রামমোহন রায় মারা গিয়েছিলেন ১৮৩৩ সালে। ঠিক তার সত্তর বছর পর তাঁর ‘আত্মা’ ভারতে বিপ্লবের সম্ভাবনা নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করল, ‘ফল শুভ, কর্ম্ম কর’। সেই ঘরে তখন শ্রোতা হয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন ভারতে বিপ্লববাদের কাণ্ডারীরা— অরবিন্দ ঘোষ, যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষ। রামমোহনের ভূত প্রশ্নের জবাব দিল ঠিকই। কিন্তু বিবেকানন্দের বেলায় ভূত পরাস্ত হল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, এই ঘরে আপনার কোনও আত্মীয় আছে কি না, বলুন। জবাব দিতে পারল না সে…।
প্ল্যানচেট না প্রেত বৈঠকের প্রতি বাংলার বিপ্লবীদের একাংশের এই প্রবল আগ্রহের কথা শুনিয়েছিলেন অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষ আর তাঁর ছায়াসঙ্গী অবিনাশ ভট্টাচার্য। ‘বৈপ্লবিক সমিতির প্রারম্ভিক কালের ইতিহাস’ নিবন্ধটিতে এমনই ভূত বৈঠকের ইঙ্গিত দিয়েছেন অবিনাশ। বাংলায় অনুশীলন সমিতির শুরুর পর্বে এর সদস্য হিসেবে কলকাতায় যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে থাকতেন অবিনাশ ও বারীন। তারপর যতীন্দ্রনাথ ও বারীনের মতভেদ। আপার সার্কুলার রোডে যতীন্দ্রনাথের ভাড়াবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন দুই যুবক। বারীন ও অবিনাশ মদন মিত্র লেনে একটি বাড়িতে উঠে যান। সেটা ১৯০৩ সালের কথা। সার্কুলার রোডের আখড়াও ভেঙে যায়। পরে ঝামাপুকুর লেনে একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন যতীন্দ্রনাথ। সেই সময়েও বরোদা থেকে এই তিনজনেরই খরচখরচা পাঠাতেন অরবিন্দ ঘোষ। যতীন-বারীনের মনান্তরের কথা শুনে কলকাতায় আসেন অরবিন্দ। তারপর যতীন্দ্রনাথের বাড়িতে বারীন ও অবিনাশকে নিয়ে গিয়ে মতভেদ মিটিয়ে দেন তিনি। এই সময়েই প্ল্যানচেটের প্রতি অরবিন্দ-বারীন-যতীন্দ্রনাথের আগ্রহের একটি ঘটনার কথা শুনিয়েছেন অবিনাশ।
সময়টা বর্ষাকাল। কলকাতায় এসেছেন অরবিন্দ। সেদিনই অবিনাশের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ। বৃষ্টির মধ্যে এক বিকেলে অরবিন্দ-বারীনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অবিনাশ দেখেন, ঘরের ভিতরে প্ল্যনচেটের আয়োজন হয়েছে। অরবিন্দ, যোগেন্দ্র বিদ্যাভূষণ, বারীন, যতীন্দ্রনাথেরা ভুতকে ডাকছেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, হেমচন্দ্রের (হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) ভূতকে ডাকা হচ্ছে। অবিনাশের কথায়, ‘‘হেমবাবুর ভূত চারি ছত্র কবিতা লেখে। তাহার প্রথম ছত্র আমার মনে আছে— ‘হবে কি ভারত স্বাধীন…’। রামমোহনের ভূত বিপ্লব বিষয়ে বলিল, ‘ফল শুভ, কর্ম্ম কর’। কিন্তু বিবেকানন্দের বেলায় ভূত পরাস্ত হয়। তাহাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘এই স্থলে তাঁহার কোন আত্মীয় আছেন কিনা, তাহা বলুন’ তখন ভূত জবাব দিতে পারে নাই।’’
বরোদায় অরবিন্দের বাসভবনে যে প্ল্যানচেটের আসর নিয়মিত ভাবে বসতো, তা বারীন্দ্র ঘোষের আত্মজীবনেও রয়েছে। ‘আমার আত্মকথা’-য় তিনি লিখেছেন,
…পূজার ছুটীর পর বরোদায় (সেজদা অরবিন্দের সঙ্গে) আমি ফিরি তখনও আমাদের অবসর বিনোদন হতো প্ল্যাঞ্চেট নিয়ে। প্ল্যাঞ্চেট হচ্ছে দু’টো বোতামের মত পায়ার ওপর তে-কোণা কিম্বা পানের আকৃতির একটা কাঠ, তার এক দিকের ছিদ্রে একটা পেন্সিল লাগানো থাকে। কাঠটার ওপর দু’জনে হাত রাখলে ওটা ক্রমশঃ চলে এবং পেন্সিল দিয়ে লিখতে থাকে। যে শক্তি এসে হাতে ও প্লাঞ্চেটে ভর করে লেখে সে কখন বলে “আমি রামমোহন রায়,” কখন বলে “আমি নিত্যানন্দ সরকারের পিসী, দত্তদের শালখের বাড়ীর বেলগাছে আছি” ইত্যাদি। টেবিল বা প্ল্যাঞ্চেটে হাত রাখলে হাত যে আপনি চলে তা কোন কোন ক্ষেত্রে সত্যি, কিন্তু সে শক্তি যে কি— আমাদেরই অবচেতনার খেলা বা কোন পারলৌকিক জীবাত্মা বা ভূতের কারসাজি তা বলা শক্ত।
বারীন আরও লিখেছেন, …শ্রীঅরবিন্দের ‘Yoga and its Objects’ বইখানা তাঁর নিজের লেখা নয়, তিনি পেন্সিল ধরতেন আর এক অদৃশ্য শক্তি এসে লিখে যেত; রামমোহন রায়ের নামে এই ভাবে আগাগোড়া বইখানি পাওয়া গিয়েছিল। যখন এই ঘটনা ঘটে তখন অবশ্য আমি আন্দামানে। বরোদায় আমরা যতজন বসতুম তার মধ্যে সেজদা ও আমার হাতেই এইভাবে লেখা আসতো বেশী। একদিন স্বয়ং তিলক (বালগঙ্গাধর তিলক) এসে নানা প্রশ্ন করে যান, তখন আমার হাতে পেন্সিল ছিল।…প্রতিদিন আমরা কি একটা যেন নেশা ও ঝোঁকের মাথায় দু’তিন ঘণ্টা ধরে এই কার্য্য করতুম এবং সেই দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে কত রামকৃষ্ণ, ফাদার দামিয়ন, কৃষ্ণদাস পাল, কত মৃতা ভূতযোনিপ্রাপ্তা পিসী মাসী, ঠাকুরদা, বন্ধুবান্ধব এসে দেড় টাকার প্ল্যাঞ্চেটের প্রসাদাৎ আমাদের সঙ্গে আলাপ আপ্যায়ন করে প্রাণ জুড়িয়ে যেতেন তার তো হিসাব হদিস ছিল না, তাদের কত কথাই সত্য ঘটনার সঙ্গে মিলতো না, কত আবোল তাবোল প্রলাপ কখনও আমরা অম্লান বদনে হজম করে যেতুম কিন্তু তাতে সে সব স্পিরিটদের খ্যাতি প্রতিপত্তি আমাদের কাছে যে বিশেষ কমতো তা নয়। শ’ দু’শ message পারলৌকিক বাণীর মধ্যে দশটা মিললেই ভূতযোনির ওপর বিশ্বাসের পারা অমনি চড় চড় করে পাঁচ ডিগ্রি উঠে যেত। আমাদের দেশে এবং যে কোন দেশে এত হাতুড়ে কবিরাজ ডাক্তার, এত বুজরুগ সন্ন্যাসী গণক, এত অগণ্য গুরুপুরুত যে করে খাচ্ছে তার কারণই মানুষের প্রাণের এই অন্ধ বিশ্বাস প্রবণতা। আগা এবং পাছতলার অংশটুকু ছিড়ে বাদ দেওয়া জীবনের এই মাঝের পাতাটুকুর অর্থ এবং রহস্য জানবার জন্যে আমাদের এমনই ব্যাকুলতা যে কোন একটা কিছু বিশ্বাস করবার জন্যে আমরা যেন ব্যাকুল হয়েই আছি।
প্ল্যানচেট নিয়ে বিতর্ক অবশ্যই রয়েছে। একে বুজরুকি আখ্যা দিয়েছেন অনেকেই। তবে শুধু বাংলার বিপ্লবীদের একাংশই নয়, প্ল্যানচেট বা প্রেতবৈঠকে বিশ্বাস রাখতেন বঙ্গের অনেক মণীষীই। তালিকাটা দীর্ঘ। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ির অনেকেরই নজর ছিল প্রেতবৈঠকের দিকে। প্ল্যানচেটে মজেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। স্কুলে প্ল্যানচেটের আসর বসিয়ে চাকরি খুইয়ে ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এত লোক যখন প্রেত বৈঠকে মজেছেন, তখন বিপ্লবীদের আর অসুবিধা কোথায়!
(বানান অপরিবর্তিত)
(অলঙ্করণ -রাতুল চন্দ রায়)
সুন্দর ঝরঝরে লেখা, অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের চরিত্রের অন্য দিক জেনে সমৃদ্ধ হলাম। লেখিকার একদম অন্য রকম রচনার সঙ্গে এর আগে পরিচিত ছিলাম, এই নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে দেখে খুব ভালো লাগছে।