মুরারিপুকুর বোমা মামলার জেরে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি হিসেবে আন্দামান সেলুলার জেলে বন্দি হয়েছিলেন বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র কানুনগো, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়রা। বন্দি জীবনের অসহনীয় সেই যন্ত্রনা আরও বাড়িয়ে দিতো আন্দামানের জেলের বিখ্যাত সেই খাবার— রেঙ্গুন চালের ভাত ও মোটা রুটি ও বিচিত্র তরকারি। ‘দ্বীপান্তরের কথা’-য় বারীন পরে লিখেছিলেন, ‘‘কচুর গোড়া, ডাঁটা ও পাতা, চুপড়ি আলু, খোসা সমেত কাঁচা কলা ও পুঁইশাক, ছোট ছোট কাঁকড় আর ইন্দুরনাদি এক সঙ্গে সিদ্ধ করিয়া যে পরম উপাদেয় ভোজ্য প্রস্তুত হয়, তরকারীর বদলে তাহার ব্যবহার করিতে গেলে চক্ষে জল না আসে, বাঙলা দেশে এমন ভদ্রলোকের ছেলে এ দুর্ভিক্ষের বৎসরেও বড় বিরল।’’ তবে তার মধ্যেই বন্দি জীবনের একেবারে শেষ পর্বে রান্না করে খাওয়ার সুযোগ এসেছিল বিপ্লবীদের। তখন বোমা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আসামিরা সেলুলার জেলে একসঙ্গে বসতেন রান্নাবান্না করতে। রন্ধনপ্রণালী নিয়েও চলতো বিতর্ক। এরই মধ্যে একদিন হেমচন্দ্র তরকারির মধ্যে এক আউন্স কুইনাইন ফেলে সুক্তো রান্নার রেসিপি হাজির করলেন। সেই মজার গল্প শুনিয়েছেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ বইটিতে। তার আগে দেখে নেওয়া যাক, মুরারিপুকুরের বাগানবাড়িতে বাংলার প্রথম বোমা তৈরির কারিগরদের রান্নাবান্নার হাল-হকিকত।
উপেন্দ্রনাথ লিখেছেন,
…মাণিকতলার বাগানে যখন আশ্রমের সূত্রপাত হইল তখন সেখানে চারপাচ জনের অধিক ছেলে ছিল না। হাতে একটিও পয়সা নাই, ছেলেরা সকলেই বাড়ী ঘর ছাড়িয়া আসিয়াছে, সুতরাং তাহাদের মা বাপদের কাছ থেকেও কিছু পাইবার সম্ভাবনা নাই। অথচ ছেলেদের আর কিছু জুটুক আর নাই জুটুক, দুবেলা দু’মুঠো ভাত ত চাই ! দু একজন বন্ধু মাসিক কিছু কিছু সাহায্য করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন, আর স্থির হইল যে, বাগানে শাক সব্জীর ক্ষেত করিয়া বাকি খরচটা উঠাইয়া লওয়া হইবে । বাগানে আম, জাম, কাঁঠালের গাছও যথেষ্ট ছিল। সেগুলা জমা দিয়াও দু দশ টাকা পাওয়া যাইবে। আর আমাদের খাইতেও বেশী খরচ নয়— ভাতের উপর ডাল আর একটা তরকারী। অধিকাংশ দিনই আবার ডালের মধ্যেই দুই চারিটা আলু ফেলিয়া দিয়া তরকারীর অভাব পুরাইয়া লওয়া হইত। সময়াভাব হইলে খিচুড়ীর ব্যবস্থা। একটা মস্ত সুবিধ৷ হইল এই যে, বারীন তখন ঘোরতর ব্রহ্মচারী। মাছের অংশ বা পেঁয়াজের খোসাটি পর্যন্ত বাগানে ঢুকিবার হুকুম নাই; তেল, লঙ্কা একেবারেই নিষিদ্ধ । সুতরাং খরচ কতকটা কমিয়া গেল ।
উপার্জ্জনের আরও একটা পথ বারীন্দ্র আবিষ্কার করিয়া ফেলিল— হাঁস ও মুরগী রাখা। কতকগুলা হাঁস ও মুরগী কেনাও হইয়াছিল ; কিন্তু দেখা গেল যে, তাহাদের ডিম ত পাওয়া যায় না; অধিকন্তু তাহাদের সংখ্যা দিন দিন কমিতেছে। কতক শেয়ালে খায়, কতক বা লোকে চুরি করে। অধিকন্তু আমাদের পাড়াপড়শীদের আমাদের বাগানে মুরগী রাখা সম্বন্ধে বিষম আপত্তি। একদিন একজন হাড়ি তাড়ী খাইয়া আসিয়া হিন্দুধর্ম্মের পক্ষ হইতে দুই ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়া মুরগী পালনের যে রকম ভীষণ প্রতিবাদ করিয়া গেল, তাহাতে তাড়াতাড়ি মুরগী কয়টাকে বেচিয়া ফেলা ছাড়া আর আমাদের উপায়ান্তর রহিল না। হাড়ি বাবুটীর নাম ভুলিয় গিয়াছি। তা’ না হইল ব্রাহ্মণসভায় লিখিয়া তাঁহাকে একটা উপাধি জোগাড় করিয়া দিতাম।
আমাদের বাজে খরচের মধ্যে ছিল চা। ওটা না থাকিলে সংসার নিতান্তই ফিকে ফিকে, অনিত্য বলিয়া মনে হইত। বিশেষতঃ বারীন চা বানাইতে সিদ্ধহস্ত। তাহার হাতের গোলাপী চা, ভাঙ্গা নারিকেলের মালায় ঢালিয়া চক্ষু বুজিয়া তারিফ করিতে করিতে খাইবার সময় মনে হইত, ভারত উদ্ধারের যে কয়টা দিন বাকি আছে, সে কয়টা দিন যেন চা খাইয়াই কাটাইয়া দিতে পারা যায়।
প্রথম দিনেই বারীন আইন জাহির করিয়া দিল যে, নিজে রাঁধিয়া খাইতে হইবে। এক আধ জন ত রাঁধিবার ভয়ে বাগান ছাড়িয়া পলাইয়া গেল; কিন্তু তা বলিয়া বাগানের ভিতর ত আর বাহিরের লোককে ঢুকিতে দেওয়া যায় না – বিশেষতঃ পায়সার অভাব। কিন্তু চিরদিন বাড়ীতে মায়ের হাতের আর মেসে ঠাকুরের হাতের রান্না খাইয়া আসিয়াছি। সাধুগিরির সময় ভিক্ষা করিয়া যা খাইয়াছি তাও পরের হাতের রান্না। আজ এ আবার কি বিপদ ! পালা করিয়া প্রত্যহ দুই জনের উপর রান্নার ভার পড়িল। সুতরাং আমাকেও মাঝে মাঝে রন্ধন-বিদ্যার নিগূঢ় রহস্য লইয়া নাড়াচাড়া করিতে হইত। কিন্তু ব্রাহ্মণের ছেলে হইলেও ও বিদ্যাটা কখনও বড় বেশী আয়ত্ত করিয়া উঠিতে পারি নাই। থালা, ঘটী, বাটীর নাম গন্ধ বাগানে বড় বেশী ছিল না প্রত্যেকের। এক একটা নারিকেল মালা আর একখানা করিয়া মাটীর সানকি ছিল; তাহাই আহারাদির পর ধুইরা মুছিয়া রাখিয়া দিতে হইত।
বাংলায় এমনকি ভারতের মধ্যে প্রথম বোমা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হয়ে শুরুতে আলিপুর জেলে বন্দি হয়েছিলেন এই যুবকেরা। তারপর তাঁদের কয়েকজনকে পাঠানো হয় দ্বীপান্তরে— আন্দামানের সেলুলার জেলে। ভয়ঙ্কর সেই বন্দি জীবনের শেষ পর্বে মিলল কিছুটা ছাড়। নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাওয়ারও সুযোগ পেলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা। আর সেই বোমার যুগে যারা ইংরেজ সরকারকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন, তারাই সেলুলার জেলে বসে শত অত্যাচারের মধ্যেও কখনও কখনও মেতে গিয়েছেন রসিকতায়। ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’য় উপেন্দ্রনাথ শুনিয়েছেন তেমনই দিনগুলির কথা।
… নিজের হাতে রাঁধিবার অধিকার পাইয়া প্রত্যহ কচুপাতা সিদ্ধ খাইবার দায় হইতে কতকটা অব্যাহতি পাইলাম । সঙ্গে সঙ্গে কঠিন পরিশ্রমের হাতও এড়াইলাম। বারীন্দ্রকে বেতের কারখানার তত্ত্বাবধানের ভার দেওয়া হইল হেমচন্দ্রকে পুস্তকাগারের অধ্যক্ষ করা হইল আর আমি হইলাম ঘানি ঘরের মোড়ল !
প্রাতঃকালে ১০ হইতে ১২ টার মধ্যে রন্ধন ও আহারাদি শেষ করিয়া লইবার কথা, কিন্তু ঐ অল্প সময়ের মধ্যে সব কাজ সারিয়া লওয়া অসম্ভব দেখিয়া আমরা সাধারণ ভাণ্ডারা (পাকশালা) হইতে ভাত ও ডাল লইতাম ; শুধু তরকারিটা নিজেদের মনোমত রাধিয়া লইতাম। রন্ধন বিদ্যায় হেমচন্দ্রের ওস্তাদ বলিয়া নামডাক ছিল। প্রকৃত পক্ষে মাংস, পোলাও প্রভৃতি নবাবী খানা তিনি বেশ রাধিতে পারিতেন, তবে সোজাসুজি তরকারি রাধিতে আমাদের চেয়ে বেশি পণ্ডিত ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। একদিন একটা মোচা পাইয়া বহুকাল পরে মোচার ঘণ্ট খাইবার সাধ হইল। কিন্তু কি করিয়া রাধিতে হয় তাহাত জানি না। মোচার ঘণ্ট রাধিবার জন্য যে প্রকাণ্ড কনফারেন্স বসিল তাহাতে রন্ধন প্রণালী সম্বন্ধে কাহারও সহিত কাহারও মত মিলিল না। বারীন্দ্র বলিল —“আমার দিদিমা হাটখোলার দত্তবাড়ীর মেয়ে এবং পাকা রাধুনী সুতরাং আমার মতই ঠিক,” হেমচন্দ্ৰ বলিল— আমি ফ্রান্সে গিয়ে ফরাসী রান্না শিখে এসেছি, সুতরাং আমার মতই ঠিক।” আমাদের সব স্বদেশী কাজেই যখন বিদেশী ডিপ্লোমার আদর অধিক তখন আমরা স্থির করিলাম যে মোচার ঘণ্ট রান্নাটা হেমদাদার পরামর্শ মতই হওয়া উচিত। আমি গম্ভীর ভাবে রাধিতে বসিলাল, হেমদা কাছে বসিয়া আরও গম্ভীর ভাবে উপদেশ দিতে লাগিলেন। কড়ার উপর তেল চড়াইয়া যখন হেমদা পেঁয়াজের ফোড়ন দিয়া মোচা ছাড়িয়া দিতে বলিলেন তখন তাঁহার রন্ধন বিদ্যার ডিপ্লোমা সম্বন্ধে আমারও একটু সন্দেহ হইল। মোচার ঘণ্টে পেঁয়াজের ফোড়ন কি রে বাবা? এ যে বেজায় ফরাসী কাণ্ড! কিন্তু কথা কহিবার উপায় নাই । চুপ করিয়া তাহাই করিলাম । মোচার ঘণ্ট রান্না হইয়া যখন কড়া হইতে নামিল তখন আর তাহাকে মোচার ঘণ্ট বলিয়া চিনিবার উপায় নাই। দিব্য তোফা কালো রং আর পেঁয়াজের গন্ধ।
খাইবার সময় হাসির ধূম পুড়িয়া গেল। বারীন্দ্র বলিল— “হাঁ, দাদা একটা ফরাসী chef de cuisine বটে। দিদিমা আমার এমনটী রাধিতে পারিত না।” হেমদা হটবার পাত্র নহেন। তিনি বলিলেন – “ঐ ত – তোমাদের রোগ! তোমারা সবাই দিদিমা-পন্থী। দিদিমা যা করে গেছেন তা আর বদলাতে চাও না।” মোচার ঘণ্ট যে দিন রন্ধনের গুণে মোচার কাবাব হইয়া দাঁড়াইল, তাহার দিন কতক পরে একবার সুক্ত রাধিবার প্রস্তাব উঠিয়াছিল। কিন্তু সুক্ত রাধিবার সময় কি কি মসলা দিতে হয় সে বিষয়ে মতদ্বৈধ রহিয়া গেল। হেমদা বলিলেন যে তরকারীর মধ্যে এক আউন্স কুইনাইন মিকচার ফেলিয়া দিলেই তাহা সুক্ত হইয়া যায়। আমাদের দেশের যে সমস্ত নবীনা গৃহিণীরা পাঁচ খণ্ড পাকপ্রণালী কোলে করিয়া রাধিতে বসেন তাঁহারা সুক্ত রাধিবার এই অভিনব প্রণালীটা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন। ব্যাপারটা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এই হদ্দ ম্যালেরিয়া-প্রপীড়িত দেশে তাঁহারা একাধারে আহার ও পথ্যের আবিষ্কার করিয়া অমর হইয়া যাইতে পারিবেন। দাদারও জয় জয়কার পড়িয়া যাইবে।
(বানান অপরিবর্তিত)
(অলঙ্করণ -রাতুল চন্দ রায়)
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]
স্বাধীনতা সংগ্রামী দের সম্পর্কে বেশ অজানা কিছু তথ্য জানলাম। যেহেতু সেলুলার জেল খুব ভালোভাবে ঘুরে দেখা আছে বলে এঁদের সবাইকেই চিনতে পারলাম। বেশ ভালো লাগলো।