(প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক ওটেনের নিগ্রহের ঘটনা নিয়ে কলম ধরেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তাঁর লেখায় কিছু তথ্য সংক্রান্ত বিভ্রান্তি রয়েই গিয়েছে। লিখেছেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।)
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক ওটেন নিগ্রহের ঘটনায় শুধুমাত্র বিবৃতি দিয়ে ক্ষান্ত হননি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘দ্য মডার্ন রিভিউ ’পত্রিকার এপ্রিল, ১৯১৬ সংখ্যায় ‘ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন টিচার্স’ শিরোনামে তাঁর লেখা সাত পাতার একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর গোটা দুনিয়ায় সুভাষচন্দ্র বসু, অনঙ্গমোহন দাম, সতীশচন্দ্র দে, কমলভূষণ বসুর প্রেসিডেন্সি থেকে বহিস্কারের খবরে চাঞ্চল্য পড়ে যায়। দ্য মডার্ন রিভিউ-এ বিশ্বকবির লেখাটি ৪১৬ থেকে ৪২২ পাতা জুড়ে ছাপা হয়। তবে ওই ঘটনার তারিখ ও ঘটনার সঙ্গে যুক্ত স্বদেশী ছাত্রদের নামের তালিকা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা।
বিশ্বকবি প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘটনার বিশদ খবর নিয়ে ওই নিবন্ধ লিখলেও সুভাষচন্দ্র বসু যে প্রত্যক্ষ ভাবে ঘটনাস্থলে ছিলেন না তা তাঁর গোচরে দ্রুত আসা হয়তো সম্ভব ছিল না। কারণ, সুভাষচন্দ্র বসু, অনঙ্গমোহন দামেরা তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ায় এই নিয়ে মুখ খোলেননি। তাছাড়া, তাঁকে প্রহার করতে হিন্দু হস্টেলের ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র অনঙ্গমোহন দাম যে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় সেদিন বুঝতে পারেননি ওটেনও। সুভাষচন্দ্র বসু তখন প্রেসিডেন্সির তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। কলেজের বেয়ারা বংশীলালের জবানবন্দির ভিত্তিতে ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র অনঙ্গমোহন দাম ও সুভাষচন্দ্র বসু কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজের গর্ভনিং বডির সভায় ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ ওই দুইজনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৬ সালের ২২ জানুয়ারি ডিরোজিও হলে নেতাজি জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে, ঘটনার ৮০ বছর পর বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে খারিজ করেন প্রেসিডেন্সি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
ওটেন নিগ্রহের ঘটনার তারিখ নিয়েও বিশ্বকবির লেখাকে ঘিরে বিভ্রান্তি রয়েছে। বিভ্রান্তি রয়েছে ওই ঘটনায় যুক্ত ছাত্রদের নামের তালিকা নিয়েও। বহু স্থানে ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ প্রেসিডেন্সিতে ওটেন নিগৃহীত হন বলে ছাপা হলেও খোদ রবীন্দ্র রচনাবলী (ষোড়শ খণ্ড)- সুলভ বিশ্বভারতী সংস্করণে ৬৬৬ পাতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক Edward Farley Oatein –এর বাঙালি ছাত্রদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের প্রতিবাদে ১৩ জানুয়ারি,১৯১৬ তারিখে কলেজের কিছু ছাত্র দ্বারা অধ্যাপক ওটেন প্রহৃত হন। ঘটনাটি সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটি সুভাষচন্দ্র বসু, অনঙ্গমোহন দাম, সতীশচন্দ্র দে ও কমলভূষণ বসুকে কলেজ হইতে বহিষ্কারের আদেশ দেন।’ বিশ্বকবির লেখা নিবন্ধে ওইদিনের ঘটনার তারিখ সম্পর্কে যেমন ধোঁয়াশা রয়েছে, তেমনি আর এক ছাত্র বিপিন দে যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তার নামেরও উল্লেখ নেই। অথচ আরও দুই ছাত্র, সতীশচন্দ্র দে ও কমলভুষণ বসুর বহিষ্কারের কথা উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কোনটা ঠিক ? এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্সি কলেজ কর্তৃপক্ষের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে প্রামাণ্য নথি হিসেবে ধরা যায়। পাশাপাশি, ৮০ বছর পর বহিষ্কার খারিজের সিদ্ধান্তকেও প্রামাণ্য নথি হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গত, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৬ প্রেসিডেন্সি কলেজের গর্ভনিং বডির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, ‘Subhas Chandra Basu and Ananga Mohan Dam be expelled from the college for taking a leading part in the assault of Professor Oaten’. সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গতি রয়েছে ৭ মার্চ, ১৯৯৬ প্রেসিডেন্সি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অমলকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা পত্রের। অনঙ্গমোহন দামের কন্যা শান্তা নন্দীকে চিঠি লিখে কলেজের তরফে জানানো হয়, ‘I, as Principal of the College, made a formal declaration that the expulsion order on Subhas Chandra Bose and Ananga Mohan Dam has been withdrawn and that we acknowledge both of them as illustrious students of Presidency College.’
অন্যদিকে কালি প্রসন্ন নাই Emotion and Attitude of Netaji Subhas Chandra Bose towards Emancipation of India from British Colonial Rule নিবন্ধে লিখেছেন, ‘Professor Oaten and some students eventuated on 15th February,1916 and a group of students including Subhas Chandra Bose decided to acquire the law in their own hands. When Oaten was come down the broad staircase from the 2nd floor, he was surrounded by the students who breech him with their sandals and dissolved from there, although Oaten was not able to identify the attackers but a bearer told he saw Subhas Chandra Bose and Ananga Dam among those were fled(Page-851)।
এদিকে হিন্দু হস্টেলের ছাত্র মণীন্দ্র মজুমদারের ঘর থেকে তল্লাসি চালিয়ে জনৈক এ. সুর-এর ডায়েরি পাওয়া যায়। ওই ডায়েরিতে ওটেন নিগ্রহের ঘটনায় অনঙ্গমোহন দামের নাম উল্লেখ থাকলেও সুভাষচন্দ্র বসুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। Making of the Political Consciousness within the Student Community of Bengal নিবন্ধে মৃগাঙ্ক মুখোপাধ্যায় উপরোক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে একথা লিখেছেন।
যদিও পরে ওটেন নিগ্রহের ঘটনার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে পড়ার প্রসঙ্গে জেল জীবনের সঙ্গী নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে খোদ নেতাজি লেখেন, ‘ওই গণ্ডগোলের সৎকর্মটি কে যে করেছিল ঠিক বুঝতে পারিনি। মনে হয়, ওই বাঙালটাই (অনঙ্গমোহন দাম) মেরেছিল’(নেতাজি সঙ্গ ও প্রসঙ্গ-নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)। সেই সময়ে প্রেসিডেন্সির আর এক ছাত্র স্বামী ওঁঙ্কারানন্দ বলেন, ‘মারটা তো দেন অনঙ্গমোহন দাম।’ তিনি ওটেন নিগ্রহের ঘটনায় যুক্ত বিপিন দে নামে আর এক ছাত্রের কথা উল্লেখ করেছেন। সতীশচন্দ্র দে ও কমলভূষণ বসু-র উল্লেখ কিন্তু সেখানেও নেই। পরবর্তীতে খোদ ওটেন বলেছেন যে, তিনি ওই ঘটনার সময় সুভাষকে দেখেননি।
ঘটনা পরম্পরা থেকে এটা স্পষ্ট, ব্রিটিশ পুলিশের কড়া নজর ছিল অনঙ্গমোহন দামের উপর। তা স্পষ্ট হয়ে যায় ওই ঘটনার মাস চারেক-এর মধ্যে অনঙ্গমোহন দামের গ্রেফতারির মধ্যে দিয়ে। কলকাতার ১ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে তাঁর লাইব্রেরি থেকে গ্রেফতার হয়ে চার বছর বন্দি জীবন কাটান অনঙ্গমোহন।
তথ্যবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। ইতিহাসের অতল গহ্বর হতে তুলে নিয়ে আসা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ছাত্র সমাজের প্রতিবাদের এক খন্ড চিত্র।
প্রতিবেদনের লেখক কে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই।