পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

।।এক।।

তেঘরিয়ার কাছে ভিআইপি রোডের উপর নামী গাইনিকলজিস্টের তৈরি এক প্রাইভেট হাসপাতাল। তার ঠিক পিছনটাতে স্থানীয় প্র্যাক্টিসিং ডাক্তারবাবুদের একটা কো-অপারেটিভ ফ্ল্যাট। হালে তৈরি। দু হাজার বাইশের এক হেমন্তের সন্ধ্যা। ফ্ল্যাটের ছ’তলা ছাদে মাঙ্কি ক্যাপ মাথায় ট্র্যাকস্যুট ও ট্র্যাকপ্যান্ট পরে হাঁটছেন নব্বই বছরের বৃদ্ধ রামদাস পুরোহিত। পায়ে নরম রাবারের জুতো। হাঁটার সময় সেটা গলিয়ে নেন রোজ। কুড়ি মিনিট লাগাতার হাঁটার পর পাঁচ মিনিট ফ্রিহ্যান্ড। শেষে সিঁড়ি ভেঙে টপফ্লোরে নামেন। সেখানে বড় ছেলে ডক্টর সুধাংশু পুরোহিতের ফ্ল্যাট। মেন দরজার বাইরে একপাশে দেওয়ালের গায়ে কাঠের তৈরি জুতো রাখার শেলফ। তার উপর বসেন তিনি। পা থেকে খোলেন রাবারের জুতো জোড়া। একটা কাপড় দিয়ে যত্ন করে মোছেন সে দুটো। নরম কাপড়ের একটা ক্যারিপ্যাকে মুখোমুখি ভরে শেলফের শাটার খোলেন। মাঝের তাকের একটা নিৰ্দিষ্ট জায়গায় রাখেন সে ক্যারিপ্যাকটা। শেষে ঘরের ঢুকে হাঁটার জামা কাপড় ছেড়ে লুঙি আর ফতুয়া পরে বসেন টিভির সামনে। পর পর এসব স্টেপে কোনও ভুল হয়না তাঁর। যেমন আজও হলো না। গত আড়াই বছর ধরে এই ফ্ল্যাটবাড়ির টপ ফ্লোরে ছেলে ও তার পরিবারের সঙ্গে থাকেন রামদাস পুরোহিত।
ঘরে ঢোকার পর বড় ছেলের স্ত্রী রনিতা এক কাপ দুধ চিনি দেওয়া কড়া সিটিসি চা আর কুচো নিমকির বাটি রাখল তাঁর সামনের টি টেবিলে। সে নিজেও সল্টলেকে এক বড় কর্পোরেট সংস্থার উঁচু পদের চাকুরে। চাকরিস্থল থেকে ফিরতে ফিরতে রাত হয়। আজ রোববার। তাই অফিস নেই। দ্রুত চা হাতে নিয়ে তাতে শব্দ করে একটা চুমুক দিয়ে রনিতার দিকে তাকিয়ে রামদাস জিজ্ঞাসা করলেন,
‘সুধাংশু ফেরেনি এখনও?’
‘সবে তো সন্ধ্যে ছটা। এখনই কি?’
শ্বশুরের দিকে না তাকিয়ে ক্যাজুয়ালি তাঁর কথার উত্তর দিলো রনিতা।
বহুদিন হলো রামদাসের একটাও দাঁত নেই । ষাট বছর বয়স থেকে একটা একটা করে পড়তে পড়তে সত্তরের মধ্যে খেলা শেষ। রাজ্য সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তিনি। পেনশন পান। কিন্তু সঙ্গতি থাকলেও খরচ করে দাঁত বাঁধানোর ইচ্ছে হয়নি কখনও। বলেন, ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট। ওই সত্তর বছর বয়স থেকেই মাড়ি দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় চুষে খান সবকিছু। এমনকি পাঁঠার মাংসও। সেভাবে শক্ত কুচো নিমকি চুষতে চুষতে রনিতার দিকে তাকিয়ে তিনি এবার এক গাল হেসে বললেন,
‘আজ তো রোববার। আজ অন্তত প্র্যাকটিসটা একটু সকাল সকাল শুরু করলেই তো হয়! বিকেলে বেরিয়ে সেই কানা রাত্তিরে ফেরার কি দরকার?’
‘এসব আমাকে না বলে আপনার ছেলেকে বলুন! আর তা ছাড়া পেশেন্টরা তো তার বাবা বা শ্বশুরের চাকর নয় যে যখন ডাকা হবে তখন আসবে! প্র্যাক্টিসিং ডাক্তারদের পেশেন্টের মর্জিমাফিক চলতে হয়।’
শ্লেষ মিশিয়ে শ্বশুরের কথার উত্তর দেয় রনিতা।
অনেক দিন হলো তার শ্বশুর এ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। এখন ঘরেরই মানুষ। আজকাল তাই সে আগের মতো অতখানি ফরমাল ভাবে কথা বলে না তাঁর সঙ্গে।
প্রথম প্রথম এসব খটখটে কথায় অসুবিধে হতো রামদাসের। এখন খানিক অভ্যস্ত হয়েছেন। হতে হয়েছে পরিস্থিতির চাপে। এসব তো হয়েই থাকে। বয়স হওয়া গাছকে অনেক ঝড়ঝাপটা সইতে হয়। তাই এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে তিনি চুপচাপ চোখ বুজে নিমকি-চা খেতে থাকলেন। তা ছাড়া কোনওদিনই কোনও মহিলার সঙ্গে মুখ লাগানো তাঁর পছন্দ নয়। যেমন কোনও পুরুষ মানুষের বাজে কথা সহ্য করাও নয়। এখন পরিস্থিতি ভিন্ন— সে কথা আলাদা।
রামদাস এক সময় নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। এখন যাকে বলে জিম, তাঁদের সময় তা ছিল ক্লাব। তাঁর ছোটবেলার শহর বহরমপুরে বুড়োশিবতলায় যখন তিনি ক্লাবে যেতেন তখন মেরেকেটে তাঁর বয়স কত হবে? সতেরো কি আঠেরো! হাইট বেশি না হলেও চেহারা পেশীবহুল ছিল। শরীরচর্চা শেষ হলেই, সকাল হোক, বিকেল হোক, গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফিরতেন। গঙ্গায় তখন জল ছিল না তত। অনায়াসে এপার ওপার করা যেত সাঁতার কেটে। সাঁতারে পটু তিনি সে যুগে অনেক ‘গঙ্গা বক্ষে সাঁতার’ প্রতিযোগিতা জিতেছিলেন। অজস্র সাঁতার না জানা মানুষকে বাঁচিয়েছিলেন ডুবে মরা থেকে।
সেই ছোটবেলা থেকে রামদাসের শরীরচর্চা বৃথা যায়নি বলতে হবে। এই বয়সেও সুগার প্রেসার না থাকাটা হয়তো জেনেটিক। পিতৃসূত্রে অর্জিত। বাবা মহাদেব যেদিন একশো নয় বছর বয়সে মারা যান, সেদিনও তিনি বাড়ির বাগানের ফুলগাছে জল দিচ্ছিলেন। সে বয়সেও তিনি জ্ঞাতসারে ছিলেন সম্পূর্ণ নীরোগ। কিন্তু শেষের দিকে মোটেও এখনকার রামদাসের মতো টগবগে ছিলেন না।
চিরকালের পিটপিটে, ন্যাগিং টাইপের মানুষ রামদাস। বউ সে কারণে মনে মনে বিরক্ত হলেও ভয়ে তা প্রকাশ করতেন না। ছেলে মেয়ের ক্ষেত্রে তো সে প্রশ্নই ওঠে না। সে স্বভাব অবশ্য আজও আছে। সঙ্গে ইদানীং হয়েছে গোটাদিন মোবাইলে সোশ্যাল মিডিয়া খুলে বসে থাকার নেশা। এ ব্যাপারে দেখে সংসারের কাজে দিশেহারা রনিতার ভয়ানক রাগ হয়। বয়স বাড়ার কারণে এখন কানে কম শোনেন, চোখে কম দেখেন রামদাস। তার সঙ্গে বেসিক্যালি শান্ত থাকলেও হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ইদানীং। প্রথম প্রথম সে সব অযৌক্তিক রাগকে প্রশ্রয় দিলেও এখন তাতে বিরক্ত হয় রনিতা, ক্ষেত্র বিশেষে সুধাংশুও।
সহনশীল স্ত্রী তাঁর স্বামীর বিভিন্ন কিসিমের জ্বালাতন সহ্য করতেই পারেন, কিন্তু ছেলে বা ছেলের বউ কেন তা করতে যাবে? সম্ভব? স্বাধীনচেতা স্পষ্টবক্তা রনিতা তাই মাঝে মাঝে রামদাসকে শুনিয়েও দেয় দু’কথা। তখন তাকে সামলানো দায় হয় সুধাংশুর পক্ষে। লকডাউন সাধারণ মানুষের আয় ইনকাম কেড়ে নিয়েছে অনেকখানি। বাড়িয়েছে অনিশ্চয়তা। ধৈর্য্য গিয়েছে সকলের। সঙ্গে অনেকেরই গিয়েছে মরালিটি আর ভ্যাল্যু। যে বাবা স্বল্প মাইনের সরকারি চাকরি করেও তাঁর ছেলেমেয়েদের মানুষ করাতে কোনও কার্পণ্য করেননি তাঁর প্রতি মাঝে মাঝে এমন আচরণে নিজেরও খারাপ লাগে সুধাংশুর। কিন্তু রনিতাকে দোষ দেবে কি, প্র্যাক্টিস কমার পর থেকে ধৈর্য্য অনেকখানি কমে গেছে তারও। তার উপর বাবার আবোলতাবোল বায়না মাঝে মাঝে বড্ড অস্থির করে তোলে তাকে। অসহায় লাগে তখন। মায়ের হঠাৎ মৃত্যুর পর কিছুদিন বহরমপুরে মেজ ছেলে প্রেমাংশুর ফ্ল্যাটে ছিলেন রামদাস। সেখান থেকে এখন চলে এসেছেন ডাক্তার বড় ছেলের কাছে। হয়তো বা শেষ বয়সে নিজের শরীরের কথা ভেবে। হয়তো বা অন্য কোনও কারণে। সুধাংশু তাতে আগ্রহ দেখায়নি। প্রথম দিকে মন না বসলেও এখন অবশ্য বড় ছেলের কলকাতার ফ্ল্যাটে থিতু হয়েছেন রামদাস।
থাকেন নিজের মতো। ছেলে বৌমা তাঁর কোনও কিছুতে ইন্টারফেয়ার করে না। তবুও মাঝে মাঝে খটামটি লাগে। বিশেষ করে ছেলের সঙ্গে। ছেলে ভাবে, আরও একটু বুড়ো হলে কিভাবে সামলাবে বাবাকে। আর বাবা ভাবেন, এখনই এই! এর পরে অ্যালজাইমার ও ডিমেনশিয়া হলে কি হবে তাঁর? ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেননি। এগুলো নেট থেকে জেনেছেন তিনি। ধুস! এইজন্যই বুড়ো হয়ে গেলে স্বাধীনচেতা মানুষ বৃদ্ধাশ্রমের কথা ভাবেন!

।। দুই।।

বড় হওয়ার, থিতু হয়ে জীবনে দাঁড়ানোর লড়াইটা রামদাসের জন্ম ইস্তক। সে অর্থে তিনি একজন সেল্ফমেড পার্সন। যা হয়েছেন, যতটুকু করেছেন জীবনে, সবই তাঁর একক কৃতিত্বে। তাঁর বাবা মহাদেব ছিলেন পুরোহিত। আসলে তাঁরা ছিলেন মুখোপাধ্যায়। এ উপাধি তাঁর কোনও এক পূর্বপুরুষের পাওয়া। শোনা যায়, তিনি সাধের যজমানি করতেন তল্লাটে, সে কারণে সরকার বাহাদুরের তাঁকে এই উপাধি দান। সেই থেকে চলছে। মহাদেব, তার বউ, ছয় ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে কাঁদির বাঘডাঙা থেকে অবিভক্ত বাংলার বহরমপুরে ছোট একটা বাড়ি কিনে চলে আসেন উনিশশো চল্লিশ সালে। মূল কারণ বাবার সঙ্গে বনাবনি না হওয়া। বিভিন্ন বিষয়ে অগাধ পান্ডিত্যের অধিকারী মহাদেব শহরে এসে সৈদাবাদের এক হাইস্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের চাকরি নেন। নামমাত্র মাইনে। সে টাকায় এত জনের সংসার চালানো প্রায় দুঃসাধ্য ছিল তখনও। কাজের অবসরে তাই নিজের বাড়িতে বসে ছাত্র পড়াতেন তিনি। পূর্বপুরুষের মতো এ বাড়ি ও বাড়ি যজমানি করেও সামান্য উপরি আয় হতো। এ সব অবশ্য একটানা করতে পারতেন না কখনও। কারণ তাঁর ছিল তাস খেলার নেশা। এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়ার নেশা। ফলে চাকরিতেও অনিয়মিত হয়ে পড়তেন মাঝে মাঝে। এভাবে অনেকবার চাকরি গেছে তাঁর। বহরমপুরে স্কুলের চাকরি যাওয়ার পর আজিমগঞ্জে একটা কলেজে ইংরাজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন মহাদেব। অবশ্য সে চাকরিও এক বছরের বেশি টেকেনি। শোনা যায়, বিশাল পরিবারে খরচ বাঁচানোর জন্য এক বিচিত্র উপায় বের করেছিলেন মহাদেব। ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের জন্য কূল্যে দু’সেট বাইরে পরার জামা-প্যান্ট, ঘরে পরার জন্য ছেলেদের গামছা ও মেয়েদের একটা করে সাধারণ ফ্রক-প্যান্ট, শীতে বাড়িতে পরতে সবার জন্য একটা করে খাদির চাদর আর বাইরে বেরোনোর জন্য প্রত্যেককে একটা করে সোয়েটার কিনে দিয়েছিলেন তিনি। শৃঙ্খলা শেখানোর ছুতোয় সকলের প্রাতকৃত্য সারাও বড় থেকে ছোট, বয়সের এই ক্রমানুসারে বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। দৈবাৎ আগে অন্য কারও বেগ আসলেও এর অন্যথা করা যাবে না। বাকিরা সিস্টেমের সঙ্গে মানিয়ে নিলেও রামদাসের একদম ভালো লাগত না এই কঠিন অনুশাসন। তিনি বুঝেছিলেন, এ খাঁচা থেকে বেরোতে হলে উপার্জন করতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। মহাদেব নিজের সাধ্যে পড়াশোনা করিয়ে তো ম্যাট্রিক পার করে দিয়েছিলেন রামদাসকে। পরের লড়াইটা ছিল তাঁর একদম একার। টিউশানি করে নিজের খরচ চালিয়ে একে একে আইএ, বিএ এবং পিজিবিটি পাশ করেন রামদাস। তারপরে পর পর জেলার এক গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা, দার্জিলিংয়ের রামকৃষ্ণ মিশন হাইস্কুলের শিক্ষকতা এবং শেষে হুগলির এক সরকারি হাইস্কুলের পাট চুকিয়ে অবিভক্ত মেদিনীপুরের দেউলি বিশ্বনাথপুরে জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক হিসেবে নতুন চাকরিতে ঢোকেন তিনি। ট্রান্সফারের এই চাকরি আর পরিবর্তন করেননি। সেই সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কলেজের বিভিন্ন শাখায় কাজ করেছেন তিনি। প্রথম পোস্টিংয়ের সময় বিয়ে করেন বাবা মহাদেবের পছন্দ করা তাঁর থেকে চোদ্দ বছরের ছোট মাধবীকে। বহরমপুরের এক মুদির দোকানির মেয়ে মাধবী। বিয়ের পরেও চাকরির সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে গেছিলেন রামদাস। এমএ পাশ করেছেন চল্লিশ বছর বয়সে। ততদিনে তিনি দুই ছেলে এক মেয়ের বাবা। অধ্যাপক— এই গাল ভরা নামের সঙ্গে অবশ্য মাস মাইনেটা থলে ভরা ছিল না তাঁর। ফলে মাসের অর্ধেক যেতে না যেতেই টানাটানি পড়ত অর্থের ভাঁড়ারে। বুদ্ধিমতি ও সংসারী মাধবী তখন নিপুণ হাতে সব কিছু চালিয়ে নিতেন। কলেজগুলো ছিল প্রকৃতির কোলে, সবুজের মধ্যে। দূষণের বালাই না থাকায় ছেলেমেয়েদের ভোগান্তি , চিকিৎসা খরচ ছিল না— এই যা রক্ষে। রামদাসের ছেলেমেয়ে সুধাংশু, প্রেমাংশু আর বীণা পড়াশোনায় ভালোই ছিল। প্রাইভেট টিউটর ছাড়া নিজেদের চেষ্টায় বড় হয়েছে সব। কালক্রমে বড় জন ডাক্তার ও বাকি দুজন স্কুল টিচার হয়েছে। ছেলেমেয়েদের নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর প্রধান কৃতিত্ব যে মায়ের— সেটা সর্বত্র বলে বেড়ান বাবা রামদাস। সত্যিই তাঁর মতো সংসারে থেকেও সংসার বিবাগী লোকের যদি এমন একটা বউ না জুটত, তাহলে যে বাচ্চাগুলোর দশা কি হতো তা বোধহয় একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।
হয়তো বা সে কারণেই রামদাসের সংসারে তিনি নিজে বাইরের মানুষ হয়ে রয়ে গেছিলেন। ছেলেমেয়েদের সুখদুঃখ অভাব অভিযোগের গল্প সবই হতো মাধবীর সঙ্গে। তাদের মায়ের প্রতি এই নির্ভরশীলতা ছিল বহুদিন পর্যন্ত, আরও সঠিক ভাবে বলতে গেলে বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত। প্রায় সব সংসারে এই একই নিয়ম। বিয়ের পরে ছেলেমেয়েরা কেমন যেন ছোট থেকে বড় হয়ে যায়। যেমন বীণা রেলের চাকুরের সাথে বিয়ের পর, প্রেমাংশু স্কুল টিচার রাধার সাথে বিয়ের পর হয়ে গেল। বীণার নতুন ঠিকানা হলো খরদা আর প্রেমাংশু উঠে গেল বহরমপুরেরই স্কোয়ার ফিল্ডের কাছে তার ফ্ল্যাটে। রামদাস ও মাধবী মনের দিক থেকে একা হয়ে পড়লেন।

।। তিন।।

রামদাসের শরীরটা আগে যতখানি সুগঠিত ছিল এখন ততখানিই পাতলা হয়েছে। প্রায় সব চুল উঠে যাওয়ায় তাঁর মাথাটা তুলনামূলক ভাবে বড় লাগে। দেখলেই মনে হয় যেন কোনও কঠিন রোগ থেকে উঠলেন সদ্য। যদিও বয়সজনিত খুচখাচ ঠান্ডা লাগা ছাড়া আর বিশেষ কোনও সমস্যা এখনও নেই। ছ’মাস পর পর একটা করে রক্ত পরীক্ষা হয়, ইসিজি হয়। সে সব ঠিক আছে একদম। হার্ট, লাঙ, লিভার, কিডনি , ব্রেন সবকিছু ফার্স্টক্লাস। বরং সুধাংশুর শারীরিক সমস্যা যতটুকু বা আছে, রামদাসের তাও নেই। খাবারদাবার নিয়ে খুবই সিলেক্টিভ ও শৌখিন তিনি। প্রথম থেকেই ভাত পারতপক্ষে ছুঁয়ে দেখেন না। তবে ভাজাভুজি, পোলাও, বিরিয়ানি, পরোটা, লুচি, বিভিন্ন রকম মিষ্টি— এ সবে তার মোটে আপত্তি নেই।
ছেলে এসব ছোটবেলা থেকে দেখতে অভ্যস্ত হলেও রনিতার স্বাভাবিক ভাবেই চোখ লাগে। মাঝে মাঝে তাই বলে,
‘বাবা,অত ভাজাভুজি, মিষ্টি একসঙ্গে খাবেন না।’
‘কেন তোমাদের বেশি খরচ হয়ে যাবে?’
রসিকতার ঢঙে রামদাস কথাটা বললেও তাতে সুস্পষ্ট শ্লেষ জড়িয়ে থাকে। এক্ষেত্রে পাল্টা আক্রমণ না করে বুদ্ধিমতি রনিতা বলে,
‘আহা, আমি কি তাই বলেছি? পয়সা খরচ হওয়ার থেকেও ইম্পরট্যান্ট হলো শরীর। এই বয়সে খাবারদাবার সংক্রান্ত অনিয়মে তা বিগড়োলে আপনার আমাদের উভয়েরই চাপ।’
‘তুমি পারোও বটে বৌমা। নব্বই বছর বয়সে আবার নিয়মকানুন কি! এক পা তো বাড়িয়েই বসে আছি, কখন উনি টেনে নেন।’
‘মানলাম। বারণও করছি না কিছু। তবুও একটু কম খেলে আরও কিছু বেশী দিন ধরে খেতে পারতেন এই বলছিলাম আর কি!’
‘এখন আর কোনও সাধ অপূর্ণ রাখতে চাই না বুঝলে কিনা! ছেলেমেয়েদের বড় করতে গিয়ে, তোমার মায়ের স্বাচ্ছন্দ্য দেখতে গিয়ে এতদিন নিজের ছোট ছোট চাহিদা, ভালোলাগা উপেক্ষা করেছি। তাই বাকি যে ক’দিন আছি সব অতৃপ্তি দূর করতে চাই। যাবতীয় সাধ-আহ্লাদ পূরণ করতে চাই শেষবেলায়, যদি শরীর, মন সাথ দেয়। মনের আমার কোনও রকম অক্ষমতা নেই। শুধু শরীর ব্যাটাই বেইমানি করে মাঝে মাঝে।’
‘কে বলেছিল বয়সকালে নিজের ইচ্ছেগুলোকে এতখানি বঞ্চিত করে বুড়ো বয়সে এসে সবকিছু পাওয়ার জন্য ফেরোসাস হয়ে উঠতে?’
অনুযোগ করে রনিতা।
‘ভুল করছ বৌমা। শুধু যে কর্তব্যের খাতিরে নিজেকে উপেক্ষা করেছি, তা তো নয়! সঙ্গতিই বা কতটুকু ছিল যে নিজেকে তৃপ্ত রাখব? বয়সকালে অভাবের তাড়নায় কোথাও বেড়াতে যেতে পারিনি। তীব্র ইচ্ছা হলেও একটা আপেল পর্যন্ত কিনে খেতে পারিনি। এখন তো সাধ থাকলেও বয়স আর অতিমারির কারণে ঘরের বাইরে বেরোনোর কোনও উপায় নেই। সুতরাং বাকি যা কিছু তা নিংড়ে নিয়ে বাঁচব না কেন এখন?’
‘এত কিছু করে, এত ত্যাগ স্বীকার করেও কি জীবনে পুরোপুরি তৃপ্ত আর সুখী হতে পেরেছেন বলে মনে করেন বাবা?’
‘তৃপ্তি তো একটা মিথ বৌমা। সুখ তো সোনার পাথরবাটি। এখন আর ও সব অলীকের পিছনে ছুটি না আমি। শুধু হাতের কাছে ভালো থাকার ভালো লাগার যে উপায়গুলো আছে সেগুলোকে আঁকড়ে ধরি।’
‘এতে অন্যরকম ফ্রাস্ট্রেশন হয় না? মনে হয় না বুড়ো বয়সে এসেও একই রকম রয়ে গেলেন? শুধু স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে বাঁচা? কখনও মনে হয় না বাড়ির অন্যরাও আপনার সময় পাওয়ার অপেক্ষায় থাকে? এক্সপেক্ট করে তাদের সঙ্গে সময় কাটান, ইন্টারঅ্যাকশন করুন !’
‘আমি ইন্টারঅ্যাকশন করতে চাই না? হাসালে দেখি! তোমরাই তো এখন ছুটছ সর্বদা। ছুটছ অলীক উন্নতি আর নিজেদের আরও বেশি গোছানোর তাগিদের পিছনে। এতে অবশ্য দোষ দিই না তোমাদের, কারণ আমি নিজেও এক সময় করেছি এ কাণ্ড। কিন্তু চাহিদার কি কোনও শেষ আছে, না উচ্চাকাঙ্ক্ষার সীমারেখা আছে? এক সময় আমি যে ভুলগুলো করে জীবনের রঙিন বছরগুলো নষ্ট করেছি, এখন তোমাদেরও তাই করতে দেখে কষ্ট হয় কেবল।’
‘তাই যদি মনে হয়, তাহলে সাবধান করেন না কেন আমাদের? বাধা দেন না, রাগ করেন না কেন নিজেদের নষ্ট করছি বলে? আমরা তো আপনারই সন্তানসন্ততি তাই না?’
‘বিশ্বাস করো, এ সবই করতে চাই। কিন্তু বিবেক এসে টেনে ধরে পিছন থেকে। বলে, সারা জীবন তো শুধু বারণই করে গেলি ছেলেমেয়েদের। এখনও সেই একই কড়াকড়ি। তোর স্বভাব পাল্টাবে কবে! আর তা ছাড়া..’
‘তা ছাড়া…?’
‘তা ছাড়া কত আগে থেকেই কমান্ড করার অধিকার হারিয়ে বসে আছি আমি। ছোটবেলাতে কাজের অছিলায় একফোঁটা যাদের কাছে থাকতে পারিনি, তাদের কাছে দাবি করব কি করে, এখন তোরা আমার কাছে থাক! তারা শুনবে কেন?’
বলতে বলতে আবেগে অভিমানে গলা বুজে আসে রামদাসের।
হঠাৎ করে এ কথার কোনও উত্তর খুঁজে পায় না রনিতা। নিজের ভিতরটা হাতড়াতে থাকে অসহায়ের মতো। পরিস্থিতি থমথমে হয়ে গেছে বুঝতে পেরে তা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন বিচক্ষণ রামদাস। হালকা চালে বলে,
‘তোমার হোয়াটসঅ্যাপে আজকের লেখা একটা কবিতা পাঠিয়েছি। পড়ে দেখো কেমন হয়েছে। আর মন্তব্য করো। মন ছুঁয়ে গেল, দারুন, দুর্দান্ত এমন মন্তব্য নয়, যাতে বলতে না পারি, ওহে বাচাল পাঠক! না পড়ে কিছু মন্তব্য করতে নেই।’
রনিতা তার শ্বশুরকে যত দেখে ততই অবাক হয়। অনুভব করে, একটা মানুষ নিজেকে কতখানি একলা ও বিচ্ছিন্ন ভাবলে সবসময় মোবাইলে মুখ গুঁজে বসে থাকে, যা দেখে তাদের ছেলে— ষোল বছরের টাবুন মোবাইল ঘাঁটার সময় তাঁর পশ্চার দেখে বলে, ওই দেখ লোকনাথ বাবা!

।। চার।।

রামদাসের শ্বশুরবাড়ি বহরমপুর শহরের এক প্রান্ত গৌরাঙ্গতলায়। অবসর নেওয়ার বছর দশেক আগে সে বাড়ির তিনটে বাড়ি পরে দু’কাঠা জায়গা কিনে রেখেছিলেন তিনি। কিনেছিলেন অবশ্য তখনও জীবিত তাঁর শ্বশুরমশাই রাধাকান্তের বুদ্ধিতে। সে ছিল জলা ও নিচু জমি। শ্বশুরমশাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাটি ফেলে ভরাট করে তাতে একটা বাস করার মতো একতলা কাঠামো তৈরি করান। সুতরাং অবসর যাপন প্রথম দিন থেকে নিজের বাড়িতে শুরু করতে পেরেছিলেন রামদাস। ষাট বছর বয়সেও তিনি যেন ছিলেন টাট্টু ঘোড়া। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণে কর্তৃপক্ষ সবার ক্ষেত্রে কেন যে বয়সকে শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার মাপকাঠি ধরেন কে জানে!
বাড়িটা মেন রোডের পাশে। দু’কাঠা’র পিছনের এক কাঠায় ছোট বাগান। তাতে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারকেল আর লিচু গাছ। আশ্চর্যজনক ভাবে তাঁরা বাড়ি ঢোকার আগেই ফলবতী হতে শুরু করেছিল সবগুলো। সকাল বিকাল জানা অজানা পাখি এসে বসে সে সব গাছে। দূষণ নেই। তবু মন মানে না রামদাসের। সমুদ্রের মাছ পুকুরে এসে পড়লে যে দশা হয়, অবসরের পর তাঁর দশা হয়েছে খানিকটা তেমন। চিলতে গাছগাছালির শহুরে আস্তানায় কি ভাবে মন বসানো সম্ভব সে মানুষের পক্ষে যাঁর আস্ত চাকরিজীবনটা কেটেছে নিবিড় সবুজের মধ্যে! সুতরাং চাকরি শেষের প্রথম দিন থেকে আবার সেই মুলস্রোতে কাজে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন রামদাস। ফলে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবসরে পাওয়া টাকার অনেকখানি ঢেলে তৈরি করলেন প্রাইভেট জুনিয়র বেসিক ট্রেনিং কলেজ ‘ঈশ্বর’। প্রথম দুটো সেশন ছাত্র পেলেও শেষ পর্যন্ত প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতার কারণে তা আর জুটল না, ফলে কলেজ চালানো গেল না শেষপর্যন্ত। সরকারও তা অধিগ্রহণের আগ্রহ না দেখানোতে রামদাসকে ক্ষতি স্বীকার করে জলের দরে বিক্রি করে দিতে হলো সবকিছু। সে সময়টা সুধাংশুর বিয়ে হয়ে গেছে। সে ডাক্তারি পাশ করে উচ্চশিক্ষা শেষে কলকাতায় থিতু হওয়ার লড়াই চালাচ্ছে। বাড়িতে বাবা মা’র সঙ্গে অবিবাহিত, এমএসসি পাশ করে সদ্য এক মিশনারি স্কুলের চাকরিতে ঢোকা মেজ ছেলে প্রেমাংশু। রামদাস বোহেমিয়ান নেচারের মানুষ। বাড়িতে মন বসে না তাঁর। এদিক ওদিক টিউশনি করে বেড়ান। অকারণে ঘোরেন ফেরেন বাইরে বাইরে।
স্ত্রী মাধবী অত্যন্ত কর্মঠ ও বুদ্ধিমতী। বই ও পড়াশোনা পাগল পরিচ্ছন্নতা বোধহীন রামদাস লাগাতার নোংরা করেন ঘরদোর, আর সামান্য আয়োজন ও অসামান্য শ্রমে তা ঝকঝকে তকতকে রাখার চেষ্টা করেন তিনি।
কিন্তু এ লড়াই আর বেশিদিন করতে পারলেন না মাধবী। পিতৃসূত্রে পাওয়া ব্রংকিয়াল অ্যাস্থমা তো ছিলই। তার সঙ্গে মাঝ বয়স নাগাদ যোগ হলো হার্ট ভাল্ভের রোগ। ডাক্তার বললেন, এ হলো আগে হওয়া রিউম্যাটিক ফিভারের ফলশ্রুতি। যার কারণে নৈমিত্তিক কাজকর্মে তাঁর শারীরিক সক্ষমতা কমতে কমতে একেবারে শূন্যতে এসে দাঁড়াল। তাঁকে কলকাতায় এনে কার্ডিওথোরাসিক সার্জন দেখালো সুধাংশু। সার্জন আর দেরি করলেন না। যাবতীয় ইনভেস্টিগেশন সেরে তড়িঘড়ি সার্জারি করে তাঁর হার্টের মাইট্রাল ও অ্যায়োর্টিক ভাল্ভ পাল্টে সেগুলোর জায়গায় সিন্থেটিক ভাল্ভ বসিয়ে সে যাত্রা বাঁচালেন তাঁকে।
কিন্তু এর পর থেকে মাধবীর কাজ করার ক্ষমতা ও হাঁটাচলার মধ্যে সীমাবদ্ধতা এলো। সবকিছু গোছগাছ করে রাখা আর তাঁর ক্ষমতায় কুলালো না। বাড়ির প্রতিটি আনাচকানাচ ভরে উঠল নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর আবর্জনায়।
রামদাস নিজেকে দেখভাল করাতেও একেবারে অচল। এক গ্লাস জল গড়িয়ে খেতেও তাঁকে নির্ভর করতে হয় মাধবীর উপর। মাধবী নিজেও এতদিন পর্যন্ত রামদাসকে নিজের কাজ নিজে করতে দেননি। ফলে এই পরিস্থিতিতে তিনি পড়লেন আতান্তরে। তাঁর অবস্থা হলো একদম কাছা খোলা। শুধু তাই নয়। মাঝে মাঝেই মাধবীর শারীরিক সমস্যা লেগেই থাকে। আর তাঁর সেবাশুশ্রষা করতে রামদাস ঘেমে নেয়ে একসা হন আর চোটপাট করেন মাধবীকে। একে অসুস্থতা তার উপর রামদাস, দুই মিলে মাধবীর অবস্থা হয়ে উঠল অবর্ণনীয়। বহরমপুরে এসে পরিস্থিতি দেখে রনিতা সুধাংশুকে বলল, যত্নআত্তি নয়। মা যা করেছেন বাবার জন্য এতে বাবা কেবল অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছেন।

।।পাঁচ।।

রামদাসের পড়ার ও পড়ানোর অভ্যাসটা শেষ পর্যন্ত চলে গেল। না গিয়ে উপায় ছিল না অবশ্য। যে শহরের উপর ভিত্তি করে মানুষের রুটি-রুজি, বেঁচে থাকা, শেষ বয়সে সে শহর ছাড়তে হলে অন্য কিছু করার থাকে না। তবু প্রথম দিকে চেষ্টা করেছিলেন রামদাস, যদি ভিন্ন দেশে এসেও নিজের ভালোবাসার পেশায় থিতু হওয়া যায়। সুধাংশুদের ফ্ল্যাটের পাশেই বৌদ্ধদের একটা আশ্রম আছে। সুধাংশু তার আবাসিকদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার দিকটা দেখে। সেখানে বিভিন্ন জেলার বেশ কিছু অনাথ শিশু নিয়ে স্কুল চালান আশ্রম কর্তৃপক্ষ। পড়াশোনার সাথে সাথে বিভিন্ন ভোকেশনাল ট্রেনিং দিয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফেরানোর চেষ্টা করা হয় তাদের। সে সব অনাথ শিশুদের পড়ানোর জন্য মাস ছয়েক আশ্রমে যাতায়াত করেছিলেন রামদাস। কিন্তু পরে তিনি বুঝতে পারেন সে বড় দুরূহ কাজ। তাঁদের মতো মানুষ, যাঁরা প্রথম থেকে বড়দের পড়িয়ে এসেছেন, তাঁরা শিশুদের শান্ত ভাবে এক জায়গাতে কি ভাবে বসাবেন সেটাই মস্ত চ্যালেঞ্জ। বুড়ো বয়সে নতুন করে তা শেখাও সম্ভব না। সুতরাং যেটুকু করছিলেন তার সবটাই হচ্ছিল তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে। কিন্তু মাঝখানে বিশ্ব জুড়ে করোনা অতিমারির কারণে সে যাতায়াতও বন্ধ করতে হলো তাঁকে, এবং আক্ষরিক অর্থেই তিনি ঘরবন্দি হয়ে পড়লেন। সেই যে ঘরে থাকার অভ্যাস হলো, পরিস্থিতির উন্নতি হলেও তার থেকে আজ পর্যন্ত বেরোতে পারলেন না রামদাস। মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় তিনি কোনওদিনই স্বচ্ছন্দ্য ছিলেন না। এ পরিস্থিতির পরে ক্রমশ তিনি আরও বেশি কোণঠাসা ও অসামাজিক হয়ে উঠলেন। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। তার বদলে খেয়েদেয়ে, সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে হারিয়ে গিয়ে আর ঘুমিয়ে থেকে বেঁচে থাকেন। আসলে সমাজের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বেঁচে থাকাটা অভ্যেস করে ফেলেছেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁকে। করোনা পরবর্তী পৃথিবী কত বয়স্ক মানুষকে যে এভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বড় ছেলে সুধাংশু ব্যস্ত মানুষ। সে শুধু ডাক্তারই নয়। একজন লেখকও। অসহায়, উপেক্ষিত গরিব-গুর্বোদের কাছে সে ডাক্তারির মানবিক মুখ। খেয়াল রাখে তার লেখনী যেন নীতিহীন মানুষের অসততা, অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে ওঠে। সমাজের কাজে আসে। তাছাড়া পড়াশোনার কারণে সুধাংশু উনিশশো বিরাশির পর থেকেই ঘর ছাড়া। কলকাতার বাসিন্দা। আধুনিক পৃথিবীর প্রাপ্তমনস্কতাকে হৃদয়ের সঙ্গী করে সে এখন একজন মাথা উঁচু করা সৎ নাগরিক। তার সঙ্গে মননে চিন্তায় রামদাসের আগেও মিলত না, এখনও মেলে না।
ছোট ছোট ব্যাপারে বাবা ছেলের মধ্যে খটামটি লেগেই থাকে। যেমন এই দু’দিন আগেই লাগল। ব্যাপারটা আর কিছুই না। রামদাসের মোবাইল রিচার্জ শেষ হয়ে যাওয়ার ফলে সমাজিক মাধ্যমগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাতেই লাগাতার সে কথা জানিয়ে সুধাংশুকে অস্থির করে তুললেন তিনি। সুধাংশু এমনিতে কর্তব্যনিষ্ঠ, দায়িত্বশীল মানুষ। কেউ তাকে কোনও কিছুর দায়িত্ব একবার দিলেই তা পালনে খামতি থাকে না। কিন্তু বার বার ন্যাগ করলে খুব অসুবিধা হয় তার। অসহায় লাগে। সুতরাং উপর্যুপরি তিনবার যখন তাকে মোবাইল রিচার্জ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা মনে করালো রামদাস, তখন সে হঠাৎ করে মেজাজ হারালো। অসহিষ্ণু গলায় বলল,
‘ এক বেলা মোবাইল না ঘাঁটলে তুমি এমন পাগল হয়ে যাও কেন? অদ্ভুত! লাইব্রেরি রুমে কত বই আছে। একটু পড়লেও তো পারো! বলেছ তো একবার। একটু সময় দাও আমাকে!’
সুধাংশু সাধারণত এমন আচরণ করে না রামদাসের সাথে। ফলে ছেলের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত উষ্মায় রামদাস হঠাৎ কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন। কিছু সময় কোনও ভাষা ফুটল না তাঁর মুখে। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন,
‘বাবা, তোরা ব্যস্ত মানুষ। তোদেরকে বিরক্ত করতে আমার ভালো লাগে না। কিন্তু কি করি। আমি তো নাচার। বেকার । মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া এই হচ্ছে এখন আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন। তার থেকেও যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই তাহলে বড় অসহায় লাগে। তোরা বুঝবি না আমাদের মতো মানুষের বিপন্নতা।’
সুধাংশু বুঝল, রামদাস তার অতি সাধারণ এ উষ্মাকে তার তাঁর প্রতি উপেক্ষা ও বঞ্চনা ভেবে অভিমানী হয়েছেন। তাই ড্যামেজ কন্ট্রোলের জন্য সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পিঠে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
‘এরকম মোটেই নয় বাবা। তুমি সাধারণ একটা ব্যাপারকে সিরিয়াস ভেবে মন খারাপ করছ। রিচার্জের জন্য আমি তো ফোন করেই দিয়েছি মোবাইল শপে। অন লাইনে তো আমি সড়গড় নই তত।’
ততক্ষনে রামদাসও নিজেকে সামলে নিয়েছেন কিছুটা। সুধাংশুর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন,
‘রোল রিভার্সাল। রোল রিভার্সাল। ছোটবেলার বাবা ছেলের সম্পর্ক ছেলে বড় হলে উল্টিয়ে যায়। তখন ছেলে বাবা আর বাবা ছেলে হয়ে যায়। বয়সের কারণে অধৈর্য্য অসহিষ্ণু হয়ে যাওয়া বাবাকে তখন ক্ষেত্রবিশেষে ধমকও খেতে হয় ছেলের কাছে। এর মধ্যে অস্বাভাবিকত্বের কিছু নেই।’
সুধাংশু বেদম লজ্জা পায়, বিব্রত হয় মনে মনে। কিন্তু মনের ভাব গোপন রেখে বলে,
‘কি যে বলো না! আমি হব তোমার বাবা! ভারী ক্ষমতা আর যোগ্যতা আমার!’
এবার বাবার ছেলেকে বোঝানোর পালা। গম্ভীর কোনও কিছুর প্রসঙ্গে এলে ছেলেমেয়েদের প্রতি সম্বোধনে তুই থেকে তুমিতে চলে যান রামদাস। বললেন,
‘নিজের ক্ষমতা আর যোগ্যতাকে তুমি ছোট করে দেখাও— সে তোমার বিনয়। কিন্তু আমি তো জানি আমার ছেলে কি!’
কথাবার্তার মধুর সমাপন হয় এভাবে। রামদাস মনে মনে ভাবেন, ছেলের বড্ড কাজের চাপ। আর সুধাংশুর অনুশোচনা হয়। মনে মনে সে ভাবে, বাবা মা’র সঙ্গে এভাবে কথা বলে কেউ!
কিচেন থেকে রনিতা হাঁক পারে, ‘চা ব্রেকফাস্ট রেডি।’
দু’জনে গুটি গুটি রওনা দেয় খাবার টেবিলের দিকে।

 

।। ছয়।।

এ রকম ভাবে তো মরে মরে বাঁচা যায় না! তাই অপারেশন সেরে বহরমপুর ফেরার ছ’মাসের মাথায় আবার কলকাতায় চেক আপে আসার ব্যপারে মনস্থ করলেন মাধবী। সবকিছু নতুন করে পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার। যে মানুষটা সব সময় হাত পায়ের উপর থাকত তার এরকম শয্যশায়ী হয়ে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়।
একদিন সকালে মাধবী তাই রামদাসকে বললেন সে কথা।
রামদাস চা খেয়ে সদ্য বসেছিলেন স্টাডি টেবিলে। বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন,
‘সেই ভালো।’
‘তাহলে সুধাংশুকে একটা খবর দাও। সে ব্যবস্থা করুক সবকিছুর।’
‘সে তো করব। তার আগে তুমি ঠিক করো কবে যেতে পারবে। তোমার তো আবার হাজারটা পিছুটান।’
‘একজন ভোলেবাবার মতো কাল কাটালে আর একজনের পিছুটান বাড়ে। বাজে কথা বলে লাভ নেই।’
ঝটিতি উত্তর দেয় মাধবী।
‘বাবারে বাবা! কথা মাটি থেকে পড়তে দেয় না!’
‘কথা চাইছ না তো কথা বলো না। একদিন যখন একদম চুপ করে যাব তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল।’
একই রকম গজ গজ করতে করতে আক্রমণাত্মক গলায় মাধবী উত্তর দেন।
রামদাস ভয় পান। বুঝতে পারেন মাধবীর শরীরটা সত্যিই বিগড়েছে। নয়তো কথার পিঠে কথা বলার মানুষ তিনি নন।
ট্রেনের টিকিটের ক্রাইসিস ছিল। তবু ভিআইপি কোটায় ভাগীরথী এক্সপ্রেসে এসি ফার্স্টক্লাসের টিকিট করে রামদাস মাধবীকে নিয়ে দুহাজার উনিশের পনেরই অক্টোবর তেঘরিয়ায় বড় ছেলের ফ্ল্যাটে এসে উঠলেন। তাকে দেখেই মায়ের অর্ধেক রোগ সেরে যেত আগে। কিন্তু এবার সে রকম কিছু ঘটল না। ফুর্তিবাজ ইতিবাচক মানসিকতার মাধবীর এ যাত্রা কলকাতায় এসেও ভগ্ন শরীরে বিষন্নতা নিয়ে দিন কাটতে থাকল।
কার্ডিওলজিস্ট ইকো ইসিজির রিপোর্ট সমেত মাধবীকে দেখে বললেন,
‘ভাল্ভ রিপ্লেসমেন্টের পর ষাটোর্ধ মানুষ হাঁটা-চলা কাজ-কম্মে যেমন থাকেন মাধবী তেমনই আছেন। তাঁর যদি এক্সপেক্টেশন থাকে এ সব নিয়ে তিনি কিশোরীর মতো দৌড়ে বেড়াবেন তাহলে সেটা তাঁর এক্সপেক্টেশনের সমস্যা। শরীরের নয়।’
‘কিন্তু ডাক্তারবাবু, আমার স্বামী তো কিছুই পারেন না। আমি এরকম বসে গেলে তাঁর দেখভাল করবে কে?’
সুধাংশুর বদলে মাধবী হঠাৎ উতলা হয়ে প্রশ্ন করে বসেন ডাক্তারবাবুকে।
‘এর উত্তর তো চিকিৎসাবিজ্ঞান দিতে পারবে না মা। আপনি বরং সমাজবিজ্ঞানীদের প্রশ্ন করুন। অথবা আপনার স্বামীকেও প্রশ্ন করতে পারেন, কেন উনি একটুও স্বাবলম্বী নন। পুরোটা আপনার উপর নির্ভরশীল। কেন আপনাকে মরে মরেও ওনার সবকিছু করতে হবে।’
‘না না। উনি এখন আপ্রাণ চেষ্টা করেন যদি নিজের কিছুটা অন্তত করে নেওয়া যায়। ঘরে বাইরে মিলে খুব অসহায় অবস্থা ওনার। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে আমিও ক্রমশ বোঝা হয়ে উঠছি সংসারে। এ বাঁচা বেঁচে লাভ কি ডাক্তারবাবু!’
‘এতদিন তো আপনিই সব করেছেন। করেন নি কি? এখন একটা শারীরিক সমস্যা বাধিয়েছেন যাতে আপনার কোনও হাত নেই। তাতে আপনাকেই অপরাধবোধে ভুগতে হবে কেন তা তো আমি বুঝতে পারছি না! হার্টের সমস্যা তো আছেই, সঙ্গে ফুসফুসের সমস্যাটাও বেড়েছে। সুতরাং নিজের যত্ন নিতে শিখুন এখন থেকে। ‘
এ ছাড়াও আরও একটা সমস্যা হচ্ছিল মাধবীর। তাঁর পিঠে শিরদাঁড়ার পাশ দিয়ে একটা ব্যাথা হচ্ছিল মাস ছয়েক আগে থেকে। সেটা নিয়ে অর্থোপেডিক সার্জেনের কাছে যাওয়াতে তিনি পরীক্ষা করে বললেন শরীরে ভিটামিন ডি-র অভাব। তার সঙ্গে বয়সের কারণে হাড়ও নরম হচ্ছে। এই দুইয়ে মিলে বিপত্তি। নিয়মিত ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি খেতে হবে। মিল্ক প্রোডাক্ট খেতে হবে। শরীরে রোদ লাগাতে হবে।
অর্থাৎ সংক্ষেপে যা দাঁড়ালো তা হলো, যা হয়েছে তা আর সারবে না। নিত্যদিনের সঙ্গী হবে বাকি জীবন।
এদিকে রামদাস অস্থির হয়ে পড়লেন নিজের ঠিকানায় ফেরার জন্য। গোটা জীবন জেলায় জেলায় ঘুরে অবসরের পর নিজের ভিটে ছেড়ে তিনি আর কোথাও যেতে চান না। শেষ জীবনের বাড়ি। তাতে পুরোনো স্মৃতির প্রাচুর্য নেই, তবুও নিজের তৈরি তো! বাড়ি তো নয়, যেন নিজের সন্তান। ছেলের বাড়ি তো ছেলের বাড়ি। তা বড়জোর ‘নিজের মতো’ হতে পারে। নিজের তো নয়! ‘নিজের’ ও ‘নিজের মতো’ এই দুইয়ে প্রভেদটা তিনি প্রবল ভাবে মানেন। অনুভব করেন।
তার নিজের বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা দেখে বিরক্ত হন মাধবী। ভিটেতে ফিরে সেই তো অশক্ত শরীরে তাকে আবার সব গেরস্থালি কাজে হাত লাগাতে হবে। ভেবেও ভয় লাগে তাঁর। এ ভাবে তিনি আর কতদিন সংসারের জোয়াল টানতে পারবেন— সে কথা ভাবেন বসে আর অনাগত আশঙ্কায় বুক কাঁপে তাঁর । কোনও পরিস্থিতির জন্য রামদাসকে দোষারোপ করতে চান না তিনি, কিন্তু অভিমানী মন তবু মাঝে মাঝে সংযম হারিয়ে ফেলে সব ভালোমানুষির। বিরক্ত হয়ে বলেন,
‘বেশ, তোমার যদি মনে হয় এখন আমার দেশে ফেরা উচিত, তাহলে নিয়ে চলো সেখানে।’
‘এরকম ভাবে ভাব কেন? তোমার যে সব সমস্যা তা তো আর রাতারাতি সেরে যাবে না! ততদিন কি তুমি ছেলের বাড়িতে বসে থাকবে?’
‘কথার কি ছিরি! ছেলের বাড়ি! বলি ছেলেটা কাদের?’
‘ওই দেখ! কি কথার কি মানে করে।’
‘সেই! আমি কি আর তোমার মতো শিক্ষিত! একটু ক্ষমাঘেন্না করেও নিও না হয় সে কথা ভেবে!’
শেষ পর্যন্ত সুধাংশুর আপত্তি সত্ত্বেও মাধবীকে দেশে ফেরার জন্য নিমরাজি হতে হলো। যাওয়ার সময় সুধাংশুকে আড়ালে ডেকে চুপি চুপি বলে গেলেন তিনি,
‘আর হয়তো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না তুমি দেশে না গেলে। তোমরা ভালো থেক। মনে রেখ নিজেরও বয়স হচ্ছে। আমার মতো নিজেকে অবহেলা করো না।’
মন সায় দিচ্ছিল না। তবু বুক ভারি করে মাকে চিৎপুর স্টেশন পর্যন্ত ছেড়ে এল সুধাংশু। হুইলচেয়ারে করে গাড়ি থেকে ট্রেনের কম্পার্টমেন্ট পর্যন্ত তুলে দিলো তাঁকে।
তার ঠিক ছ’মাসের মাথায় এক রাতে হঠাৎ প্রবল শ্বাসকষ্টে নিজের বাড়িতে মৃত্যু হলো মাধবীর। ছোট ছেলে প্রেমাংশু এসে পৌঁছলেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় সুযোগ দিলেন না তিনি।

।। সাত।।

টাবুন ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিল তেজপুরের বালিপাড়ায় এক নামি রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে। বলা ভালো, ভর্তি করতে হয়েছিল তাকে। মনে মনে কোনও মা বাবা চান না ছেলে-মেয়ে তাঁদের থেকে দূরে চলে যাক। শারীরিক বা মানসিক যে অর্থেই হোক না কেন। কিন্তু কখনও পরিস্থিতি এমন হয় যে তা ছাড়া উপায় থাকে না। টাবুন শান্ত স্বভাবের ভালো ছেলে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত তার পড়াশোনার দিকে মা বাবাকে নজর দিতে হয়নি। খুচখাচ দু-একজন প্রাইভেট টিউটর ও তার নিজের সিন্সিয়ারিটি দিয়ে ক্লাসের টপার না হলেও পরীক্ষায় বেশ সুন্দর রেজাল্ট করে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপর বয়ঃসন্ধি। আর সে কারণে বাড়ির ও বইয়ের বাইরের রঙিন জগত ও বিলাসব্যাসনের হাতছানি কিছু সময়ের জন্য হলেও তাকে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে দিলো। আর সেই প্রথম তার প্রতি মা বাবার আস্থার ভিত নড়ে গেল খানিক। বার্ষিক পরীক্ষায় তার খারাপ ফলের কারণে রনিতা সিঁদুরে মেঘ দেখল যেন। তারপর সুধাংশুর মতামতের কোনও রকম তোয়াক্কা না করে একতরফা সিদ্ধান্তে ছেলেকে পাঠিয়ে দিলো তেজপুরের বোর্ডিং স্কুলে। সে সময় কি বুঝেছিল কে জানে, মায়ের সিদ্ধান্তে কোনও প্রতিবাদ করেনি।
আর প্রতিবাদ না করে যে ভালো করেছে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ তো আইসিএসই আর আইএসসি’তে তার রেজাল্ট। রনিতা, সুধাংশু তেমন অভিভাবক নন যারা ছেলের মতামতকে উপেক্ষা করে নিজেদের স্বপ্নপূরণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মাথায় চাপিয়ে দেবে। পরে প্রত্যাশা পূরণের ব্যার্থতায় তাকে দূষবে। ভাগ্যিস! নয়তো পুরোদস্তুর আর্টসের ছাত্র টাবুনকে সায়েন্স নিয়ে পড়ে নাস্তানাবুদ হতে হতো।
স্কুলজীবন শেষে বাড়ি ফিরে টুবান যেন অন্য মানুষ। দায়িত্বশীল, নরম মনের আদ্যোপান্ত এক ফ্যামিলি পার্সন। শরীর সচেতন। ভবিষ্যতের লক্ষ্যে ফোকাসড। অসম্ভব টান ও মমত্ববোধ মা বাবার প্রতি।
‘বৌমা, ওকে তো বিজ্ঞান পড়াতে পারতে!’
রামদাস একবার হালকা চালে কথাটা বলেছিলেন রনিতার সামনে।
‘আমরা কারও উপর কিছু চাপিয়ে দেওয়ার মানুষ নই বাবা। আর ও তো আমাদের সন্তান। অপছন্দের সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে গিয়ে ভবিষ্যতে যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে চিরকাল অপরাধবোধে ভুগব আমরা। সেটা চাই না। আফটার অল, হিজ ওন লাইফ!’
রামদাস আর কথা বাড়াননি। পরে সুধাংশুর মতো তিনিও বুঝেছিলেন যে রনিতার সিদ্ধান্ত কত সময়োপযোগী ও নির্ভুল ছিল।
এরপরে টাবুন অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজিতে বিএসসি কোর্সে ভর্তি হলো সরিষার এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। গ্র্যাজুয়েশনের জন্য অল ইন্ডিয়া এনট্র্যান্স দিলো সঙ্গে। ইউরোপের ইউনিভার্সিটিগুলোতেও অ্যাপ্লাই করল বেটার অপশনের জন্য।
‘সরিষার এই ইউনিভার্সিটিটা কেমন?’
কথা প্রসঙ্গে রনিতা টাবুনকে জিজ্ঞাসা করেছিল একদিন।
‘ভালোই তো!’
উত্তরে বলেছিল টাবুন।
‘ভালোই তো মানে কি?’
‘মানে কমপ্লেক্স ভালো। ফ্যাকাল্টি ভালো। নিয়মিত ক্লাস হয়। বাকিটা তো নিজের উপর! যুগটা তোমাদের ছোটবেলার মতো নয় মা। এ যুগের উপর কর্তৃত্ব করে সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেট। চাইলে বাড়িতে বসেও পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় নিতে পারো। তবে তার জন্য তোমার ফোকাস আর ডিটারমিনেশন থাকতে হবে।’
‘তাহলে তোকে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে পাঠানোর কোনও দরকার ছিল না বলছিস?’
‘অবভিয়াসলি ছিল মা। কিন্তু সেই আমি আর আজকের আমি কি এক? অনেস্টলি বলো তো?’
‘তাই তো দেখছি বাবু! অনেক পাল্টে গেছ এখন। তাহলে তুমিই বলো এখন কি?’
‘কি আবার! যেখানে বেটার অপশন সেখানে যেতে হবে। এখানে হলে এখানে। অন্য রাজ্যে হলে অন্য রাজ্যে। অন্য দেশে হলে অন্য দেশে।’
‘হ্যাঁ রে! বাইরে চলে যাবি আমাদের ছেড়ে! মনখারাপ করবে না তোর! মনখারাপ হবে না আমাদের!’
কথার মাঝখানে সুধাংশু বলে ওঠে হঠাৎ।
‘ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল ফুল! কাছে থাকলেই কি পাশে থাকা হয়? পৃথিবী এখন কতটুকু? ওর যদি আমাদের প্রতি টান থাকে, ইচ্ছে থাকে, সঙ্গে অর্থবল, তাহলে কোনও সন্দেহ নেই, দূর থেকে ও অনেক বেশি পাশে থাকতে পারবে আমাদের।’
রনিতা টাবুনের হয়ে ঝটিতি উত্তর দেয় সুধাংশুর প্রশ্নের।
‘এটা তুমি একদম ঠিক বলেছ বৌমা!’
রামদাস বলেন,
‘আমি এটা মানি। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করি এর সত্যতা। হতেই পারে তোমাদের সময় গোটা পৃথিবী হাতেই মুঠোয় এসে গেছে। আমাদের সময় কলকাতায় অনেক দূরের শহর ছিল। তোমরা ইচ্ছে মতো এখন অন্যের গলা শুনতে পাও, তাকে দেখতে পাও, যার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হতো দিনের পর দিন। কিন্তু যে দর্শন সত্যি তা বিজ্ঞানের মতো পরিবর্তনশীল নয় বলে চিরকাল সত্যি। আজকে টাবুনের তোমাদের প্রতি টান আর অতীতে সুধাংশুর আমাদের প্রতি টান একই দার্শনিক সত্যের ভিন্ন ভিন্ন যুগোপযোগী রূপ।’
‘তবুও ওদেরকে, ওদের জেনারেশনকে কেমন যেন অচেনা লাগে বাবা।’
রনিতা উত্তর দেয়, বলতে থাকে,
‘কেবল মনে হয়, আমাদের কত বেশি আবেগ ছিল ভালো লাগা, মন্দ লাগা, আনন্দ, দুঃখ, খুশি ও যন্ত্রণার প্রতি। কথায় কথায় চোখে জল আসত, বুক ভারি হয়ে আসত, আনন্দে মন উচ্ছ্বল হতো ময়ূরের মতো। এখন কেন যেন মনে হয় সকলে এক একটা করে ভাবলেশহীন রোবট।’
‘একটা ভুল হচ্ছে বৌমা। তুমি সময়ের পরিবর্তন আর যুগের চাহিদাটা একবার বোঝো! আমাদের সময় জীবন কি এত কঠিন ছিল নাকি প্রতিটি ইঞ্চি উন্নতির জন্য মরণপণ যুদ্ধ করতে হতো? আজকের নবীনেরা যদি কথায় কথায় আবেগের চোরাস্রোতে ডুবে যায়, তাহলে যুদ্ধ করবে কি করে?’
‘যুদ্ধ কি আমাদেরও ছিল না বাবা! আমরা কি তাই বলে যন্ত্রমানব হয়ে গেছিলাম?’
‘ওটাই তো জেনারেশন গ্যাপ! সে গ্যাপ মেনে নিতে হয়, নয়তো আগামীর উত্তরণ হয় না। আমরাও মেনে নিয়েছি তোমাদের সঙ্গে আমাদের জেনারেশন গ্যাপ। এটা কম্প্রোমাইজ নয়, ভবিষ্যতের হাতে জীবনপ্রবাহের মশাল তুলে দেওয়া। তোমাদেরও সেটা শিখতে হবে। আর আমরা কুয়োর ব্যাঙেরা যখন পেরেছি, তোমরা যখন পেরেছ, ওদের মতো বিশ্বদর্শীরা তখন আরও সহজে তা পারবে। তোমাদের সন্তান, আমার নাতি টাবুন খুব ভালো ছেলে। তোমাদের ভবিষ্যৎ ওর হাতে দেখে তাই আমি অত্যন্ত নিশ্চিন্ত বোধ করছি।’
শ্বশুর রামদাসের কথা শুনে তাঁর দিকে খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে রনিতা। তাঁর ভিতরের দার্শনিক মানুষটাকে, যাঁকে এতদিন চিনতে পারেনি সে, এক মুহূর্তে চিনতে পেরে যেন এক অনাবিল আনন্দে ও শ্রদ্ধায় ছেয়ে যায় তার অন্তর। সে বুঝতে পারে, আসলে কেউ একা নয়। একাকীত্ব শুধু মানুষের ভাবনা আর ব্যক্তিসত্তায়। জীবনপ্রবাহ হলো ভালোবাসা আর বিশ্বাসের অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা এক আবহমান মালা।

অলংকরণ: দীপংকর ঘোষ ও রাতুল চন্দরায়

1 COMMENT

Comments are closed.