১৯৫৪ সাল। সুইজারল্যান্ড। একটি ছোট্ট দেশ। ইউরোপের যে দেশটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, সেটি এই সুইজারল্যান্ড। তাই এই দেশেই বিশ্বকাপ করার অনুমতি দিয়েছিল ফিফা। সেবারই প্রথম টেলিভিশনে বিশ্বকাপ দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। মোট ১৬টি দেশ অংশ নিয়েছিল মূলপর্বে। ইউরোপ থেকে ১২ টি দেশ (অস্ট্রিয়া ,বেলজিয়াম, চেকোস্লোভাকিয়া , ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি, সুইজারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, তুরস্ক, পশ্চিম জার্মানি ও যুগোস্লাভিয়া)। লাতিন আমেরিকা থেকে ব্রাজিল ও উরুগুয়ে। এশিয়া থেকে সাউথ কোরিয়া। উত্তর আমেরিকা থেকে মেক্সিকো।
গতবারের চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে মূল পর্বে থাকলেও ১৯৫০ সালে যেমন ফেভারিট ছিল ব্রাজিল, তেমনি এই বিশ্বকাপে জনপ্রিয়তার শীর্ষে হাঙ্গেরি। নক্ষত্র ফেরেঙ্ক পুসকাস (Ferenc Puskás-The Galloping Major), তাঁর যোগ্য সঙ্গী হিদেকুটি ( Nándor Hidegkuti)। গোটা পৃথিবী তখন মুগ্ধ হাঙ্গেরির পাসিং ফুটবলের জাদুতে। এখানে কয়েকটি ছোট পরিসংখ্যান দিলে বোঝা যাবে কেমন ছিল এই হাঙ্গেরি জাতীয় দল…।
ঘটনা-১
১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিক ফাইনালে হাঙ্গেরি ভার্সেস যুগোশ্লাভিয়া। ফলাফল ৬-০। বিজয়ী হাঙ্গেরি।
ঘটনা-২

ইংল্যান্ড তখন বিশ্ব রাঙ্কিং-এ তৃতীয়।
১৯৫৩-তে খেলা হাঙ্গেরি বনাম ইংল্যান্ডের (Match of the Century)… বিজয়ী হাঙ্গেরি। ফলাফল ৬-৩।
ঘটনা-৩
১৯৫৪। এবারও মুখোমুখি হাঙ্গেরি ও ইংল্যান্ড। ফলাফল ৭-১। জয়ের চওড়া হাসি হাঙ্গেরির সেই খেলোয়ারদেরই।
১৯৫০ সালে থেকে ১৯৫৬-র কথা ধরা যাক। ৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে বিপ্লব সংগঠিত হয়। তার আগে পর্যন্ত পর্যন্ত ফুটবলের পরিসংখ্যান কী বলছে? মোট ম্যাচ – ৬৯। জয় -৫৮ , অমীমাংসিত -১০টি। আর হার মাত্র ১টিতে! এই যে একটি হার, সেটিকে বলা হয়ে থাকে মিরাকেল অফ বার্ন (The Miracle of Bern)! হাঙ্গেরির সেই পরাজয় নিয়ে পরে বলা যাবে। তবে ১৯৭০ সালের পরে যে টোটাল ফুটবলের রূপ গোটা দুনিয়া দেখেছিল নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডের থেকে, তার প্রথম প্রকাশ ছিল অনেক আগেই পুসকাস, হিদেকুটি বা স্যান্ডর কোসিসদের (Sándor Kocsis) খেলায়।
১৯৫৪-র বিশ্বকাপে হাঙ্গেরি খেলা শুরু করলো নিজস্ব ভঙ্গিমায়। গ্রুপ লিগের খেলায় সাউথ কোরিয়াকে ৯-০, ওয়েস্ট জার্মানিকে ৮-৩ গোলে হারিয়ে শুরু হল হাঙ্গেরির বিশ্বকাপ অভিযান। এর পর কোয়ার্টার ফাইনালে তাদের খেলা ব্রাজিলের বিপক্ষে। খেলাটি ব্যাটল অফ বার্ন (Battle of Berne) নামে পরিচিত। ফলাফল ৪-২। বিজয়ী সেই হ্যাঙ্গেরি। কেন ব্যাটল অফ বার্ন? কারণ, সেই খেলায় মোট তিনজন মাঠের বাইরে ও সারা সময় ধরে শুধু মারামারি। খেলার মাঠ থেকে সাইডলাইন, সেখান থেকে লকাররুম— গোলমাল সর্বত্র। আহত বহু খেলোয়াড়। আর সেই ম্যাচের পর, সেমিফাইনালে উরুগুয়েকে অতিরিক্ত সময়ে ৪-২ গোলে হারিয়ে ফাইনালে উঠল হাঙ্গেরি।

ব্যাটেল অফ বার্ন

এদিকে, পশ্চিম জার্মানি দলটি তখন প্রায় একটি অপেশাদার দল। ১৯৫০ সালে সাসপেন্ড। তারপর ঠিক করে শুরু হয়নি জার্মান লিগ। প্রথম ম্যাচেই হাঙ্গেরির কাছে লজ্জাজনক হার। কিন্তু ওইখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ালো টিমটি। কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোশ্লাভিয়াকে তারা হারালো ২-১ গোলে। তারপর একটি অসাধারণ পারফরম্যান্স অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে। ৬-১। ফাইনাল পশ্চিম জার্মানি। উল্টোদিকে টিম হাঙ্গেরি।
গ্রুপ লিগের যে টিম, সেখানে থেকে বিশ্বকাপ ফাইনালে ৮ জনকে বদলে দিয়েছে পশ্চিম জার্মানি। বিশ্বকাপ ফাইনাল শুরু। আর শুরুতেই ২-০। হাঙ্গেরি এগিয়ে গেল দুই গোলে। ৬ মিনিটের মাথায় গোল করলেন পুসকাস। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আবার গোল ৮ মিনিটে। ১০ মিনিটে একটি গোল শোধ করলো জার্মানি। ১৮ মিনিটে ২-২। আহত হলেন পুসকাস। পরিবর্তন নেবার নিয়ম নেই। তাই সারা মাঠ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলেন তিনি। বল ধরার পর্যন্ত ক্ষমতা নেই। তারপর দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হলো বৃষ্টি। একেবারে বন্ধ হয়ে গেল হাঙ্গেরির পাসিং ফুটবল। ৮৪ মিনিটে গোল করে হেলমুট রেনে (Helmut RAHN) প্রথম বিশ্বকাপ খেতাব এনে দিলো পশ্চিম জার্মানি দলকে। এই খেলাটিকে বলা হয় ‘মিরাকল অফ বার্ন’। ৬৯টি ম্যাচের মধ্যে হাঙ্গেরির প্রথম হার।

এই বিশ্বকাপেই শোনা গেল এক অদ্ভুত অজুহাত। খেলা হয়েছিল উরুগুয়ে আর স্কটল্যান্ডের মধ্যে। উরুগুয়ে জিতলো ৭-০ গোলে। খেলার শেষে রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে স্কটিশ ম্যানেজার টমি ডচার্টি (Tommy Docherty) দোষারোপ করলেন উরুগুয়ের বিরুদ্ধে। তাঁর অভিযোগ, উরুগুয়ের জাতীয় সঙ্গীত এতটাই লম্বা যে সেটি তাঁর দলের খেলোয়াড়দের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে!
এই বিশ্বকাপ নিয়ে পরে পশ্চিম জার্মানি দলের বিরুদ্ধে সিরিয়াস অভিযোগ ওঠে। ফাইনালের দ্বিতীয়ার্ধের আগে সেই দলের খেলোয়ারেরা “ভিটামিন বুস্টার” নামে মেথামফেটামাইন ড্র্যাগ ব্যবহার করেছিলেন৷ সাম্প্রতিক ডোপিং নিয়ে একটি অনুসন্ধানে এই রিপোর্ট প্রকাশ পেয়েছে। “তদন্তে এমন কিছু শক্তিশালী ইঙ্গিত রয়েছে যাতে প্রমাণিত হয় জার্মানির কিছু খেলোয়াড়কে (মেথামফেটামিন) পারভিটিন ইনজেকশন দেওয়া হয়। ভিটামিন-সি নয়, যেমনটি দাবি করা হয়েছিল” —বলেছেন ক্রীড়া ইতিহাসবিদ ও লেখক এরিক এগারস (Erik Eggers)। তিনি বার্লিনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দলের অংশ হিসেবে গবেষণাটি পরিচালনা করেছিলেন। ঘটনা হল, এই পারভিটিন ইনজেকশনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাদের দেওয়া হতো।