সেনেগালের নাগরিক ফাতমা সামুরা হলেন প্রথম মহিলা, যিনি বিশ্ব ফুটবল সংস্থা, ফিফা-র সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। ২০১৬ সালে তিনি ওই পদে বসার পরেই তৈরি হয়েছে ইতিহাস। ফাতমাই প্রথম অ-শ্বেতকায় এবং অ-ইউরোপীয়, যিনি ওই পদে বসেছেন। তাঁর থেকেই শুনে নেওয়া যাক, ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২-এর জন্য কতটা তৈরি কাতার। 

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’কে দেওয়া সাক্ষৎকারে সম্প্রতি ফাতমা জানিয়েছেন, ফুটবলের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও দেশ বিশ্বকাপ শুরুর বছরখানেক আগেই সমস্ত পরিকাঠামো সম্পূর্ণ করে ফেলেছে। মোট আটটি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ম্যাচগুলি হবে। তার মধ্যে ছ’টি স্টেডিয়াম সম্পূর্ণ তৈরি। ফিফা অনুমোদিত আরব কাপের খেলাও ওই স্টেডিয়ামগুলিতেই হয়েছে। ফলে বিশ্বকাপ শুরুর একবছর আগেই বোঝা গিয়েছে স্টেডিয়ামগুলি তৈরি। ফাতমা জানিয়েছেন, কাতার যে ভাবে বিশ্বকাপ সংগঠনের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে তাঁরা সন্তুষ্ট। প্রায় ২০ লক্ষ দর্শক আসবেন কাতারে। আয়তনে ছোট দেশ কাতার।  তবে ফাতমার মতে, সেখানে ফুটবলপ্রেমীদের জন্য কোনও সমস্যা হবে না।

ফাতমাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়েছেন, কাতারের স্টেডিয়াম, থাকার জায়গা ও ট্রেনিং গ্রাউন্ড বিশ্বমানের। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির অবকাশ রয়েছে। এই বিশ্বকাপের একটা বিশেষত্ব হল, একজন দর্শক খুব সহজে দু’টি খেলা পরপর দু’টি  স্টেডিয়ামে দেখতে পারবেন।  যাতায়াতের ব্যবস্থা আরও আধুনিক হলে একজন দর্শকের পক্ষে হয়তো তিনটি খেলা দেখাও সম্ভব হবে।  ফাতমা বলেন, ‘‘আমরা চাই কাতার বিশ্বকাপ দেখে দর্শকেরা যেন খুশি মনে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারেন। ’’ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, দর্শকের সুবিধার জন্য বিশ্বকাপ সংগঠকদের উদ্দেশে কি উপদেশ দিতে চান ? ফাতমার জবাব, ‘‘২০১৮ সালে রাশিয়া বিশ্বকাপে একটি নতুন জিনিস আমরা পেয়েছিলাম। সেটা হল, ফ্যান আইডি কার্ড। কিন্তু আজ পৃথিবী জুড়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল স্বাস্থ্য। তাই সংগঠকেরা যেন নজর রাখেন, যে সব ফুটবলপ্রেমী ওই সময় কাতারে যাবেন, তাঁদের যেন সম্পূর্ণ টিকা দেওয়া থাকে।  তাঁদের থাকার জায়গা,পরিবহণ ও স্টেডিয়ামে বসার জায়গা যেন সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে হয়।’’

কাতারে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্গতি সারা পৃথিবীতে একটি চর্চার বিষয়। মিডিয়া থেকে শুরু করে ফুটবল খেলোয়াড়েরা অভিযোগ করছেন, বিশ্বকাপের আয়োজন করতে গিয়ে কাতারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ বিবৃতি দিয়েছে, ফিফার কাজ শুধু কাতার ফুটবল আয়োজনের কথাই ভাবা নয়। যে শ্রমিকেরা ওখানে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতিও ফিফার নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। বিষয়টি ফিফা কী ভাবে দেখছে? ফাতমা বলেন, ‘‘২০১৬ সালে ফিফা নিজেদের আইনে অনেকগুলি সংশোধন করেছে। আইন সংশোধন করে বলা হয়েছে, ফিফা সকলের মানবাধিকার রক্ষার জন্য সচেষ্ট হবে। ফিফার সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবে আমার দায়িত্ব হল সেদিকে বিশেষ ভাবে নজর দেওয়া।’’ ফাতমার দাবি,‘‘ ফিফার প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফ্যান্তিনো বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। ২০১৬ সালে প্রথমবার কাতারে বিশ্বকাপের আয়োজন দেখতে যাওয়ার পর ইনফ্যান্তিনো মানবাধিকার (Human Rights) সংক্রান্ত একটি উপদেষ্টামন্ডলী তৈরি করেন। তাঁদের কাজ হল, মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রতিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখা। তদন্ত করে ফিফার কাছে রিপোর্ট পাঠানো। এঁরা আমাদের কাছে অনেকগুলি সুপারিশ করেছেন।  ২০১৭ সালের মধ্যে তার ৮৫ শতাংশ আমরা মেনে নিয়েছি এবং সেই অনুসারে কাজও চলছে।’’ 

ফিফার সেক্রেটারি জেনারেলের দাবি, মানবাধিকার লঙ্ঘন গোটা পৃথিবীরই সমস্যা। এমন কোনও দেশ নেই যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় না। যখন আফ্ৰিকার ছেলেমেয়েরা ভূমধ্যসাগর বা আটলান্টিক পেরিয়ে কাজ করতে যায় তাঁরা সবসময় প্রচুর সমস্যার মধ্যে পড়েন। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। ভিয়েনা কনভেনশনে প্রতিটি দেশ মানবাধিকার সনদের ব্যাপারে সহমত হয়েছিল। কিন্তু নিজের দেশে সেই সনদ কেউই সঠিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেনি। 

ফাতমার কথায়, ‘‘কাতার সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য প্রচুর কাজ করছে। বিশ্বকাপের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪০ হাজার পরিযায়ী শ্রমিক কাতারে সর্বোচ্চ বেতন পান। কারণ, ফিফার উদ্যোগে সমস্ত শ্রমিকের জন্য একটি সর্বনিম্ন বেতন স্থির করে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রমসংগঠনের সঙ্গে কথা বলে এ সব বিষয় ঠিক হয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকার জায়গা ও তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় নিয়মিত ভাবে। এটা একটা দীর্ঘকালীন বিষয় ঠিকই। তবে মানবাধিকারের বিষয়ে কাতার আজ অন্য আরব দেশগুলির কাছে একটি উদাহরণ হয়ে উঠছে।’’

কাতার বিশ্বকাপ সমালোচকদের উদ্দেশে ফাতমা বলেছেন, ‘‘মানুষ স্বভাবসিদ্ধ কারণে সমালোচনা করতে ভালবাসে। আমি বলতে চাই, সোশ্যাল মিডিয়ায় কী লেখা হচ্ছে, তাকে গুরুত্ব না দিয়ে আগে এই বিষয়ে ফিফার রিপোর্টগুলি দেখুন। কারণ, সেই রিপোর্ট তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।’’

সমালোচনার মধ্যেই ফিফার সেক্রেটারি জেনারেলের দাবি,  ২০২২ সালের কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপ একটি স্মরণীয় হয়ে উঠতে চলেছে।