পর্ব ৩৩

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের পরিকল্পনা প্রায় শেষের পথে। সময় এসেছে ধীরে ধীরে পুরো পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার। তার আগে একবার সব কিছু চুড়ান্ত করা। এই বিষয়ের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধানকে জানাতে হবে। জানাতে হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে। RAB প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সময় মিলিয়ে ঠিক হবে দিনক্ষণ। প্রথমে ঠিক হল ২৯শে মে।  কিন্তু আবহাওয়া খুব খারাপ থাকায় পরবর্তীতে দুইদিন পিছিয়ে গেল চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের দিন।

এদিকে সময় যত এগিয়ে আসছে আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে যাচ্ছে। বার বার দেখছি সমস্ত কিছু ঠিকঠাক ভাবে এগোচ্ছে কি না। প্রতি মুহূর্তে যোগাযোগ রাখছি মেজর আদনানের সঙ্গে।  ওর সাথে কথা বলে ঠিক করলাম, মাস্টারের কাছে যাওয়া দরকার। আত্মসমর্পণের দিন হিসাব করে আমি নদীতে নাও ভাসালাম ২৭ তারিখ। মাস্টারের সঙ্গে একটু আগেই পৌঁছে যেতে চাই। আর তার সঙ্গীদের সাথেও কথা বলা দরকার। রওনা হলাম গভীর অরণ্যে মাস্টার বাহিনীর উদ্দেশে। আমরা রওনা দিয়েছিলাম মংলা থেকে। আমাদের সঙ্গে ছিল দু’জন ওয়ান্টেড দস্যু— সুমন ও সোলাইমান। যাওয়ার দিন রাতে আমরা খুব সতর্কতার সঙ্গে মংলার একটা হোটেলে ছিলাম। ঠিক ভাটা শুরুর পরে রাত তখন একটা— আমরা ট্রলার ভাসালাম।  একদম নদীর মাঝখানে চলে গেলাম।  মাস্টারের ইচ্ছে মতো আমাদের গন্তব্যস্থল সুন্দরবনের পাশাখালী ফরেস্ট অফিস।

পাশাখালী সুন্দরবনের একটা খালের নাম। পশুর নদীর পশ্চিমে প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় সেই খালের অবস্থান। আগে আছে ভদ্রা নদী। পাশাখালীতে বনবিভাগের একটি টহল ফাঁড়িও আছে। ছোট খালটি ভাটার সময় শুকিয়ে যায়। তাই জোয়ার-ভাটার সময় মিলিয়ে দস্যুরা আসতো এই জায়গায়। এই জায়গা থেকে চারপাশ পরিষ্কার দেখা যায়। দস্যুরা জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করে।

পাশাখালী খালটি পশ্চিমে ঢুকে গেছে। উল্টো দিকে ঘষিয়াঙ্গারি। এখান থেকে নিশানখালী থেকে চাইলেবগী, বেলমারি খাল, আদাচাই হয়ে শিবসা নদী-সহ বিভিন্ন খাল দিয়ে নদী থেকে বের হওয়া যায়। লোকালয় থেকে প্রায় পাঁচ ছয় ঘণ্টা দূরে এই জায়গাটি অবস্থিত। দুর্গম। এখানে লুকিয়ে থাকা ,পালিয়ে যাওয়া কিংবা যাতায়াত করার সুবিধা বেশি। সে কারণে সবসময় বড় বড় দস্যুদলগুলি এখানে আসতো, থাকতো ও বিশ্রাম নিতো।

পাশাখালীর এই ফরেস্ট অফিসের এক অদ্ভুত বৈশিষ্ট দেখেছি আমি। প্রথমত, এই ফরেস্ট অফিসে কোনও অস্ত্র নেই। আর লোকজন? তিন-চারজন, তার বেশি নয়। আসলে এটিকে ফরেস্ট অফিস বলার থেকে সুন্দরবনের দস্যুদের বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা বলা যেতে পারে। একটা ছোট্ট অফিস। তার পাশেই ছায়াঘেরা একটি বড় পুকুর। সেইখানে বিশ্রাম নিতো দস্যুরা। এখানেই দস্যুদের সঙ্গে দেখা করতে আসতো তাদের স্ত্রী-পরিবার। দস্যুরা তাদের পরিবারকে নিয়ে এসে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকদের বের করে দিতো। তারপর দস্যুরা বিদায় নেওয়ার পরে ফরেস্টের লোকেরা তাদের অফিস ফিরে পেতেন। এক অদ্ভুত বোঝাপড়া ছিল এই অফিসটায়। এখন ভাবতে কেমন অবাক লাগে।

সুন্দরবনের বৃষ্টিতে আমি আর বেলায়েত

মাস্টারের কথা মতো আমি গেলাম সেই অফিসে। আমার  সাথে পলিন, বেলায়েত, রাজীব আর ইয়ামিন ভাই। ২৮ তারিখ সকাল থেকে আমরা ওদের সাথে কথাবার্তা শুরু করলাম। দস্যুদলের অনেকেই স্ত্রী-সন্তান ও স্বজনদের আত্মসমর্পণের আগে পাশাখালীতে নিয়ে যেতে বললেন। আমার মনে হল, ওরা একটু নিরাপত্তা চাইছে। সত্যি বলতে কী, পূর্বের অভিজ্ঞতা তো ভাল নয়। ৱ্যাব যে তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না তার গ্যারান্টি কি?

আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমার মনে হল, এতে একটা অন্য সুবিধা আছে। যদি দস্যুদের সঙ্গে তাদের স্ত্রী সন্তানরা থাকে তবে ওদের দিক থেকেও কোনওরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তারপর স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে থাকতে দিলে দস্যুদের আমাদের প্রতি বিশ্বাস থাকবে। তাদের মন অল্প হলেও নরম থাকবে।  আর ৱ্যাবও নিশ্চিন্ত থাকবে যে দস্যুদের তরফ থেকে কোনও ধরনের প্রতি আক্রমণ হবে না।

পাশাখালীতে দস্যুনেতা মাস্টার এবং তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সোহাগ-সহ দুই-তিনজন তাদের বউ-বাচ্চা-পরিবারকে নিয়ে এসেছিল। ওদের সাথে সেখানেই কথা হল আমার।

মাস্টারের কথা মতো, তখন তার দলে ছিল প্রায় ৪০ জন। আমি পৌঁছে কথা বললাম মাস্টারের সঙ্গে। তার কথা শুনে হতাশ হলাম আমি। আমি এরপর নিজে ব্যক্তিগত ভাবে তাদের সাথে কথা বললাম। দেখলাম, মাস্টার বাহিনীর কয়েকজনের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব আছে। বেশির ভাগ জলদস্যু আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয়। খুব অল্পসংখ্যক আত্মসমর্পণ করবে বলে স্থির করেছে। এত পরিকল্পনা কি বৃথা হয়ে গেল আমাদের? তবে মাস্টারের অবশ্য কোনও দ্বিধা ছিল না।  কিন্তু দলের ভিতরের কিছু তরুণের মন থেকে সন্দেহ যাচ্ছিলই না। মাত্র ৩-৪ জন আত্মসমর্পণে রাজি হল। তারপর মাস্টারের কথায় পরে সব মিলিয়ে ৭ জন রাজি হল আত্মসমর্পণে।

বর্ষায় সুন্দরবন বিহার

আমি ফোন করলাম আদনানকে।

—আদনান, বেশির ভাগ দস্যু তো আত্মসমর্পণ করতে চাইছে না।

—কতজন হতে পারে? আদনান পাল্টা জিজ্ঞাসা করলো আমাকে।

—খুব বেশি হলে ৭-৮ জন। বাকিরা তো আত্মসমর্পণ করতে চাইছে না।

—ঠিক আছে ওতেই হবে। কাউকে জোর করবেন না। যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের দিয়েই হবে।  বাকিদের আমরা পরে বুঝবো।

ফোন রাখার আগে আদনানকেও হতাশ মনে হল। জিজ্ঞেস করলো, কতগুলো অস্ত্র জমা দেবে?

বললাম, অন্তত ৫২টা আর সাড়ে পাঁচ হাজার গুলি।

কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা। তার মনে হয়, বিশ্বাস হচ্ছিল না। সুন্দরবনে একসঙ্গে এত অস্ত্র আর গুলি কোনও অভিযানে ধরা পড়েনি কখনও!

 আদনানের সঙ্গে কথা বলে আমি আমাদের সিদ্ধান্ত তাদের জানিয়ে দিলাম। যারা চায় কেবল তারাই আত্মসমর্পণ করবে। বাকিদের কেউ কিছু বলবে না।

আত্মসমর্পণের জন্য যে সাতজন রাজি হয়েছিল, তারাই মাস্টার বাহিনীর অস্ত্রের মালিক।

তাদের বললাম, “অস্ত্রশস্ত্র সব গোছান “।

এর আগে তারা তাদের বাড়তি অস্ত্রগুলো খুলে প্যাকেটে ভরে বনের ভিতরে দুই ভাগে দু’টি খালের ধারে পুঁতে রেখেছিল। সাতক্ষীরার সহকর্মী রাজীব ও বাগেরহাটের ইয়ামিন ভাইয়ের নেতৃত্বে দু’টি টিমকে পাঠিয়ে দিলাম সেখানে। জঙ্গলে চাপিয়ে রাখা এই অস্ত্রগুলো বের করবে কী করবে না তা নিয়ে সারাদিন দোটানায় ছিল দস্যুরা। আমি অনড়। একটি গুলির খোসা বনে রেখে আত্মসমর্পণ চলবে না…।

(ক্রমশ)