সুখেন্দু হীরা
(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)
ছেলেবেলায় একটা জাতকের গল্প পড়েছিলাম। দুই ফেরিওয়ালার গল্প। সেরিবান ও সেরিবা। সেরিবান ছিলেন সৎ ও নির্লোভ। সেরিবার ছিল অর্থ লালসা। একদিন তাঁরা অন্ধপুর নগরে বাণিজ্য করতে গিয়েছিলেন। সেখানে এক শ্রেষ্ঠী পরিবার ছিল। একদা তাঁরা বিত্তশালী ছিলেন। তখন তাঁদের অবস্থা তখন ভালো ছিল না। পরিবারে মাত্র এক বৃদ্ধা মহিলা ও তাঁর নাতি অত্যন্ত দৈন্যতার সঙ্গে বাস করতেন। বাড়িতে তাঁদের একটা সোনার পাত্র ছিল, যা ময়লা জমে, অব্যবহারের ফলে মামুলি ভাঙা বাসনে পরিণত হয়েছিলো।
তাঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে সেরিবা হেঁকে যাওয়ার সময় নাতনিটি গহনার বায়না ধরলে, বৃদ্ধা এই ভাঙা বাসন বদল করে একটি গহনা দিতে বলেন। সেরিবা পাত্রটি দেখে বুঝতে পারে, পাত্রটি সোনার। লোভী সেরিবা বলে এর দাম সিকি পয়সা নয়, সে বস্তুটিকে অবজ্ঞা ভরে ছুড়ে ফেলে চলে যায়। ভাবে পরে এসে সামান্য পয়সা দিয়ে নিয়ে যাবে।
ওই পথ দিয়ে পরে সেরিবান যাচ্ছিলেন। তাঁকেও একই কথা বলেন বৃদ্ধা। কিন্তু সেরিবান বলে এর দাম লক্ষাধিক। তাঁর কাছে থাকা ৫০০ মুদ্রা এবং সম মূল্যের পণ্য দিয়ে বাসনটি গ্রহণ করেন। কিছুক্ষণ পরে ফিরে লোভী সেরিবা ফিরে এসে সব শুনে হা হতাশ করে নদীর দিকে ছুটতে থাকেন। তখন সেরিবান মাঝ নদীতে। সেরিবা হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন।
এই গল্পের সার কথা ছিল লোভী হলে ঠকতে হবে। অর্থলালসা থাকা বা লোভী হওয়া দোষের নয়। সেই লালসা বা লোভ যেন অন্যকে না ঠকায় বা প্রতারণা করে। কিন্তু বাস্তবে দেখতাম প্রায় সমস্ত ব্যবসায়ীরা লোক ঠকায়।
ছেলেবেলায় যেখান থেকে আমরা রেশন তুলতাম, সেখান থেকে কোনও দিন সঠিক ওজনের মাল পেতাম না। যতই চোখের সামনে মেপে দিক না কেন, তাঁদের কাঁটার অর্থাৎ দাঁড়িপাল্লাতে কিছু ওজন কেটে রাখার ব্যবস্থা থাকত। যে দোকান থেকে আমরা কেরোসিন তেল তুলতাম, সেখানেও একই ব্যবস্থা। মগ আকৃতির মাপার পাত্রটি তলার দিক থেকে তুবরে পাত্রে ভিতরের দিক উঁচু করে রাখত, যাতে তেল কিছুটা কম ধরে। তারপর মাপার সময় দুটি আঙ্গুল এমন ভাবে ডুবিয়ে রাখতেন পাত্রের মধ্যে সেখানেও দোকানির কিছুটা তেল সাশ্রয় হতো।
এত দ্রুত মাপা হ’ত, আর পিছনে দীর্ঘ লাইন, এসব নিয়ে প্রতিবাদ করার কথা কেউ ভাবতেন না। তাছাড়া সমাজে এই একটু আধটু প্রতারিত হওয়া মানুষজন মেনে নেয়। অন্য কোনও কারণে তাদের উপর বীতশ্রদ্ধ না হলে বা কোনও উস্কানি না থাকলে এইসব ব্যবসায়ীদের ওপর জনগণ আক্রমণাত্মক হয় না।
অনেকে দাবি করেন, এই সব রেশন দোকানদার, কেরোসিন তেলের ডিলাররা ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ’ ও ‘মেইন্টেন্যান্স’ খরচের জন্য আলাদা করে কিছু পায় না, বা পেলেও সেটা যথেষ্ট নয়। এছাড়া এলাকার নানান বায়নাক্কাতো থাকেই। এই সবের জন্য তাঁদের গ্রাহকদের ন্যায্য পাওনা থেকে একটু কাটতে হয়।
ছেলেবেলা থেকে বাজার করতে গিয়ে দেখেছি সব্জিওয়ালা বা মাছওয়ালাদের ওজন করার কারসাজি। পাল্লার মাল ও বাটখারা তুলে মালের পাল্লাটিকে প্রথমেই আঙুল দিয়ে একটু টেনে নামিয়ে দিলেন। দ্রুততার সঙ্গে ব্যাপারটা করতেন যে, কিছু বোঝার আগে পাল্লার মালপত্র খরিদ্দারের থলেতে।
সবাই বলেন এবং ব্যবসায়ীরাও একান্তে স্বীকার করেন, যে পাল্লার মাল দেওয়া হবে সে পাল্লার আগে থেকে একটু টান থাকবে। আবার যে পাল্লার মাল গ্রহণ করা হবে, সেক্ষেত্রে দাঁড়ির বাটখারা রাখার পাল্লায় টান থাকবে, যাতে মাল গ্রহীতা ব্যবসায়ী বেশি মাল নিতে পারেন। যেমন ধান কেনার আড়ত, পুরনো খবরের কাগজ কেনার ফেরিওয়ালা।
এসব প্রতিরোধ করার জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা আছে। আছে ‘ওয়েট অ্যয় মেজার্স’ ডিপার্টমেন্ট, ‘ক্রেতা সুরক্ষা দপ্তর’। কিন্তু আমাদের এই বৃহৎ দেশে সব ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ করা কঠিন কাজ!
আমরা সবাই জানি “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী”। আবার এও জানি “বাঙালি বাণিজ্য বিমুখ।” বিমুখতার অন্যতম কারণ বলা হয়, আপামর জনতার ধারণা ব্যবসায়ীরা কমবেশি সকলেই লোক ঠকায়।
ঠকানোর ব্যাপারে সব থেকে এগিয়ে শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনের সামনের হকাররা। দু জায়গায় পণ্য বিক্রেতারা হামেশাই ক্রেতাদের ঠকায়। অনেকে বলেন, হাওড়ার থেকে শিয়ালদহের হকাররা ভালো। কারণ শিয়ালদহের হকাররা ওজনে কম দিলেও, হাওড়ার হকারদের মতো পচা বা নষ্ট পণ্য দেয় না। হাওড়ার হকাররা ভালো পণ্য দেখিয়ে ওজন করার সময় বা ব্যাগে ভরার সময় হাত সাফাইয়ের মাধ্যমে খারাপ পণ্য ভরে দেয়।
আরেকটি সুন্দর পন্থা হাওড়ার হকাররা অবলম্বন করেন— ধরুন আপনি কোনও ফল কিনছেন, সুন্দর সঠিক ফলগুলো বেছে দিলেন ওজন করার জন্য, এরপর সেই হকার ভাই সঠিক ওজন দেওয়ার জন্য একটি ফল নামিয়ে আরেকটি ফল তুলবেন। তাতে ওজন ঠিক হবে না। আরেকটি নামিয়ে আরেকটি তুলবেন। এভাবে আপনি যে ফলগুলো বেছে তুলেছিলেন, সে গুলো নামিয়ে ওনার পছন্দমত জিনিস তুলে দিয়েছেন এবং যার মধ্যে অধিকাংশ পচা বা পোকায় কাটা। এই রদ্দি মালগুলি তার পণ্যের এক পাশে থাকে, সেখান থেকে তুলে দিতে সুবিধা হয়।
এই ব্যবস্থাপনাটা শুধু হাওড়ার ক্ষেত্রে নয়, পাড়ার বাজারেও কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়। খরিদ্দাররা সকলেই প্রায় এই অভিযোগ করেন, ওজন সঠিক করার জন্য বিক্রেতা যে মালটা পাল্লায় তুলে দেন সেটা সর্বদা বাতিল মালই হয়।
ধর্মতলার হকারদের দরদাম বিখ্যাত। এমন দর তারা হেঁকে রেখে দেন, আসল মূল্য আন্দাজ পাওয়া মুশকিল। তবে এসবই ব্যবসায়ের কৌশল বলে খ্যাত। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রেতারাও আছেন, যারা দরদামে পটু। দরদাম করে কিনতে অনেকেই মজা পান। এগুলোকে সরাসরি প্রতারণা না বললেও, সাধারণ খরিদ্দাররা একটু হলেও ঠকেন।
পাড়ায় পাড়ায় আগে ‘সুন্দরবনের মধু’ বলে মধু ফেরি করতে আসত তালপাতার পাত্রের মধ্যে। টাকার উপর মধু ঢেলে, নীচ থেকে আগুন দিয়ে মধু জ্বাল দিত। কাগজের নোট পুড়ত না। বলেতেন এটা খাঁটি মধুর লক্ষণ। কিন্তু এটা একটা সাধারণ ও সহজ বিজ্ঞান। কিন্তু সাধারণ মানুষকে এ ভাবে বোকা বানাতেন মধু বিক্রেতারা।
আপেলকে চকচকে দেখাতে মোমের পালিশ দেওয়া, পটলকে নবীন দেখাতে সবুজ রঙে চোবানো, মরা মাছের কানকোতে লাল রং দিয়ে তাজা দেখানো, এসব জানেন না এমন খরিদ্দার কিন্তু কেউ নেই।
এখানে সব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মকাণ্ড বিবৃতি করা হল। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ড সাধারণত আমাদের চোখে পড়ে না। সে এসব নিয়ে পরে একদিন আলোচনা করা যাবে।
(ক্রমশ)
অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়