পর্ব -১৭

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

               মহাভারতের আদিপর্বের শ্বেতকেতু ও উদ্দালকের গল্প আমরা সবাই জানি। উদ্দালক ছিলেন একজন বিখ্যাত ঋষি। তাঁর প্রকৃত নাম আরুণি। তার গুরু আয়োদ ধৌমের বরে উদ্দালক নামে খ্যাত হন। উদ্দালকের পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদিন শ্বেতকেতু পিতা-মাতার কাছে বসেছিলেন। এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে শ্বেতকেতুর মায়ের হাত ধরে বাবার সামনে থেকে টেনে নিয়ে চলে গেল। এই দেখে শ্বেতকেতু তার বাবাকে বললেন, “বাবা তুমি কিছু বললে না?”

         উদ্দালক বললেন, “তুমি ক্রুদ্ধ হয়ো না। পৃথিবীতে সকল স্ত্রীই গাভীর মতো স্বাধীন। সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও তাদের অধর্ম হয় না— ইহাই সনাতনধর্ম।”

           শ্বেতকেতু এই বক্তব্যে সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি আরও রেগে গিয়ে বললেন, “আজ থেকে যে স্ত্রী স্বামী ভিন্ন অন্য পুরুষের সংসর্গ করবে, যে পুরুষ ব্রহ্মচারিণী বা প্রতিব্রতা স্ত্রীকে পরিত্যাগ করে অন্য স্ত্রীতে আসক্ত হবে এবং পতি-আজ্ঞা পেয়েও যে স্ত্রী ক্ষেত্রজ সন্তান উৎপাদনে আপত্তি করবে, তারা সকলেই ভ্রুণ হত্যার পাপে লিপ্ত হবে।”

           মহাভারতের গল্প থেকে বোঝা যায়, নারী আগে কতটা স্বাধীন ছিল। কীভাবে পুরুষতন্ত্র তাকে পরাধীন করেছে। বৈদিক যুগে নারী স্বাধীনতার অসংখ্য নিদর্শন আমরা পেয়েছি। বৈদিক যুগের পর স্মৃতির যুগে নারীকে শৃঙ্খলিত করার জন্য এল অসংখ্য আদেশ, উপদেশ, নির্দেশ। যেমন, বশিষ্ট ধর্ম সূত্র অনুযায়ী, শৈশবে নারী পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। স্বাধীন নারীর কোনও স্থান নেই শাস্ত্রে।

            পৌরাণিক যুগ পেরিয়ে ঐতিহাসিক যুগে নারী স্বাধীনতার আরও অবনতি হয়। ইতিহাস মানে যুদ্ধ, রাজ্য দখল। রাজ্যের সম্পদ দখলের সঙ্গে সঙ্গে ওই রাজ্যের নারীর দখল পেত বিজেতারা। নারী হয়ে উঠল সম্পদের সমার্থক। পরাধীন দেশের নারী মানে ভোগ্যবস্তু।

            স্বাধীন দেশের নারীরাও নানা কারণে পুরুষের অধীন হল। তাই সর্বত্র নারী হয়ে উঠলো ভোগ্যপণ্য। শুধু তাই নয় নারী যাতে স্বাধীনচেতা না হয়ে ওঠে, এজন্য তার শিক্ষা-দীক্ষার পথগুলি বন্ধ করে দিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।

           কেবলমাত্র নারীকে তুষ্ট রাখার জন্য তার রূপের প্রশংসা শুরু করল, দায় পড়লে নারীকে দেবী বলে পূজা আরম্ভ করল, এবং সহানুভূতি আদায়ে মেয়েদের ‘মায়ের জাত’ বলে অভিহিত করল।

          আসলে কোনও সমাজ, কোনও ধর্ম, কোন রাষ্ট্র নারীকে স্বাধীন দেখতে চায়নি। আধুনিক বিশ্ব যে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, সেই গণতন্ত্রও নারীকে পুরুষের সঙ্গে একসাথে ভোটাধিকার দেয়নি। ১৯১৮ সালে যুক্তরাজ্যে অর্থাৎ ইংল্যান্ডে ত্রিশোর্ধ মহিলারা ভোটাধিকার পান। ১৯২১ সালে ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকার আসে। স্বাধীন ভারতে অবশ্য মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে সমবয়সে ভোট দেওয়ার অধিকার অর্জন করে।

          মানবতার আইনে ও ভারতীয় সংবিধানে নারী পুরুষের অধিকার সমান। অর্থাৎ উভয়ই স্বাধীন। নারীরা ভারতবর্ষের নাগরিক হিসাবে সমস্ত রকম সুযোগ সুবিধা পাবে। স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের অধিকার, ধর্মমত আচরণের অধিকার, পছন্দ মতো জীবিকা বেছে নেওয়ার অধিকার, সম্পদ সংগ্রহ করার অধিকার, মুক্ত ভাবে পরিভ্রমণের অধিকার। কিন্তু এই সব স্বাধীনতা সংবিধান দিলেও সমাজ এখনও দিতে প্রস্তুত নয়।

           এর আগেও বলা হয়েছে, শাস্ত্রে স্বামীর ধর্মই স্ত্রীর ধর্ম। এখনও আন্তঃধর্ম বিবাহ হলেও স্ত্রী সাধারণত স্বামীর ধর্ম গ্রহণ করে। পছন্দ মতো জীবিকা নির্বাচনের ব্যাপারে পেরোতে হয় নানা পারিবারিক বাধা, তারপর সেই জীবিকায় টিঁকে থাকার লড়াই। সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে আজও তার মত গুরুত্ব পায় না। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রীর নামে সম্পত্তি কেনা হলেও তার নির্বাচন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং বিক্রয়ের ব্যাপারে নারীকে পুরুষের মুখাপেক্ষী হতে হয়। আজও আমাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ একলা বা একাধিক মেয়ের চলাফেরার জন্য উপযুক্ত নয়। একে তো এই রকম মেয়েদের সন্দেহের চোখে দেখে সমাজ। তার উপর পুরুষ কর্তৃক শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিগ্রহ তো আছেই।

          মেয়েদের যেটা স্বাধীন পেশা, বিশেষজ্ঞরা যাকে পৃথিবীর আদিম পেশা বলে অভিহিত করেন, তা হল পতিতাবৃত্তি। সেটিও কিন্তু নারীরা স্বাধীন ভাবে করতে পারে না। প্রথমত এই পেশা ভারতে আইনসিদ্ধ নয়, তাই নারীকে লুকিয়ে, চুরিয়ে এবং বিশেষ স্থানে অবস্থান করে এই দেহব্যবসা করতে হয়। যেহেতু আইনসিদ্ধ নয়, তাই পেশা সংগঠিত নয়। অসংগঠিত ও আইনসিদ্ধ না হওয়ার জন্য এই পেশাতে নারীদের শোষণের বিস্তর সুযোগ রয়েছে। যদিও অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে বা তাদের কল্যাণ দেখে, তা-ও যৌনকর্মীদের সমস্যার সমাধানের তুলনায় অপ্রতুল।

               সবচেয়ে বড় কথা হল, অধিকাংশ যৌনকর্মী এই পেশা স্বাধীন ভাবে গ্রহণ করে না। মৌর্যযুগে বা গুপ্তযুগে নগরনটীদের সামাজিক গরিমার দিকে তাকিয়ে এই পেশাতে স্বাধীন ভাবে অনেক নারী প্রবেশ করতো। কিন্তু এখন নারীরা নিতান্ত দায়ে না পড়লে এই পথ ধরে না বা বলা যেতে পারে বাধ্য হয়েই এই পেশাতে আসে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিশোরী মেয়েদের জোর করে এই পেশাতে নামানো হয়। পতিতাপল্লীতে আজও ক্রীতদাসীর মতো মেয়ে বিক্রি হয়।

             মুখে নারী স্বাধীনতার কথা বলে যতই বড়াই করি না কেন, সে সব কথা মেয়েদের বড় একটা কাজে আসে না। নারী স্বাধীনতা হীনতা নারীপাচারের পথ প্রস্তুত করে দিয়েছে।

তথ্য ঋণ:

১. পৌরাণিক অভিধান- সুধীরচন্দ্র সরকার।

২. নারী – হুমায়ুন আজাদ (আগামী প্রকাশনী, বাংলাদেশ)।