সেদিন সকালে বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল অমিত আর রাজেশ। প্রায় একশো কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে, একজনের সঙ্গে দেখা করার জন্যে। প্রায় দু ঘণ্টা একনাগাড়ে চালিয়ে, গেটের বাইরে একটা গাছের ছায়ায় অপেক্ষা করেছিল ঘন্টাখানেক। তারপর একজন এসে খবর দিয়েছিল, দেখা হবে না। দেখা করবে না বলেছে। কাগজটা না খুলেই, ছুড়ে ফেরত দিয়ে দিয়েছে।

ফিরতে একটু বেশিই সময় লেগেছিল। পরের দিন ছিল সেমেস্টারের পরীক্ষা। কিছুই মনে পড়ছিল না। সব ফর্মূলাগুলো ধোঁয়া ধোঁয়া লাগছিল।

তখন হঠাৎ পার্থের কথা মনে পড়েছিল। পাহাড়ি উপজাতির মা, আর সমতলের বাবার বিয়ের ফসল পার্থ ওরফে রবার্ট। ওর দেওয়া জিনিসগুলোর কথা মনে পড়েছিল। সিগারেট প্যাকেট খুলে, ওর বলা মতো বানিয়ে, টান দিয়েছিল চোখ বুজে। একটার পর একটা। তারপর একসময় মাথা পুরো খালি হয়ে গিয়েছিল যেন। বই খুলে, একবার দেখতেই গেঁথে যাচ্ছিল সবকিছু। দারুণ মনোযোগ আসে, এটা খেয়ে কিছু করলে।

সেই দিন থেকে শুরু।

কখনো মাথা জ্যাম জ্যাম লাগলে, একটা বা দু’টো বানিয়ে টানলেই মগজ সাফ। তারপর তো, কলেজেই জোগাড় করে দিত রবার্ট। সে পাহাড়ি রাজ্য থেকে আসা ছেলে। তার কাছ থেকেই সবাই পেত।  সেই রাজ্যেই নাকি সবার সেরা মাল চাষ হয়। দরকার পড়লেই রবার্ট দিয়ে যেত। বলেছিল, আরও একটা জিনিস খাওয়াবে। এত আগুন জ্বালিয়ে, এত লম্বা সময় ধরে খাওয়ার হুজ্জুতি থাকবে না। অল্প টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছিল। কিন্তু তারপর একবার নিজের রাজ্যে গিয়ে আর ফিরলো না। শুনেছিল, মারামারি না কি করে নাকি খুন হয়ে গিয়েছিল। রবার্টও গেল, আর অমিতের সিগারেট খাওয়াটাও চলে গেল। সাধারণ সিগারেট খেলে কেমন যেন ফ্যাকাশে লাগে, কি যেন নেই। একদিন, ধুত্তেরিকা বলে ছুড়ে ফেলে দিল প্যাকেট। সেই কী খাওয়াবে বলেছিল রবার্ট, সেটাও খাওয়া হল না। কলেজ লাইফে লোকেরা কত রকম আনন্দ করে, কত রকমের নেশা করার সুযোগ পায়। শুরু করেও, এই দিকটা, কলেজের এই জীবনটা পুরো অসম্পূর্ণ রয়ে গেল অমিতের।

হাতে গরম লাগতেই বর্তমানে ফিরে এল অমিত। সামনে অনেকগুলি হতভম্ব মুখ। যে ছেলেটা সিগারেট অবধি খায়নি এই চার বছরে, সে যদি হঠাৎ এভাবে মশলা ভরে টানে, চোখগুলো গোল গোল হতেই পারে। একটু অপ্রভিত ভাবে হাসলো অমিত। তারপর বললো, কেউ দেখবেন নাকি একটা?  বানিয়ে দিই।

কারও বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না।

মাথাটা কিন্তু একটু খুলেছে। তরল গলায় অমিত বলল, চলুন বিভাসদা, রাতের খাবারটা বাইরে থেকে খেয়ে আসি।

বেরুবার সময়, প্যাসেঞ্জার লোকটিকে বলল, ‘‘আপনিও চলুন’’।

তিনজন গাড়িতে বসার পর, একবার আলতো সুরে জিজ্ঞেস করল, ‘‘দাদা, অস্তরটা সঙ্গে নিয়েছেন তো? চালাতে হতে পারে।’’

গাড়ি রাতে চালাতে এখনও সুবিধে হয়নি অমিতের। গাড়ি এখন চালাচ্ছেন বিভাসদা। সামনেই লোকটিকে বসিয়ে, পেছনের সিটে অমিত। প্যাসেঞ্জার লোকটিকে বললো, ‘‘দুপুরে যেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম , সেখানকার রাস্তাটা স্যারকে দেখিয়ে নিয়ে চলো।” এরপর আর কথা নেই। ঘণ্টাখানেক লাগল। গাড়ি থামিয়ে, অমিত লোকটিকে বলল, আপনি গিয়ে অল্প ভাজাভুজির অর্ডার দিন। আমরা আসছি।

লোকটি সোজা নেমে গেল। গিয়ে ঢুকছে সেই লালরঙের দোকানটিতেই।

বাইরেই একটি লোক… দু’জনে কী কথা। শেষ হওয়ার আগেই দ্রুতপদে অমিতরা দুজনেই পৌঁছে গেল পাশে। দোকানটার সামনে, সেই কাঁচের দেরাজ… গোল্লা… নিমকি। কিন্তু পেরিয়ে এলে, দু’টো প্লাস্টিকের টেবিল পাতা। চারটে করে চেয়ার। সবই লাল রঙের। 

সেখানে গ্যাট মেরে বসলো অমিত। বাকিদেরও বসতেই হলো। ওই গেটের মুখে যে লোকটি ছিল, সে ছাড়া আর একটি রোগামতো ছোকরা। জল দিয়ে গেল, ছোট চায়ের গ্লাসে করে। 

অমিত প্যান্টের দুই পকেট থেকে ছোট ছোট দুটো বোতল বার করে টেবিলে রাখলো। এমন ছোট বোতল সবচেয়ে প্রথম নাকি এই রাজ্যেই শুরু হয়েছিল, এক দূরদর্শী মুখ্যমন্ত্রীর আমলে। বড্ড কাজের। ছাত্রদের জন্য। তবে পকেটে করে ঘোরা যায়। আজকাল সবারই কাজে লাগে।

বসেছিল তিনজন।অমিত চেঁচিয়ে প্লাস্টিকের গ্লাস দিতে বললো। বিভাসদা প্রচুর সিগারেট খান। কিন্তু এসব ছুঁয়েও দেখেন না।

দোকানের মালিক, একটু মোটা মতো, চোখে ঘোলাটে চশমা, একটু আপত্তির চেহারা করে এগিয়ে এল। বাইরে এই লোকটাই কথা বলছিল প্যাসেঞ্জার লোকটির সঙ্গে।

– এই সব এখানে খাওয়া যাবে না।

অমিত প্যাসেঞ্জার লোকটির দিকে তাকালো। সে বড্ড অস্বস্তিতে ভুগছে। কিছু বলার আগেই, সে-ই মালিককে বলল, ‘‘কিছু হবে না। দোকানে তো কোনও কাস্টমার নেই।’’

অমিত গ্লাসে ঢাললো। জলের ভাগটাই বেশি।

তারপর লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘চলে? যদি চলে, তাহলে নিজে ঢেলে নাও। আর দেখো, ভাল কিছু চাট, মুরগি টুর্গি ভাজা পাওয়া যাবে কি না?’’

দশ পনেরো মিনিট পরেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে এল। মুরগি ফ্রাই থেকে শুরু করে বাদাম ভাজা, এমনকি টমেটো আর পেঁয়াজকুচি ছোট ছোট করে কেটে স্যালাড।

একসময়, অমিতের অনুমতি নিয়ে মালিক লোকটাকেও দু-তিন গ্লাস খাইয়ে দিল প্যাসেঞ্জার লোকটি।

ঘণ্টাখানেক পর শেষ। রাত আরও একটু গভীর হয়েছে। আশপাশের লোকজনের শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হলুদ রঙের বাল্বটি দোকানের অন্ধকার দূর করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

সব জল শেষ। প্লাস্টিকের গ্লাসটা দুমড়ে ফেলে, প্যাসেঞ্জার লোকটির দিকে তাকিয়ে, কাট কাট গলায় জিজ্ঞেস করলো অমিত, “তোকে যদি ছেড়ে দিই, তাহলে কি দিবি?”

লোকটি প্রথমে বুঝতেই পারেনি। রিপিট করলো অমিত।

প্রথমে চোখ দুটো বিস্ফোরিত, তারপর দ্রব্যগুণেই হয়তো একটু একটু হাসির রেখা ফুটলো মুখে।

তারপর বলল, “স্যার আমার কাছে ওই পঞ্চাশই আছে। “

– কত লোক আছে দেখেছিস?

কিছুক্ষণ দরকষাকষি। ঠিক হল, শেষটায় পাঁচ দেবে। এবার প্রশ্ন গ্যরান্টির। লোকটা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। দোকানের মালিককে ডেকে বললো, ‘‘ভূষণদা কত আছে এখানে?’’ ভূষণ বললো, “তিনের মতো হবে। বাকিটা কালকে দিয়ে দেব।”

অমিত মাথা নাড়লো। “তাহলে কালকেই হবে। আপাতত তোমরা দু’জনেই চল। জামিন হিসেবে থাকবে।”

ভূষণ রাজি হচ্ছিল না। প্যাসেঞ্জার লোকটাই রাজি করালো।

দু’জনকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল অমিত। গরমের দিন হলেও রাতে চমৎকার হাওয়া লাগে চলন্ত গাড়িতে। মধ্যে মধ্যে মাথা বের করে…

মনে এখন কোন ইতিউতি ভাব নেই। অপরাধবোধ নেই।

বিশ্বরূপদা অবশ্য ক্ষেপবে। তিনজনের জায়গায় চারজনের চার্জশিট বানাতে…

কিন্তু নিশ্চিন্ত না হয়ে কাউকে জেলে পুরে দেওয়াটা কি ঠিক হতো?

(ক্রমশ)