পর্ব ৩৪

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

ডাকাতি করতে গেলে লাগে অস্ত্র মানে বন্দুক। কিন্তু সেই অস্ত্র ভোঁতা হয়ে যায় যদি তাতে গুলি না থাকে। সুন্দরবনের জলদস্যুদের মধ্যে তারাই মাতব্বর যাদের অস্ত্রের মালিকানা ছিল। মাস্টার বাহিনীতে তখন ৪০ জন জলদস্যু।  আমাকে একটা জিনিস নিশ্চিন্ত করছিল সেটা হল যারা অস্ত্রের মালিক তাদের সবাই আত্মসমর্পণ করছে। শুধু লোকগুলি নয় আমার দরকার ওদের অস্ত্রগুলি। ওই অস্ত্রের মূল রসদ, গুলি। গুলিও  আমার দরকার। পরিকল্পনা করে নিলাম, যতটা পারবো অস্ত্র উদ্ধার করে সেগুলি প্রশাসনের হাতে তুলে দেব।

“অস্ত্র গোছান” বলে তো দিলাম। কিন্তু গোছায় কে? অগত্যা দায়িত্ব নিতে হলো আমার টিমকে। আসলে ভরসা পাচ্ছিলাম না। দস্যুদের কাছে শুনলাম ,তারা তাদের বাড়তি অস্ত্রগুলো খুলে প্যাকেটে ভরে বনের ভেতরে দুই ভাগে দুটি জায়গায় পুঁতে রেখেছিল। দুইটি টিমকে পাঠিয়ে দিলাম সেখানে। একটি দলে পাঠালাম আমাদের সহকর্মী সাতক্ষীরার আহসান রাজীবকে। দূরের জায়গাটিতে পাঠালাম বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামিন আলীকে। কাছের দলটি ফিরে এলো অস্ত্রগুলো নিয়ে। পাশাখালী ফরেস্ট অফিসের পুকুরের নিচে পুঁতে রাখা ছিলো অস্ত্রগুলি। কিন্তু দূরের দলটির আসতে সময়  লাগলো অনেক। জোয়ারের পানি বেশি থাকার কারণে খালের নিচ থেকে অস্ত্র আর গুলি তুলতে সময় লেগেছিল। ওদের ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল।

যতটা সম্ভব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উঠিয়ে আনাই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। অন্যদিকে সময়ও কম।  তাই তাদের সাথে অস্ত্রগুলি পরিষ্কার করতে আমরাও হাত লাগলাম। সরখানে সশরীতে থাকার কারণ ছিলো ভিন্ন। একটি অস্ত্র গুলিও যেন তারা সরাতে না পারে সেদিকে ছিলো আমার দৃষ্টি।

অস্ত্রগুলো জড়ো করে নিয়ে এসে যেখানে ট্রলার বাধা ছিল তার পাশে একটা ছাউনিতে রাখা হল। অস্ত্র পাওয়া গেলো ৫২টা। গুলি ছিল প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার।

কাজ শেষ করে বসলাম বিশ্রাম নিতে। সেই সময় বেলায়েত বলে উঠলো -ভাই অবশেষে আপনার কাজের ফল পাওয়া যাচ্ছে। 

-না বেলায়েত ভাই। যতক্ষণ না কাজটা সম্পূর্ণ হচ্ছে তখন আমার চিন্তার শেষ নেই। সত্যি আমি কিছুতেই দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারছি না।

-প্রচুর দৌড়তে হয়েছে আপনাকে।  কত জায়গায় গেছি আমরা। কত ডাকাতের সাথে দেখা করেছি। কত ঝড় ঝাপটা আপনার উপর দিয়ে বয়ে গেছে।

-কেন শুধু আমার কথা বলছেন! আমাদের টিমটাই  তো কাজ করেছে। সবার অবদান আছে।

-মনে আছে সেই এক ডাকাতের কাছে যাওয়ার সময় আমাদের ট্রলার ফুটো হয়ে গিয়েছিল? কি ঝামেলায় না পড়েছিলাম আমরা।

– সত্যি, সেই দিন কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম! ভেবেছিলাম, চারগাঙের মুখে না ডুবে মরতে হয়।

মনে পড়ছিল সেদিনের সেই ঘটনাটা। রওনা হয়েছিলাম সুন্দরবনের এক ডাকাতের সাথে দেখা করতে। প্রথমে যাবো দুবলার চরে।  ওখান থেকে শুরু হবে আসল যাত্রা। রাতে ট্রলার নামালো হলো জলে।

ঘন্টা চার চলার পর চার গাঙ এর মুখে ট্রলারের তলা ফুটা হয়ে গেল। গলগল করে পানি ঢুকছে ট্রলারের মধ্যে। এদিকে বর্ষা কাল। আবহাওয়া খুব খারাপ। তখন ভাটা। নদীর তেজ ভালই।  তীর অনেক দূর। পশুর ও শিবসা নদী এখানে একসঙ্গে মিলেছে। মজ্জাদ নামে পরিচিত এই জায়গাটি এর বিশালতা ও উত্তাল স্বভাবে কারণে বেশি পরিচিত। অনেক অঘটন এখানে ঘটেছে।

সবাই বেশ উদ্বেগ্ন। আমি ভাবছিলাম এবার প্রাণটা বাঁচাবো কী করে! লাইফ জ্যাকেটও নাই ট্রলারে। কয়েকটি ছোট ড্রাম আছে সেটা ধরে বাঁচার চেষ্টা করবো যদি ডুবে যাই।  আশেপাশে ছোট খালও নাই। কী করি! সরদার বললো, সবাই ট্রলারের উপরে উঠে আসেন। পলিন ক্যামেরার ব্যাগ আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নিয়ে উপরে উঠে আসলো। 

ট্রলারের নীচে মহাযজ্ঞ চলছে। দুই জন সমানে পানি ফেলছে। দুইটা পাম্প চলছে। পানি কমে না। ট্রলারের অনেকটা পানিতে ভরে গেছে। সরদার ওই জলের মধ্যে হাতিয়ে হাতিয়ে নীচে ট্রলারের ফুটো খুঁজছে।

এদিকে ট্রলারের সুকানি আমার হাতে। নদীর পূর্ব দিকে কোথাও ভিড়াবো। কিন্তু সে পর্যন্ত যেতে অন্তত ৪০ মিনিট লাগবে।  সে পর্যন্ত ট্রলারটি ভাসিয়ে রাখতে পারলেই হয়।

কিছু সময় হাতড়ানোর পরে সর্দার খুঁজে পেলো সেই ফুটো। প্রায় চার ইঞ্চির মতো। কিন্তু সেখানে তখন হাত দিলে বিপদ আরও বাড়তে পারে। সারাতে গেলে তলের তক্তা পুরোটাই ভেঙে যাবে। তাই ভাসমান অবস্থায় মেরামত করা যাবে না।

একটা কাঁথা দিয়ে ভাঙা জায়গা চাপ দিয়ে রাখলো সরদার। ওদিকে পানি সেঁচা চলছে পুরোদমে। কপালটা ভাল ছিলো। প্রায় ৪৫ মিনিট চলার পর একটা ছোট খালের মুখ পেলাম। পশুরের পূর্ব দিকে। ট্রলারটা ঢুকিয়ে নোঙর করলাম। মাঝ নদীতে ট্রলারডুবি থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম সে যাত্রায়।

ভোর বেলা। সবাই ক্লান্ত। বেলায়েত সরদার উঠে আসলো তলা থেকে। তখন জানলাম যে কোন জায়গায় ফেটেছে। চুলা জ্বললো। চা খেতে হবে।

চায়ে চুমুক দিয়ে এবার ট্রলার ঠিক করতে নামবে সবাই। সময় নাই। কারণ জোয়ার আসার আগেই ফুটো বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? সময় কম। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও নাই। দা একটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লো সরদার। এবার শুরু বুদ্ধির কাজ। বেলায়েত সরদারের বুদ্ধির খেলা শুরু।

এমন কিছু দিয়ে আপাতত ট্রলারের তলার ফুটো বন্ধ করতে হবে যা নরমও না, শক্তও না। একটু পর সরদার দেখি গোলপাতার ডাল কেটে আনলো। তারপর দা দিয়ে কেটে ছেঁটে সেই ফুটোর মাপ মতো সাইজ করা হল। তার পর খুব সতর্কতার সঙ্গে ভাঙা জায়গাটা মেরামত করে ফেললো বেলায়েত সরদার।

জোয়ার আসলো। ট্রলার ভাসলো। আরও প্রায় চার ঘন্টা দক্ষিণে যাবো। দুবলার চর পর্যন্ত যেতে হবে। সেখানে আরও ট্রলার আছে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আছে।

আজ মনে পড়ছিল সেই দিনগুলির কথা।  কত ঝড় ঝাপ্টা চলে গেছে আমাদের উপর দিয়ে। আর মাত্র দুদিন তারপর আসবে সন্ধিক্ষণ। আমার জীবনের স্বপ্নপূরণ।

ভাবতে ভাবতে  একটু হারিয়ে গেছিলাম আমি। সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসছে।

২৯ মে চুড়ান্ত দিন। সেই দিন আত্মসমর্পণ করবে মাস্টার বাহিনী। সেই হিসেবে ২৮ মে দস্যুদের নিয়ে বন থেকে উঠে আসার কথা আমার। সেইভাবে ৱ্যাবের সঙ্গে পরিকল্পনা সাজানো ছিল। কথা ছিল ৱ্যাব তাদের লঞ্চ নিয়ে সুন্দরবনের ভদ্রা নদী পার করে একটা নির্ধারিত জায়গায় নোঙর করবে। আর আমিও দস্যুদের নিয়ে ট্রলারে করে এগোতে থাকবো ৱ্যাবের লঞ্চের দিকে। যেহেতু এলাকাটা ৱ্যাব ভাল করে না-ও চিনতে পারে তাই তাদের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নোঙর করতে বলা হয়েছে।

অনেক কিছু ভাবনা ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার মাথায়। সেই সময় ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। আমার জীবনের অন্যতম আশ্চর্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম আমি।

বলছি পরের পর্বে।

(ক্রমশ)