(তরবারি হাতে লড়াই কিংবা তির ছুড়ে শত্রুকে ঘায়েল করার দিন কবেই শেষ। কাল যা ছিল ‘আধুনিক অস্ত্রসম্ভার’ সেখানেও পড়েছে ইতিহাসের ধুলো। রণাঙ্গনে এখন ক্ষিপ্র, ছোট অতি আধুনিক সমরাস্ত্রের চাহিদা তুঙ্গে। শত্রু শিবিরের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে মেঘনাদের মতো আচমকা হামলা ছোট্ট ড্রোনের। আর তাতেই কাৎ বাঘা বাঘা ট্যাঙ্কবাহিনী। যুদ্ধের ময়দানে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা নিতে চলেছে ড্রোন। লিখেছেন সুবীর বিশ্বাস।)
রাশিয়া তখনও ইউক্রেনের মারিয়ুপোলের দখল নিতে পারেনি। ১১ই মার্চ, ২০২২। রুশ বংশীয় ডনবাস অঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে নিয়ে মেজর জেনারেল আন্দ্রেই কালাসনিকভ চলেছেন।
—‘‘ও…ওরে হাল্লা রাজার সেনা,
তোরা যুদ্ধ করে করবি কী, তা বল।’’
আজভ সাগরের উত্তর উপকুলে কালমিয়াস নদীর মোহনা। বিশাল ট্যাঙ্ক বাহিনী এগিয়ে চলেছে। দাম্ভিক জেনারেলের মনে বিরাট আশা, কয়েকদিনেই ইউক্রেন দখল করবেন। ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেবেন দেশপ্রেমিকদের সব প্রতিরোধ। এবার নিশ্চয় পুতিন তাকে ডুমায় পাঠাবেন। অহংকারী কালাসনিকভ নিজেকে “মরু শৃগাল” রমেলের সঙ্গে তুলনা করেন।
২-৩° সেন্টিগ্রেডে নদীতীর সেদিন ছিল রৌদ্রস্নাত। নীল আকাশে পাখিরা উড়ছে। গির্জায় ঘন্টা বাজছে। অবশ্য কেউই জানে না “For whom the bell tolls”. কেউ লক্ষ্য করেনি আকাশের কালো বিন্দুগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত! নিখুঁত লেজার নিশানায় বোমাগুলি একের পর এক রাশিয়ার টি-৯০ ট্যাঙ্কগুলি ধ্বংস করে দেয়। তুরস্কের ও ইউক্রেনে যৌথ উদ্যোগে তৈরি বেরাক্তার টিবি২ ড্রোনের আক্রমণ ঠেকানোর কোনও অস্ত্র সেদিন রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ছিল না।
কখন, কীভাবে, কোন ট্যাঙ্কে কালাসনিকভ মারা গিয়েছিলেন, সঠিক তথ্য রাশিয়া তাঁর পরিবারকে দিতে পারেনি। কিন্তু মৃত জেনারেলের কপালের ভাঁজগুলো তখনও বেশ স্পষ্ট ছিল।
হ্যাঁ, এ ভাজ পড়েছে সারা বিশ্বের তাবড়-তাবড় সমরনায়কদের কপালে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আগের সব হিসাব নিকেশ উল্টে দিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই ট্যাঙ্ক বিমানবহরের মিথ ভেঙে চুরমার। স্বমহিমায় উদ্ভাসিত এখন ড্রোন। অতি ছোট, কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর এই বাজপাখি যেন যুদ্ধজয়ের নির্নায়ক হাতিয়ার। রাশিয়ার কিংবদন্তি আকাশরোধী ব্যবস্থাও প্রথমদিকে দিশেহারা হয়েছিল।
গোটা দুনিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিভিন্ন ধরনের ড্রোন তৈরির কাজে। চিন তো একধাপ এগিয়ে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মত ড্রোনবাহী রণপোত বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। অনেক দেরিতে শুরু করলেও এখন ভারতের অগ্রগতি সন্তোষজনক।
আধুনিক ড্রোনগুলি বিভিন্ন ধরনের। এর প্রযুক্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে আমেরিকা। তাদের বড় ধরনের কমব্যাট ড্রোন প্রিডেটর মিলিটারি জগতে সুপরিচিত। এগুলি মেল (MALE— Medium Altitude Long Endurance) বা হেল (HALE— High Altitude Long Endurance) বিভাগের ড্রোন। আফগানিস্তানে আমেরিকা-যৌথ বাহিনীর চেয়ে বেশি জঙ্গি নিকেশ করেছে এই প্রিডেটর।
১৫ কিলোমিটার উচ্চতায় সর্বোচ্চ ৭৪০ কিমি /ঘণ্টা বেগে উড়তে পারে, আর ২০ ঘণ্টা একনাগাড়ে আকাশে থাকতে পারে। প্রধান অস্ত্র হল শূন্য থেকে ভূমিতে নিখুঁত নিশানায় ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ আর লেজার গাইডেড বোমা ফেলা। কৃত্রিম উপগ্রহ, জিপিএসের মাধ্যমে মাটিতে অবস্থিত বহু দুরের কন্ট্রোলরুম থেকে এগুলিকে চালানো হয়। এর মোটা ভায়ের নাম রিপার। একটু বেশি ভার বহন করতে পারে।
আমেরিকার আরেকটি হেল ড্রোন হল গ্লোব হক্। অসামরিক কাজেও সমান ভাবে দক্ষ। এর প্রধান কাজ ইসটার (ISTAR— Intelligence, Surveillance, Target Acquisition & Reconnaissance)। ১৮ কিলোমিটার উচ্চতা থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্যামেরায় বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সমস্ত তথ্য কন্ট্রোলরুমে পাঠিয়ে দেয়।
ইজরায়েল রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে। তাদের উল্লেখযোগ্য কমব্যাট ড্রোনগুলি হল, হেরন টিপি, হার্মেস ৪৫০, হার্মেস ৯০০। ১০০০ কিলোগ্রাম ওজন নিয়ে ১০ কিলোমিটার উপরে ৫২ ঘণ্টা শূন্যে থাকতে পারে হেরন। এটাও জিপিএস, কৃত্রিম উপগ্রহের যোগাযোগে কৃত্রিম মেধার সাহায্যে পূর্ব প্রোগ্রামভিত্তিক আঘাত হানতে সক্ষম। আমেরিকা, কানাডা, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও মরক্কো সবাই হেরন ড্রোন কিনেছে।
এর পরে রয়েছে চিন, রাশিয়ার মতো দেশগুলি— বিশেষত চিনের চেষ্টা ছিল সস্তায় ইউএভি (unmanned aerial vehicle) দিয়ে বিশ্বের ড্রোন বাজারে আধিপত্য করা।
চিনকে অনেকই নকল মাস্টার বলে থাকে। এটা কিন্তু ড্রোনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমেরিকার প্রিডেটরের নকল হল চিনা মেল কমব্যাট ড্রোন সিএইচ-৪(CH-4)। আর হেল ইউএভি চিনের ডব্লিউ জেড ৭(WZ-7), এক্কেবারে আমেরিকার গ্লোবাল হকের নকল। আবার বহু দুরে বিমান আক্রমণে জন্য বিখ্যাত আমেরিকার বি-২ বোম্বার। ঠিক এর সমান্তরাল জিজে-১১ ড্রোন চিন বানিয়েছে, যা আমেরিকার সমরসম্ভারে নেই। যদিও রণাঙ্গনে চিনের এই ড্রোনগুলির কার্যকারিতা প্রমাণিত নয়। এ পর্যন্ত ১৬টি দেশে চিন প্রায় ২০০টি ড্রোন রফতানি করেছে। মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলিতে। রিপোর্ট কিন্তু বেশ কালিমালিপ্ত। চিনা সমরাস্ত্রের এক নম্বর ক্রেতা হল পাকিস্তান। অন্যদের মতো পাকিস্তানেরও অভিযোগ, অনুশীলনের সময় অর্ধেক চিনা ইউএভি ক্র্যাশ করেছে আর যন্ত্রাংশের অভাবে অনেক ড্রোন বসিয়ে দিতে হয়েছে। এখন পাকিস্তান, তুরস্কের দিকে ঝুঁকছে। তারা ইতিমধ্যেই বেরাক্তার টিবি-২ আমদানি করেছে। এটি একটি মেল কমব্যাট ড্রোন। ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রিত টিবি-২ আকাশে ৮ কিলোমিটার উপরে প্রায় ২৭ ঘণ্টা উড়তে পারে। ড্রোনটি লিবিয়া, সিরিয়া, নাগোর্ন কারাবাক সংঘাতে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছে। তবে এইসব দেশের কোনও আকাশ-সুরক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় বেরাক্তার টিবি-২ কিছুটা ফাঁকা মাঠে গোল করতে পেরেছে। আবার ইউক্রেনে এটি রাশিয়ার বহু ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, সাঁজোয়া গাড়ি ধ্বংস করেছে। সেখানেও কিন্তু আমেরিকা ও ন্যাটোর নিখুঁত তথ্যচিত্র ছাড়া সাফল্য সম্ভব ছিল না। রফতানি বাজার ধরার জন্য তুরস্ক বিভিন্ন ভিডিও ছড়িয়ে এর যতটা প্রচার করছে, ততটা উন্নত মোটেই নয়। তবে এখন নতুন ড্রোনাচার্য এসেছে, এটি হল সোয়ার্ম ড্রোন। এক ঝাঁক কামাকাজি বা সুইসাইড ড্রোন। আগে থেকে প্রোগ্রাম করা কৃত্রিম মেধাচালিত, এরা সোজা লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত করে। আবার কোনও একটি মাদার যুদ্ধবিমান থেকেও এরা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সোয়ার্ম ড্রোন করছে।
অনেক পরে নেমে ভারতও খুব একটা পিছিয়ে নেই। ভারতের রুস্তম-২ বা তাপস বিএইচ-৪ একটি মেল ড্রোন। এটি ৮.৫ কিলোমিটার উচ্চতায় একনাগাড়ে ১৮ ঘণ্টা ভেসে থাকতে পারে। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি কাভেরি জেট ইঞ্জিনচালিত ঘটক কমব্যাট ড্রোন দ্রুতই তৈরি হবে। এছাড়া বেরাক্তার টিবি-২ এর মত আর্চার কম্ব্যাট ইউএভি কিছুদিনের মধ্যেই আকাশে ডানা মেলবে। সুতরাং ভারত দৌড় শুরু করেছে পিছন থেকে। অন্যদের ধরে ফেলতে হয়তো আর একটু সময় লাগবে।