১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ফ্রান্সে। শুরুতেই গোলমাল। ফিফা পরপর দু’বার কেন ইউরোপে বিশ্বকাপ করছে— সেই অভিযোগ জানিয়ে লাতিন আমেরিকার দুই শক্তিশালী দেশ আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ে নাম প্রত্যাহার করলো। এবারের বিশ্বকাপ পুরোটাই প্রায় ইউরোপিয়ান কাপ হয়ে দাঁড়ালো। কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডে যোগদান করে ৩৭টি দেশ। যোগ্যতা অর্জন করে ১৬টি দেশ। আর এই ১৬টি টিমের মধ্যে ১৩টি ইউরোপের—অস্ট্রিয়া (খেলতে পারেনি), বেলজিয়াম, চেকোস্লোভাকিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড। লাতিন আমেরিকার একটি দেশ ব্রাজিল। আর দু’টি সারপ্রাইজ এন্ট্রি কিউবা ও ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ— মানে, আজকের দিনের ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়া হল এশিয়ার প্রথম দেশ, যারা বিশ্বকাপ খেলেছিল।
অস্ট্রিয়ার না খেলতে পারার কারণ, বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে জার্মানি দখল নেয় অস্ট্রিয়ার। ফুটবলের আর একটি সেরা দেশ স্পেন সেখানকার গৃহযুদ্ধের কারণে অংশগ্রহণ করতে পারলো না। অস্ট্রিয়া না খেলতে পারায় দর্শকদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল ক্রোধের বাতাবরণ। জার্মানি ও ইতালির খেলাগুলির সময়ে দর্শক তাদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল এই দুই দলের বিরুদ্ধে।
১৯৩৮ সালে চমক দেখালো ব্রাজিল। লিওনিডাস দা সিলভা (Leônidas da Silva)- ব্ল্যাক ডায়মন্ড। বিশ্ব প্রথম দেখলো একজন নক্ষত্রকে। খেলোয়াড় অনেক আসে, কিন্তু নক্ষত্র আসে মাঝে মাঝে। সারা বিশ্বকাপ জুড়ে এমন স্কিল দেখালেন লিওনিডাস যে দর্শকরা পাগল হয়ে গেল। তাঁর বাইসাইকেল কিক দেখার জন্য দর্শক ভিড় করছিল ব্রাজিলের খেলায়। নানা পত্রিকায় তাকে ভূষিত করা হল নানা নামে। কেউ বললেন, ব্ল্যাক ডায়মন্ড, কেউ বললেন রাবার ম্যান। ১৯৩৮ সালে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন লিওনিডাস (৭টি গোল)। তার মধ্যে একটি খেলায় তিনি করেছিলেন ৩টি গোল। পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ফুটবলের ইতিহাসে পোল্যান্ড ও ব্রাজিলের ১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপ ম্যাচ সর্বকালের সেরা ম্যাচগুলির একটি। সেই খেলার ফলাফল হল ৬-৫। তবে সেই ম্যাচে লিওনিডাস এমন একটি কাণ্ড ঘটালেন যা ফুটবলের ইতিহাসে এক মাত্র ঘটনা হয়ে রয়ে গিয়েছে। খেলা গড়িয়েছে এক্সট্রা টাইম পর্যন্ত। ফলাফল তখন ৪-৪। সারা মাঠ জুড়ে কাদা। লিওনিডাস এক্সট্রা টাইমের দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর বুট খুলে খেলতে শুরু করলেন। তারপর ওই খালিপায়ের স্কিল মুগ্ধ করলো গোটা স্টেডিয়ামকে। মাঠে সেদিন এত কাদা যে রেফারি ধরতেই পারেননি লিওনিডাস খালি পায়ে খেলছেন। সেই খালি পায়ে খেলতে খেলতে জয়সূচক গোল করলেন তিনি। ওই গোলটি ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে একমাত্র শু-লেস গোল (shoeless goal) হিসেবে পরিচিত।
ব্রাজিল সেই বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অধিকার করে। সেই সঙ্গে সারা পৃথিবীতে বার্তা পৌঁছে দেয় ফুটবলের শিল্প দেখাতে তারা হাজির। সেমিফাইনালে ব্রাজিল সেই সময়কার ফুটবল-দৈত্য ইতালির মুখোমুখি। ফলাফল ইতালির পক্ষে, ২-১। কিন্তু ওই খেলায় লিওনিডাস খেলতে পারেননি। কেন— কেউ জানে না। ব্রাজিলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তারা ভেবেছিল ব্রাজিল হেলায় ইতালিকে হারিয়ে দেবে। তবে গুজব শোনা যায়, মুসোলিনির প্রভাব ছিল ওই ঘটনায়। সেই লিওনিডাসকে খেলতে দেয় নি। আর একটি মজার কাণ্ড ঘটেছিল সেই খেলায়। খেলার ৬০ মিনিটের মাথায় পেনাল্টি পায় ইতালি। জিনো কোলাসির গোলে সেই সময় ইতালি ১-০ এগিয়ে। পেনাল্টি নিতে যান অধিনায়ক জিউসেপ মেজা (Giuseppe Meazza)। আর ঠিক পেনাল্টি নেবার সময়েই মেজার প্যান্ট খুলে যায়। ব্রাজিলিয়ান গোলকিপার ওয়াল্টার গৌলার্ট (Walter Goulart) ওই দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে মাঠে বসে পড়েন। মেজা সেই সময় একহাতে প্যান্ট নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গোল করেন।
১৯৩৮ সালের বিশ্বকাপে একটি দেশ কিন্তু চমকে দিয়েছিল— সেই দেশ হল, কিউবা। তারা হারিয়ে দেয় ইউরোপের সেই সময়ের ফুটবলের শক্তিশালী দেশ রুমানিয়াকে। তবে ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ— মানে, ইন্দোনেশিয়া পর্যুদস্ত হয়েছিল হাঙ্গেরির কাছে।
ফাইনাল খেলা হয়েছিল ইতালি ও হাঙ্গেরির মধ্যে। ৪৫,১২৪ জনের সামনে। জিনো কোলাসি ও সিলভিও পিওলার দু’টি করে গোলের পর শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি জিতে নেয় ইতালি। ৪-২। পরপর দুটি বিশ্বকাপ জিতে নেয় কোচ ভিত্তোরিও পোজোর ইতালি। এরপর থেমে গেলো বিশ্বকাপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে। পরবর্তী বিশ্বকাপের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৫০ সাল পর্যন্ত। চমক ছিল ৫০-এর বিশকাপে। সেবার হেলায় সুযোগ হারিয়েছিল ভারত।