হারানো আংটিটা হীরের। তবে দাম খুব একটা বেশি নয়। তখন কিনতে লেগেছিল হাজার তিনেক টাকা। সে আজ থেকে বছর পঁচিশ আগে। এখন তার মূল্য বড়জোর হাজার পনের টাকা হবে। তার থেকে এক পয়সাও বেশি নয়। তবে প্রশ্নটা এখানে টাকা-পয়সার নয়, প্রশ্নটা অন্যখানে। কতকটা ডেসডিমনার উপহার পাওয়া রুমালের মত। মূল্যের চেয়ে যা অমূল্য। কারণ, আংটিটা মান্যতা ম্যাডামের স্মৃতিবিজড়িত। ভালবাসার উপহার।
তখনো অপূর্বর সাথে বিয়ে হয়নি মান্যতা ম্যাডামের। বিয়ের কথাবার্তা চলছে। তখন অপূর্বর বাবা মা এসেছিলেন ওদের রিপন স্ট্রিটের বাড়িতে। তাঁরা হবু বৌমার মুখ দেখে চুনি বসানো হীরের আংটিটা উপহার হিসেবে পরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। সেই থেকে মান্যতা ম্যাডামের হাতে শোভাবর্ধন করে আসছে আংটিটা। একবারও হাতছাড়া হয়নি তাঁর।
কিন্তু সেই আংটিটার যে এমন দশা হয়েছে তার কোন খেয়াল ছিল না মান্যতা ম্যাডামের। সেদিন দুপুরবেলায় পার্ক স্ট্রিটের এক অভিজাত হোটেলে জরুরি কনফারেন্সে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তাঁর পিএ প্রকাশ মিত্র বসেছিলেন পাশে। তিনিই প্রথম ডিটেক্ট করলেন ব্যাপারটা। ম্যাডামের বামহাতের মধ্যমা আঙুল শূন্য দেখে সহসা বেআক্কেলের মত অশোভনীয় কথাটা বলে বসলেন—ম্যাডাম! আপনার হাতে হীরের আংটিটা দেখছি না।
ব্যস, ওই এক কথাতেই কনফারেন্সের বারোটা বেজে গেল। আড়নয়নে আভরণহীন আঙ্গুলটা দেখে ম্যাডাম স্তব্ধ হয়ে গেলেন কিছুক্ষণ। তারপর লাউঞ্জে বসে থাকা সমবেত অফিসারদের উদ্দেশ করে বললেন, আজ তাহলে এই পর্যন্ত। থ্যাংস টু অল।
বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে কনফারেন্স হল ছেড়ে বার হয়ে গেলেন ম্যাডাম। সোজা গিয়ে উঠলেন গাড়িতে। সাথে সাথে গাড়ি ছেড়ে দিল। আর সবার রাগ গিয়ে পড়ল প্রকাশ মিত্রের উপর। তখন তিনি জাতীয় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলেন। সকলে একযোগে ছেঁড়াছিঁড়ি শুরু করলেন তাঁকে।
—মশাই! আপনি হলেন যত নষ্টের গোড়া। কি দরকার ছিল ভালবেসে ওরকম একটা কথা বলার? বলার আর সময় পেলেন না ?
ব্যাপারটা কিছুটা ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’র মতো হয়ে গেল। ম্যাডাম হলেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি অত্যন্ত সৎ। তাঁর বিরুদ্ধে আঙুল তুলে বলার মতো খুঁজে পাওয়া যাবে না কাউকে। তাই তাকে মান্যতা করে চলে সকলে। সেদিন পুলিশের বড়কর্তাদের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছিলেন তিনি। যাতে শহর ও শহরতলী এলাকায় অপরাধমূলক কাজকর্ম কম হয়। যাতে পুলিশ প্রশাসনের লোকজন আর একটু বেশি সক্রিয়, সজাগ হয়। কারণ, সামনে ইলেকশন। এখন অপরাধমূলক কাজকর্ম বেড়ে গেলে মানুষজনের মনে তার প্রভাব পড়বে। অযোগ্য প্রশাসক হিসাবে তারা দলকে চিহ্নিত করতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব করবে না। কিন্তু কোথা থেকে কী হয়ে গেল। মিটিং শেষ হবার আগেই তার প্রভাব পড়ল খোদ পুলিশমন্ত্রীর সাথে। একে ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে ?
আংটি হারানোর গল্প শুনে নগরপাল তো ভয়ে তটস্থ। এই বুঝি তাঁর চাকরি যায়। কি করা যায়, কি করা যায়, ভেবে রাত্রিবেলা ফোনে ধরলেন ম্যাডাম বোসকে। ফোন ধরেই ম্যাডাম বললেন— হ্যাঁ বিজয়! ভেবেছিলাম আংটিটা বোধহয় বাড়িতেই আছে। কিন্তু খুঁজে দেখলাম নেই।
—কিচ্ছু ভাববেন না ম্যাডাম! অভয় দিয়ে নগরপাল বললেন, যে করেই হোক, আংটি আমরা খুঁজে বার করবই। এবং তা সাত দিনের মধ্যেই। শুধু আপনি একটা কমপ্লেন লিখে পাঠিয়ে দিন।
— ‘ওকে.’ বলে ফোন রেখে দিলেন ম্যাডাম।
ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলে মনে শান্তি পাচ্ছিলেন না নগরপাল। তিনি ফোন করে কড়েয়া থানার বড়বাবু শুভজিৎ সেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁর নির্দেশ মতো থানার বড়বাবু আধঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে গেলেন ম্যাডামের বাড়িতে। এবং তাঁর আদেশে জুতো খুলে ঢুকে পড়লেন ড্রইংরুমে। বসে পড়লেন মখমলের গদি আঁটা চেয়ারে। হাত বাড়িয়ে কমপ্লেনটা নিলেন ম্যাডামের হাত থেকে। তারপর চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, ম্যাডাম! আপনারা এই বাড়িতে ক’জন থাকেন?
—থাকি আমরা দুজনে। আমি আর আমার স্বামী। ছেলে আমার থাকে আমেরিকায়।
—না, মানে কোন কাজের মেয়ে-টেয়ে ?
—হ্যাঁ, কাজের একটা মাসি আছে। নাম সুনীতি। সে ট্রেনে করে সকালবেলা আমাদের বাড়িতে আসে, সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে যায়। ওর স্বামীও মাঝেমধ্যে ওর সাথে দেখা করতে এখানে আসে। এ ছাড়া গার্ড, ড্রাইভার, মালিরা আছে। তবে তারা কেউ দোতালায় ওঠে না।
—সুনীতিদের বাড়ি কোথায় ?
—সুনীতি থাকে ক্যানিংয়ে।
—আপনি আংটিটা কোথায়, কিভাবে……?
বড়বাবুর প্রশ্ন শেষ হবার আগেই ম্যাডাম বললেন, হাত থেকে আংটিটা খুব একটা খুলতাম না। খুব ময়লা ধরেছিল আংটিতে। অনেকদিন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়নি। ভাবলাম একটু সাফ করে নি। একথা ভেবে হাত থেকে আংটিটা খুলে ছিলাম। সে এক সপ্তাহ আগের কথা। তারপর আর আংটির কথা মনে নেই।
—সুনীতির স্বভাব-টভাব কেমন?
বড়বাবু বেশ উদ্বেগের সাথে জানতে চাইলেন।
—খুব ভাল। গত দশটা বছর ও আমাদের কাছে আছে। খারাপ কিছু পাইনি।
—আংটিটা দেখতে কেমন ছিল ?
—আংটিটা ছিল হীরের। চারদিকে গোল করে রংবেরঙের চুনি বসানো।
—আংটিটা কোথা থেকে বানিয়েছিলেন ম্যাডাম?
—আংটি বানানোর আর সময় হয়নি শ্বশুর শাশুড়ির। তাঁরা গড়িয়াহাটের অঞ্জলি থেকে কিনে নিয়ে এসেছিলেন আংটিটা। তার ক্যাশমেমো আমার কাছে আছে। তাতে আংটির সাইজ, দাম সব লেখা আছে। আমি আপনাকে দেখাচ্ছি।
একথা বলে ম্যাডাম গিয়ে ঢুকলেন বেডরুমে। কিছুক্ষণ পরে ক্যাশমেমোটা খুঁজে নিয়ে এসে বড়বাবুকে দেখালেন। বড়বাবু সেটা আগাগোড়া ভাল করে দেখলেন। প্যাডে নোট করে রাখলেন তারপর ম্যাডামের সওয়াল মতো রাজ্যের নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেন। আলোচনা শেষে বিদায়কালে বড়বাবু বললেন, ঠিক আছে ম্যাডাম! আমি তাহলে আসছি। আমরা সর্বতভাবে চেষ্টা করে দেখছি, কিভাবে আংটিটা উদ্ধার করা যায়।
এই ঘটনার সপ্তম দিনে সকালের কাগজ দেখে চমকে উঠলেন ম্যাডাম। প্রথম পাতার নীচের দিকটায় বড় বড় হরফে লিখেছে, অবশেষে উদ্ধার হল পুলিশ মন্ত্রীর চুরি যাওয়া আংটি। খবরে প্রকাশ…..।
এক নিঃশ্বাসে আদ্যোপান্ত খবরটা পড়ে ফেললেন ম্যাডাম। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারলেন না খবরের কাগজের খবরের সত্যতা। ওরা আসল-নকল সব একাকার করে দিতে ওস্তাদ। আসল ঘটনাটা জানার জন্য তাই তিনি রিং করলেন নগরপালকে। নগরপাল বললেন— আপনাকে সারপ্রাইজ দেব বলেই কথাটা বলিনি ম্যাডাম! তা কড়েয়া থানার বড়বাবু এখনো পৌঁছয়নি আপনার কাছে? আংটিটা নিয়ে আপনার ওখানে…।
কথা শেষ করতে পারলেন না নগরপাল। কড়েয়া থানার বড়বাবু এসে ঢুকলেন ম্যাডামের বাড়িতে। তা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ম্যাডাম নগরপালকে বললেন— এইমাত্র থানার বড়বাবু এসে ঢুকলেন আমার বাড়িতে। আমি ওর কাছেই শুনে নিচ্ছি পুরো ব্যাপারটা। একথা বলে ফোনটা রেখে দিলেন ম্যাডাম।
আংটিটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখলেন ম্যাডাম। না, কোথাও কোন অমিল নেই এতটুকু। এটাই তার খোয়া যাওয়া আংটি। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আংটিটা আঙুলে পরে দেখলেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন— সাবাস বড়বাবু! ইট ইজ এ গ্রেট ডিটেকশন।
তারপর কিছু একটা ভেবে বড়বাবুকে শুধালেন, এই আংটিটা কি ফেরত নিয়ে যাবেন? মানে কেসের মাল তো, তাই জিজ্ঞেস করছি।
—না না ম্যাডাম! এর জন্য একদম চিন্তা করবেন না।
বড়বাবু অভয় দিয়ে বললেন, একটা জিম্মানামা করে রাখবো, ওতেই চলে যাবে।
বড়বাবুর কথায় খুব সন্তুষ্ট হলেন ম্যাডাম। প্রাণটা ভরে উঠল তাঁর। চোখদুটো চকচক করে উঠল। পরম তৃপ্তিতে মুখ বুজে নিঃশব্দে হেসে ফেললেন তিনি। আংটিটা হাতের মুঠোয় নিতে হৃদয়টা ভরে উঠল। এই কাজের জন্য বড়বাবুকে কিছু একটা ইনাম দেওয়া দরকার। কিন্তু তার আগে মিষ্টিমুখ করালে ক্ষতি কি? একথা ভেবে বড়বাবুর জন্য ফ্রিজ থেকে গোটা ছয়েক মিষ্টি বার করে আনলেন তিনি। বড়বাবু তা খেতে খেতে বললেন, আপনার কাজের মেয়ে…।
সে তো গত এক সপ্তাহ ধরে আসছে না। কি জানি কোন বিপদে পড়েছে কিনা; কোনও খবর পাইনি তার।
—বিপদ আর কি? রসগোল্লা চিবাতে চিবাতে পরম তৃপ্তিতে বড়বাবু বললেন— কোন মুখে সে আর এ বাড়িতে আসবে ?
—তার মানে?
ম্যাডাম উৎসাহিত হলেন জানতে।
—মানে ওর স্বামীর পকেট থেকে আংটিটা পাওয়া গেছে। তাই বোধহয় লজ্জা পেয়েছে। কোন মুখে সে আর আপনার বাড়িতে আসবে ?
—ওর স্বামী এখন কোথায় ?
—আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আছে ম্যাডাম।
বড়বাবুর মুখে ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ম্যাডাম! সুনীতি যে ভিতরে ভিতরে এরকম তা তো তিনি জানতেন না। ওর ভরসায় সারা বাড়িটা ফেলে রেখে গেছেন এতদিন। কে জানে, আর কি কি জিনিস সরিয়েছে সুনীতি!
ম্যাডামকে চুপচাপ থাকতে দেখে খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন বড়বাবু। সুনীতির স্বামীকে অ্যারেস্ট করা কি ঠিক হয়নি তাহলে! কাউকে না ধরে শুধু আংটিটা উদ্ধার করলেই বোধহয় ভাল হতো। এই সব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ তাহলে আসি ম্যাডাম! একটু তাড়া আছে। মুখ্যমন্ত্রী আসবেন আমাদের এলাকায়। একথা বলে বার হলেন বড়বাবু।
এ কাহিনীর পরিসমাপ্তি এখানে হলে ভাল হতো। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে গেল অন্য ভাবে। ঠিক নববর্ষের আগে ঘরদোর পরিষ্কার করতে গিয়ে হঠাৎ করে ড্রয়ারের মধ্যে ম্যাডাম পেয়ে গেলেন তাঁর খোয়া যাওয়া আংটিটা। যার মানে উদ্ধারকৃত আংটিটা আসলে তাকে কিনে এনে দিয়েছে থানার বড়বাবু। আর মিথ্যে অভিযোগে জেলের মধ্যে পচে মরছে সুনীতির স্বামী। এটা নিঃসন্দেহে অন্যায় কাজ। অবৈধ কাজ। কিন্তু একথা বলতে গেলে বিপদ। বিরোধীরা গলা চেপে ধরবে। উত্তর দেওয়ার কিছু থাকবে না। এই কাজের জন্য বড়বাবুকে সাসপেন্ড করলে সে আর এক বিপদ। তার পরিবার পরিজন না খেতে পেয়ে মরবে। তাছাড়া সে তো আগবাড়িয়ে নিজের ইচ্ছায় কাজটা করেনি। নিশ্চয়ই নগরপাল তাকে বলেছিল এই কাজটা করতে। শুধু অপরের ব্যাপারে দোষারোপ করে কি হবে? তিনি নিজেও তো কম দোষী নন। ঘরদোর ভালো করে খুঁজে না দেখে কেন তিনি চুরির অভিযোগ দায়ের করতে গেলেন? না বুঝে শুনে কেন তিনি সুনীতির স্বামীর সম্বন্ধে সন্দেহজনক কথাবার্তা বলতে গেলেন? এসব কথা ভাবতে ভাবতে একসময় মনস্থির করে ফোনে নগরপালকে ধরলেন। মিথ্যে করে বললেন, সুনীতি আমার কাছে এসেছিল। খুব কান্নাকাটি করছিল। যে কোন মূল্যে ওর স্বামীকে জেল থেকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করে দিন।