সুখেন্দু হীরা

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল (নিরাপত্তা)। প্রতারণার নানা কাহিনি ধারাবাহিক ভাবে তিনি তুলে ধরছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

চাকরি কথাটি এসেছে ফরাসি চাকর শব্দ থেকে। আমরা মজা করে বলি ‘চাকরি’ মানে ‘চাকরগিরি’। প্রকৃত অর্থে তাই। চাকরির আক্ষরিক অর্থ দাসত্ব, ভৃত্যকার্য, সেবা। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে বলা যায়, বেতন নিয়ে অপরের কাজ করা। তা সে সরকারি চাকরি হোক বা বেসরকারি—পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রমদান করতে হয় বা কাজ করতে হয়। অথচ এই দাসত্বের জন্য বাংলার মানুষ সবচেয়ে লালায়িত।

কেন মানুষ সরকারি দাসত্বের জন্য লালায়িত? এর অনেক কারণ রয়েছে। চাকরিতে নিরাপত্তা, নিশ্চিত আয়, বছর বছর বেতন বৃদ্ধি, চিকিৎসাগত বা অন্যান্য কিছু সুযোগ সুবিধা। অনেক ক্ষেত্রে অবসরের পর অবসরকালীন ভাতা বা পেনশন। ব্যবসা বা স্বনিযুক্তি প্রকল্পের ক্ষেত্রে সব সময় আয়ের নিশ্চয়তা থাকে না। এর জন্য মানসিক উৎকন্ঠা থাকে, সরকারি চাকরিতে তুলনামূলক ভাবে মানসিক উৎকণ্ঠ কম। কিন্তু আমার মনে হয়েছে সবচেয়ে বড় কারণ ‘Status’ অর্থাৎ ‘সামাজিক পদমর্যাদা’।

আমি অনেক পরিবার দেখেছি, তাদের জমি জায়গা যথেষ্ট আছে, তা থেকে আয় মন্দ হয় না। পারিবারিক ব্যবসা আছে, বাজারে ব্যবসার ‘গুড উইল’ আছে, তা সত্ত্বেও সেই পরিবারগুলি ছেলেদের সরকারি চাকরিতে ঢোকাতে উন্মুখ‌। গ্রামে কোনও বাড়িতে সরকারি চাকুরে থাকলে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। অনেক জায়গায় বলতে শুনেছি আমাদের গ্রামে বা আমাদের পাড়ায় প্রতি বাড়িতে প্রায় সরকারি চাকরি আছে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি যে সব ছেলেরা পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে, তাঁরা যদি সরকারি চাকরি না পান, তাহলে অন্যলোকে বলে, ‘কি হলো এত পড়াশোনা করে?’ যে পড়াশোনা করেছে সেও ভাবে, ‘এত পড়লাম শেষে কিনা জমিতে চাষ করব?’ যে পড়াশোনা করে, চাকরির চেষ্টা করে সরকারি চাকরি পায়নি, সে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। ভাবে আমার দাদা, মামা, কেউ নেই তাই হয়তো সরকারি চাকরি পেলাম না। হয়তো টাকা দিলে অর্থাৎ উৎকোচ দিলে চাকরিটা হয়ে যেত।

সাধারণ লোকের মনে একটা ধারণা আছে, টাকা পয়সা খরচ করলে হয়তো সরকারি চাকরি পাওয়া যেতে পারে। এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে সরকারি চাকরি পাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে যে চাকরি পাওয়া যায় তাতেও দেখা যায়, একজন সাধারণ প্রতিযোগী চাকরি পেয়ে গেল। তাঁর থেকে উচ্চমেধার একজন সেই পরীক্ষায় চাকরি পেল না। এক্ষেত্রে উচ্চমেধার যিনি চাকরি পেলেন না, এটা তাঁর ব্যর্থতা নয়। বরং এটা চাকরি প্রাপক প্রতিযোগীর সৌভাগ্য, কারণ সেদিন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তাঁর উপযোগী ছিল বা ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রশ্নাবলী তাঁর জানার মধ্যে ছিল— অর্থাৎ দিনটা তাঁর ছিল। তাই যিনি চাকরিটা পেলেন না তিনি যে খারাপ তা কোনও মতেই বলা যাবে না। অবশ্যই এটাও ঠিক যথার্থ প্রতিভাকে পৃথিবীর কোনও শক্তি বাধা দিতে পারে না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একথা বলেছেন।

যেহেতু চাকরিতে একটা ভাগ্যের ব্যাপার রয়েছে, তাই ভাগ্য বশে আনতে মানুষ নানা পন্থা অবলম্বন করে। তাঁর মধ্যে পূজাঅর্চনা, মাদুলি, কবজ, মানত’তো আছেই। আর ভাবে যাদের মাধ্যমে চাকরি পরীক্ষাগুলো হয়, তাঁদের যদি অর্থ দিয়ে হাত করা যায় অথবা কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ধরা, যিনি সহজেই একটি চাকরি করে দিতে পারেন।

এই বিষয়টা প্রতারক ভালো ভাবে জানে। তাই সরকারি চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে সবচেয়ে বেশি জাল বিস্তার করেছে প্রতারকরা। আমি আমার চাকরি জীবনে দেখেছি, সবচেয়ে বেশি প্রতারণার অভিযোগ হল এই যে, চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা নিয়েছে, চাকরি হয়নি, এখন টাকা ফেরত দিচ্ছে না।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই যে এই টাকা দেওয়ার বা নেওয়ার কোনও জোরদার প্রমাণ থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মৌখিক আশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নগদ টাকা দেয়। টাকা যে দেওয়া হয়েছে তার কোনও রশিদ থাকে না। যদি কোন লিখিত পড়িত থাকে, তাতেও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য টাকা নেওয়া হচ্ছে সেটাও লেখা থাকে না।

কারণ যিনি টাকা দিচ্ছেন তিনি জানেন চাকরি করে দেওয়ার জন্য টাকা নেওয়া যেমন অপরাধ। তেমনই চাকরি পাওয়ার জন্য টাকা দেওয়া বা টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া সমান অপরাধ। এই কথাটা চাকরি দেওয়ার প্রতারকেরা ভালো ভাবে জানে। তাই চাকরিপ্রার্থীদের তারা বলেন, চাকরি করে দেওয়ার জন্য আমি টাকা নিলাম এটা তো লেখা যাবে না, তাই ব্যবসার জন্য টাকা ধার নিলাম এটা কাগজে লিখছি। চাকরি প্রার্থীরা সেটাই মেনে নেয়।

এবার যখন চাকরিপ্রার্থীরা প্রশাসনে দ্বারস্থ হয়, তখন এটা ক্রিমিনাল কেস হিসাবে বিচার্য হয় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সিভিল কেস হিসাবে ধার্য হয়। প্রতারক মহাশয় ভালো মতোই জানে পুলিশ ফৌজদারি মামলার যতটা ব্যবস্থা নিতে পারে, দেওয়ানি মামলায় ততটা পারে না। এই আইনের ফাঁক গলে প্রতারকরা দিব্যি বহাল তবিয়তে থাকে।

প্রতারকরা কখনই বলে না, আমি টাকা ফেরত দেবো না। সব সময় বলে কিছুদিন বাদে দেবো। খুব চাপাচাপি করলে সামান্য কিছু দিয়ে বলে, আস্তে আস্তে দিয়ে দেবো। কখনও বলে, এই চাকরিটা হয়নি তো কি হয়েছে আরো তো চাকরি রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে একটা করে দেবো‌।

পরে চাকরি হবে এই আশায় বছরের পর বছর প্রতারকের ঘরে অথবা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে টাকা পড়ে থাকে। সেখান থেকে সে দিব্যি সুদ পায়। সেই টাকা অন্যত্র বিনিয়োগ করে প্রভূত লাভ করে। অনেকে আবার সরাসরি সেই টাকাতে আয়েশ করে। বড় বাড়ি বানায়, দামি গাড়ি চড়ে, নামী কোম্পানির পোশাক পরে। স্ফূর্তিতে এত টাকা খরচ করে বলার নয়।

এই প্রতারকদের একটা খুব ভালো গুণ থাকে। তা হলো, ভালো ব্যবহার। খুব মুখ মিষ্টি এদের। এরা কখনই কারও সঙ্গে উচু গলায় কথা বলে না। আপনি রেগে গিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বললেও এরা কখনই আপনার প্ররোচনায় পা দেবে না। বাড়িতে গিয়ে ঝামেলা করলে, আপনাকে শান্ত ভাবে বসাবে, জল খাওয়াবে, মিষ্টি কথায় ফেরত পাঠাবে।

আমি এমনও দেখেছি বড় ছেলের জন্য টাকা দিয়েছিল কেউ, বড় ছেলের চাকরির বয়স চলে গেছে, তাও টাকা ফেরত দেয়নি। চাকরি প্রার্থীর বাড়িতে প্রতারক আশ্বাস দিয়েছেন ছোট ছেলের জন্য দেখে দেবো। চাকরি প্রার্থীর বাড়ির লোকদের বলেছিলাম, টাকা ফেরত নিচ্ছেন না কেন? ওঁরা বলেছিলেন, অনেকেই তো ওঁর কাছে টাকা ফেলে রেখেছে; যদি কিছু হয় এই আশায়। আমরাও রেখেছি যদি আমাদের ছোট ছেলের কিছু হয়।

এই আশায় ছলনায় ভুলিয়ে প্রতারক প্রতারণা করে চলেছে যুগ যুগ ধরে।

(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়