তা হল চিটিংবাজ। চিটিংবাজ কোনও বাংলা শব্দ নয়। ইংরাজি ‘চিটিং’ (Cheating) শব্দের সঙ্গে বাংলা ‘বাজ’ শব্দ যুক্ত হয়ে এই শব্দবন্ধ তৈরি হয়েছে। ইংরাজি চিটিং শব্দের অর্থ প্রতারণা। আর বাংলা ‘বাজ’ শব্দের অর্থ পটু, দক্ষ, অভ্যস্ত। এগুলি অবশ্য নিন্দাসূচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন চালবাজ, ফুর্তিবাজ, মামলাবাজ ইত্যাদি। এলাকাতে কেউ কথার খেলাপ করলে বা অন্য কোনও ভাবে ঠকালে তার ‘চিটিংবাজ’ উপাধি মেলে। তাই প্রতারকদের আরেক নাম চিটিংবাজ।

‘বাজ’ অন্ত শব্দ একটি আছে ফেরেববাজ। যার অর্থও প্রবঞ্চক। ফেরেব কথার অর্থ প্রবঞ্চনা। ফেরেব কথাটি ফরাসি ফরেব কথা থেকে এসেছে। যার অর্থ প্রবঞ্চনা। ইংরাজিতে এর তুল্য শব্দ Fraud। তাহলে বোঝা যাচ্ছে প্রতারককে কত নামে ডাকা যায়। তেমনই প্রতারণার নানা কৌশল। এই মানুষ ঠকানোর কৌশলগুলো দেখব আগামী পর্ব গুলোতে।

তথ্যঋণ:

১) বাঙ্গালা ভাষার অভিধান শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস (দি ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস, দ্বিতীয় সংস্করণ) ২) উইকিপিডিয়া।

(ক্রমশ)

অলংকরণ – রাতুল চন্দরায়