একেবারে প্রথম মোলাকাতের দিনে বার্টের পরীক্ষাগারে ওয়াটসন যখন হোমসকে (Sherlock Holmes) দেখলেন, তখন তিনি এক পরীক্ষায় ব্যস্ত। ঠিক সেই মুহূর্তে হোমস এমন একটা রি-এজেন্ট আবিষ্কার করেছেন, একমাত্র হিমোগ্লোবিন দ্বারাই যার থেকে তলানি পড়ে, আর কিছুর দ্বারাই নয়। গুয়াইকাম পরীক্ষাটা যেমন গোলমেলে তেমনই অনিশ্চিত। রক্তকণিকার আণুবীক্ষণিক পরীক্ষাটাও তাই। একমাত্র এই পরীক্ষাটাই টাটকা বা বাসি উভয় রক্তের ক্ষেত্রেই কার্ষকরী।

হোমস যখন বার্টে এই কাজ করছিলেন তখন ক্রিমিনোলজি এবং ফরেন্সিক বিজ্ঞানের উষাকাল। রসায়নে প্রগাঢ় জ্ঞানের অধিকারী হোমস যে এই নতুন বিজ্ঞান-শাখায় উৎসাহী হবেন, তাতে আশ্চর্য কী! উনবিংশ শতকের শেষাশেষি এ নিয়ে মাতামাতি হলেও ফরেন্সিক বিজ্ঞান ও ক্রিমিনোলজির সূত্রপাত অষ্টাদশ শতকে। প্রথম এ বিষয়ে যে তিনজন আলোকপাত করেন, তাঁদের একজন জার্মান, ফ্রানৎস জোসেফ গল এবং দুই ইতালীয়— সিজার বেক্কারিয়া ও সিজার লোম্বারসো। ১৭৬৪ সালে বেক্কারিয়া এ বিষয়ে প্রথম বই  On Crime and Punishments  লেখেন, যাতে তিনি বলেন অপরাধ এবং অপরাধপ্রবণতা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। লোম্বারসো অবশ্য অমতের তীব্র কারণকে অপরাধের কারণ হিসেবে দায়ী করেন।

সেসময় অপরাধের বিচার হত মূলত সাক্ষ্য ও সাক্ষীর ওপর নির্ভর করে। যেহেতু সাক্ষীনির্ভর ছিল, তাই মিথ্যা সাক্ষ্যর ফলে দণ্ড পেতেন বহু নিরপরাধ মানুষ। সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বিচিত্র সব অত্যাচারের কাহিনিও আছে। আর ছিল স্বীকারোক্তি। সন্দেহভাজনের থেকে যেনতেনপ্রকারে স্বীকারোক্তি ও গুপ্ত পুলিশের কাজই ছিল সন্দেহভাজন সম্পর্কে যতটা পারা যায় তথ্য জোগাড় করা। ব্যাপারটা যে কতটা ভয়াবহ ছিল, সেটা যাঁরা কাফকার ‘The Trial’  উপন্যাসটি পড়েছেন, তাঁরাই জানেন। সমস্যা পুলিশেরও ছিল। প্রতিটি মানুষ সম্পর্কে এত হাজার হাজার তথ্য জোগাড় যদি-বা হল, কিন্তু সে সব তথ্য পঞ্জিকরণ এবং সময়মতো খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

গোটা ব্যাপারটাই চরম অবৈজ্ঞানিক। আর অপরাধ বিজ্ঞানকে এই অন্ধকারে আলো দেখাতে প্রথম উপায় বাতলালেন জোসেফ গল। তিনি যে পদ্ধতি ব্যবহারের কথা বললেন, তার নাম Phrenology। শব্দটির অর্থ “মন সমীক্ষা”। গল দাবি করলেন, মানুষের মনের যন্ত্র যেহেতু মস্তিষ্ক এবং মস্তিষ্কের ধারক মাথার খুলি, তাই মানুষের মাথার খুলির আয়তন ও গঠন দেখে তার বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব, চরিত্র ইত্যাদি বোঝা সম্ভব। তিনি এটাও দাবি করলেন, অধ্যাপক, জুয়াড়ি, খুনি বা জোচ্চোর— প্রত্যেকের খুলির গঠন আলাদা আলাদা রকম হয়। তাঁর অধ্যবসায়ের ফলরূপে তিনি একটি brain map বানান, যাতে মস্তিষ্ককে ২৭টি আলাদা অংশে ভাগ করে কোন অংশ কী ধরনের চেতনার জন্য দায়ী তা চিহিত করা হয়েছে। এই মানচিত্রটি প্রবল জনপ্রিয় হয়। ১৮২০ সালে এডিনবরায় গলের মতাবলম্বীরা Edinburgh Phrenological Society  স্থাপন করেন, যার এক উৎসাহী সদস্য ছিলেন ডা আর্থার কোনান ডয়েল। অপরাধীরা আকারে বিশাল, দাড়িওয়ালা এবং কথাবার্তায় অভদ্র, এ ধারণা অন্তত তিনটি অভিযানে দেখা যায় (Six Napoleons, Blue Carbuncle G Speckled Band)। এমনকী, ‘The Hound of the Baskervilles’é- এ-ও ডা মর্টিমার খুলির পাশে একটু হাত বোলাতে চান। এটা হল সেই ধরনের করোটি যার ব্যাসের পরিমাণ এক পাশ থেকে আর এক পাশে মাপলে সামনে থেকে পিছনের মাপের 8/৫ কম। এ সবই আসলে গলের চিন্তাধারার দান। গলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জাতিগত বৈষম্য ও ইহুদিদের অপরাধ প্রবণতা বোঝাতে মানব খুলির এক বিশাল সংগ্রহশালা তৈরি করেছিলেন।

এর পরেই যে বিজ্ঞানী গলের ধারণাকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান, তিনি জাতে ফরাসি। নাম আলফীস বার্তিলৌ। ‘The Hound of the Baskervilles’- এ মর্টিমারের মুখে এঁর নামও শুনতে পাই। তিনি শুধু খুলির উপর নির্ভর না করে ঘাড়ের মাপ, হাত, পা, পায়ের পাতা সব কিছুর নিখুঁত মাপ নিতেন। শুধু তাই না, অপরাধীদের ফটোগ্রাফ সামনে ও পাশ থেকে নেওয়ার যে পদ্ধতি আজও চলছে, তা কিন্তু বার্তিলৌরই দান। তার যুক্তি ছিল পরিষ্কার। এক অপরাধী নিজের চেহারা যতই পরিবর্তন করুক, পাল্টাতে পারবে না। তাই প্রতি অপরাধীর এই তথ্যপঞ্জি জোগাড় করে পঞ্জিকৃত করা হতো— বিশেষ করে ঘাঘু অপরাধীদের ধরতে এর জুড়ি ছিল না। বার্তিলৌ আরও একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার করেন— হস্তাক্ষর বিচার। ঠিক আবিষ্কার নয়, অপরাধবিজ্ঞানে এর ব্যবহারিক প্রয়োগ প্রথম মিশ ১৮৩০ সালে প্রথম গ্রাফোলজি’-র সংজ্ঞা দেন। তাঁর মতে, প্রত্যেক মানুষের হস্তাক্ষর আলাদা এবং তা মানবচরিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। ডয়েল লেখাটি পড়েছিলেন এবং ১৮৯৩তে ‘Reigate Squares’- এর অভিযানে এই থিয়োরি প্রয়োগ করেন। ১৮৯৪ সালে আলফ্রেড ড্রাইফাস নামে এক ফরাসি ইহুদিকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে প্রধান প্রমাণ ছিল বার্তিলৌ-র করা তার হস্তাক্ষরের বিশ্লেষণ। প্রায় বারো বছর জেল খাটার পর ড্রাইফাস যখন মুক্তি পেলেন, দেখা গেল হস্তাক্ষরটি জাল। বার্তিলৌর বিশ্লেষণে ভুল ছিল। অপরাধবিজ্ঞান খোঁজ করছিল এমন এক সাক্ষ্যের যা একশো শতাংশ নির্ভুল হবে। ঠিক এমন সময় আবির্ভূত হলেন হুয়ান ভুকেটিচ। ঠিক এই জায়গায় বরং ‘সোনার কেল্লার’- সিধুজ্যাঠার স্মরণাপন্ন হওয়া যাক।

আঙুলের ছাপ দেখে ক্রিমিনাল ধরার পদ্ধতির আবিষ্কর্তা নিয়ে ফেলুকে বলার সময় সিধুজ্যাঠা হয়ান ভুকেটিচ সম্পর্কে বলেছেন, ‘মনে রেখো, আর্জেন্টিনার লোক। বুড়ো আঙুলের ছাপের ওপর ইনিই প্রথম জোরটা দেন। আর সে ছাপকে চারটে ক্যাটেগরিতে ভাগ করেন উনিই। অবশ্যি তার কয়েক বছর পরে ইংল্যান্ডের হেনরি সাহেব আরও মজবুত করেন এই সিস্টেমকে। এই হেনরি সাহেব ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি। ১৮৯৭ সালে কলকাতায় ইনি প্রথম ফিঙ্গারপ্রিন্ট-রেকর্ডিং ব্যুরো স্থাপন করেন। ডয়েল যখন হোমসের গল্প লেখা শুরু করছেন, তখন লন্ডন পুলিশ হাত বা আঙুলের ছাপকে অপরাধী শনাক্তকরণের উপায় হিসেবে মানতে চায়নি, হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ১৯০৩ সালে ডয়েল যখন ‘Norwood Builder’  লিখছেন, তখন অপরাধী শনাক্তকরণে আঙুলের ছাপের ভূমিকা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত এবং কাহিনিটিও দাঁড়িয়ে আছে আঙুলের ছাপের প্রমাণের ওপরেই।

১৯০০ সালে ফরেন্সিক বিজ্ঞানের আরও এক দরজা খুলে গেল। সেই বছরই অস্ট্রিয়ান জীববিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার তিন রকম ব্লাড গ্রুপ A, B এবং O চিহ্নিত করলেন। ১৯০২ সালে আবিষ্কৃত হল আর একটি গ্রুপ AB. ডয়েল অবশ্য রক্ত নিয়ে ফরেন্সিক গবেষণা বিষয়ে অবগত ছিলেন। না হলে তিনি গুয়াইকাম পরীক্ষার কথা বলতে পারতেন না। গুয়াইকাম একটি গাছের আঠা যা রক্ত, বিশেষ করে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করতে ব্যবহার করা হয়। এটি প্রাচীনতম রক্তসমীক্ষা। ডা জন ডে এই পরীক্ষাটির আবিষ্কারক, এতে কোনো দ্রবণে হিমোগ্লোবিন থাকলে, তাতে এক ফোঁটা এই আঠা ফেলে দিলে নীচে দুধ সাদা অধঃক্ষেপ পড়ে। যদিও শার্লক হোমসের দাবি, তার রি-এজেন্ট-এর চেয়েও কার্যকরী।

ফরেন্সিক প্যাথোলজি বা পোস্ট-মর্টেমেও ডয়েলের আগ্রহ ছিল। যখন শার্লক পুরোদমে তার অভিযান চালাচ্ছেন, তখন লন্ডনে এক মার্কিন হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ক্রিপেনের স্ত্রী কোরার আকস্মিক মৃত্যু হয়। প্রথমে পুলিশ ভেবেছিল, কোরা নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। কিন্তু ক্রিপেন, তার প্রেমিকা ইথেলের সঙ্গে চম্পট দিলে পুলিশ বাড়িতে তল্লাশি চালায় এবং বেসমেন্টে পোঁতা অবস্থায় একটি মৃতদেহ পান। পোস্ট-মর্টেম বিশেষজ্ঞ ডা বানার্ড স্পিলসব্যারি মৃতদেহের ফরেন্সিক তদন্ত করে প্রমাণ করেন সেটি কোরার মৃতদেহ এবং কোরাকে হায়োসিন নামে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে। ক্রিপেনকে কানাডা থেকে ধরা হয়। বিচারে ডা হাওলি হার্ভে ক্রিপেনের মৃত্যুদণ্ড হয়। এই ডা স্পিলসব্যারিও ছিলেন ডয়েলের বন্ধু। জার্নাল ও আবিষ্কারের কথা জানার সুযোগ ছিল ডয়েলের। আর যখনই নতুন যা কিছু জানতে পেরেছেন, তাকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন হোমস কাহিনিতে। যত সময় গিয়েছে হোমসও অপরাধবিজ্ঞানে তত দড় হয়ে উঠেছেন। হয়তো নিজের অজান্তেই ডয়েল উনবিংশ শতকের অপরাধবিজ্ঞানের ধারার এক ইতিবৃত্ত লিখে গেছেন হোমস কাহিনির মাধ্যমে। হোমসের নিবিড় পাঠ আসলে সেই ইতিহাসেরও পাঠ!

3 COMMENTS

  1. খুব সুন্দর লেখা, আরও এইরকম লেখা পড়ার আশা রাখি।

Comments are closed.