অফিসে ফিরে, নিজের স্কুটার নেওয়া।

তারপর, দুই বেডরুমের ফ্ল্যাটে ফেরা।  অনেকক্ষণ ধরে স্নান। এবার দুপুরের খাবার তৈরি করতে মন দেওয়া। বিশেষ কিছু ঝামেলা নেই। দু’টো প্যাকেট কাঁচি দিয়ে কেটে নেওয়া। তার ভেতরে থাকা ছোট সিলভার ফয়েলের প্যাকেটগুলো কাটা। এবার সসপেনে গরম জলের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া। তবে জলটা হিসেবে দিতে হয়। নাহলে হয় শুকিয়ে যাবে, নতুবা জল জল থাকবে। একটা গোটা পেঁয়াজ কেটে, কুচি করে ছেড়ে দিল সঙ্গে। ডিম একটা ফাটিয়ে উপর থেকে ছেড়ে দিলে ভাল হতো, কিন্তু নেই। বাজার করা হয়নি বেশ কয়েকদিন।

একলার সংসার। রোজ রোজ বাজার করার, ঝামেলা নেওয়ার মানে হয় না। সকালে একজন এসে ঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে যান। কিন্তু শেষ দু’দিন হয় নি। তবে লোক না থাকলে নোংরাও হয় না।

খেয়ে দেয়ে চমৎকার একটা ঘুম। বেলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে উঠতেই হলো। ঘর রোজ সাফ সাফাই যিনি করেন, তিনিই দুয়ারপ্রান্তে। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। দাদার খবর নিতে এসেছেন। বিরক্তির ভাবটা লুকিয়ে ফেললো অমিত। এটা শিখে নেওয়া তেমন কঠিন কাজ নয়।

তারপর তিনি বললেন, এসেছেন যখন তখন একটু সাফ সাফাই অভিযান করেই যাবেন। এর বিরুদ্ধেও বিশেষ কিছু বলার নেই। ঘুমটা গেল। শাস্তি হিসেবে, শুধু বিকেলের চা-টা বানাতে বলা ছাড়া বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না অমিত।

এমনটাই হয়। নিজের চাকরির বিষয় ছাড়া অন্য ব্যাপারে কথা বলার খুব একটা কিছু খুঁজে পায় না অমিত। আগেও পারতো না। তখন তো কথা বলার বিষয়ই খুঁজে পেত না। এখন তো তা-ও চাকরির বিষয় আছে।

কী করা এই সন্ধেবেলায়?  আর ঘুমোবার চেষ্টা করে লাভ নেই। অফিসে যাওয়ার কথা ভেবেও নিজেই বাতিল করলো ইচ্ছেটা। ওখানে সবাই অভিজ্ঞ। তাছাড়া প্রত্যেকেরই নিজের স্টাইল আছে, খবরাখবর বের করার। বিভাসদাকে বলে এসেছে। নিশ্চয়ই আজ কিছু না কিছু ইনফরমেশন বেরিয়েই আসবে। সবদিকেই খুব গোছানো লোক তিনি।

কিছুদিন আগেই ট্রেনে করে নিয়ে আসা এক বগি  “খয়ের” ধরেছিলেন। প্রতিবেশী পাহাড়ি রাজ্যে নিয়ে এসেছিল, সেই রাজ্যের সঙ্গে সীমানা থাকা বিদেশি রাষ্ট্র থেকে একজন লোক। চুপিচুপি। আমদানি শুল্ক ফাঁকি দিয়ে। খবর পেয়ে সেই মাল ধরার জন্য কত কায়দা কানুন। প্রত্যেকটা অফিসের নিজস্ব এলাকা থাকে। দেখা যাচ্ছিল, রেলপথ এই অফিসের নির্দিষ্ট এলাকার প্রায় বাইরে দিয়েই যাবে। শুধু একটা প্রান্তিক স্টেশন ছুঁয়ে যাবে। সেখানে আবার গাড়ি দাঁড়ায় না। হয়তো উচিত হতো, অন্য ফর্মেশনে ইনফরমেশন দিয়ে দেওয়া। কিন্তু নিজে করার আনন্দ, কৃতিত্বই আলাদা। সেই জন্যে, একটা চেষ্টা হিসেবে সেই প্রান্তিক রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে প্রথম অনুরোধ মালগাড়িটি আটকানোর। স্টেশন মাস্টার অপারগতা জানালে, তাকে বলা, আপনি নেক্সট যেখানে দাঁড়াবে সেখানে চিঠি লিখে বলুন, গাড়িটা এখানে থামানো সম্ভব নয়। কিন্তু  বিদেশ থেকে আসা জিনিস নিয়ে যাচ্ছে বলে এই দফতর থেকে অনুরোধ আসায়, আপনাকে অনুরোধ করছি, নির্দিষ্ট বগি কেটে তা, এই অফিসের নির্ধারিত আওতার ভেতরে পড়া রেলওয়ে স্টেশনে পাঠান। কত কাণ্ড সেই নিয়ে। প্রচুর ঝক্কি ঝামেলা করে, ট্রেনের বগি আনিয়েই ছেড়েছিলেন।

তারপরেও কি কম কাণ্ড? পার্টি চলে গেল কোর্ট কাছারি করতে। সঙ্গে একটা সার্টিফিকেট, সেই পাহাড়ি রাজ্যের এক নিম্ন পদস্থ কর্মচারীর। এখানে নাকি এনতার “খয়ের” পাওয়া যায়। সব দেশীয় মাল।

পানের সাথে খাওয়ার জিনিস খয়ের, সেও যে গাছ থেকে সংগ্রহ করতে হয় সেটাই অমিত জানতো না।

নিম্নপদস্থ কর্মচারীর চিঠি সহ, বিপক্ষ যখন সব কার্ড দেখিয়ে ফেলেছে আদালতে, তখন বিভাসদার অস্তিন থেকে বেরিয়ে এসেছিল তুরুপের তাস। সেই বিভাগের সবচেয়ে বড়কর্তার লেখা চিঠি, এই পাহাড়ি রাজ্যে এসব পাওয়া যায় না। কোনদিনই যায়নি। এসব বিদেশ থেকেই আসতে পারে।

কেসটা ডিপার্টমেন্ট জিতেছিল। কিন্তু দু’টো জিনিস মনে আছে। সেই নিম্নপদস্থ কর্মচারিটির, তারই বড় সাহেবের লেখা চিঠি দেখে হা হয়ে যাওয়া, আর কপালে হাত ঠেকিয়ে কেঁদে ফেলা। বিভাসদা, কবে গিয়ে, কী করে বড় সাহেবের সেই চিঠি জোগাড় করেছেন, সেটা কাউকে বলেননি।

অফিস যাওয়ার মানে হয় না। সিনিয়ররা উপায় ভালই বের করে রাখবেন । কালকে সেই লিডগুলো নিয়ে এগোনোই ভাল।

এখন বরং অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়াই ভাল। উৎপল বারে বারে বলে গিয়েছিল।

খুব বেশি লোক নেই হলে। তবে, মধ্য সপ্তাহে না থাকাই স্বাভাবিক। যারা আছে, তাদের সবারই বাচ্চারা বোধহয় কম্পিটিশনে যোগ দিয়েছে। আজকে মনে হয় লোকগীতির প্রতিযোগিতা। তবু ভাল। রবীন্দ্রসংগীত হলে, একই গান শুনে যেতে হতো বার বার। লোকসংগীত হলে রকমারি গান শোনার সুযোগ থাকে। সেখানে বেধে দেওয়া হয় না নির্দিষ্ট গান। অন্তত সুরঞ্জলি-র আয়োজিত অনুষ্ঠানে দিত না।

একদম সামনে তিনটে টেবিল। তিনজন আলাদা করে বসা। হাতে নিশ্চয়ই কাগজ কলম। এরাই বিচারক।

পিছনে একটা সিট খুঁজে বসে পড়লো অমিত। চোখ বন্ধ করে গান শুনলে নাকি বেশি ভালো লাগে। মেয়েটি একটি খুব পরিচিত গান গাইছে। শোনা শোনা গানটি। কোথায় যেন শুনেছিল? কার গলায়?

চোখ বন্ধ করে শুনতে শুনতেই হঠাৎ যেন একটা ঝটকা লাগলো। এটা তো রূপাঞ্জনার গলায় শুনেছিল… ঠিক এই বয়সেই ছিল তখন রূপাঞ্জনা। এই রকমেরই একটি কম্পিটিশনে…আশ্চর্য। এতগুলো বছর চলে গেছে। গানটার সুর কথা কিছু পাল্টায় নি। শোনার নয়, শুধু গাওয়ার মানুষটি বদলে গেছে।

চোখ বুজেই শুনছিল অমিত। গানটা থামার পরও খুলছিলো না। অতীতের একটা আবেশ অনেকদিন পর ফিরে আসা, চোখ খুললেই বর্তমানে।

কিন্তু খুলতেই হল। উৎপল দাঁড়িয়ে সামনে। অবাক এবং আনন্দিত মুখে। “আপনি এসেছেন অমিতদা, একবার ডাকবেন তো..’’

অপ্রভিত মুখে হাসলো অমিত। বলল, ‘‘এই মাত্র এসেছি। গান শুনছিলাম। খুব ভাল গাইলো।’’

উৎপল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে স্টেজে দেখলো। তারপর বলল, “ও তো প্রিয়া.. প্রিয়া ভট্টাচার্জি। আমাদের পাড়ার মেয়ে। ক্লাস টেন-এ পড়ে। খুব ভাল গায়। দেখবেন, নজরুল গীতি আরও ভাল গাইবে। ওর গ্রূপে চ্যাম্পিয়ন। “

পাড়ার মেয়ে, কথাটা বেশ জোর দিয়ে বললো উৎপল। ক্লাস টোয়েলভে পড়ছে। এই বয়সে, একটু পাড়া পাড়া ভাব থাকেই ছেলেদের মধ্যে। পাড়ার অনেক মেয়েদের, জন্যে অঘোষিত গার্জেনগিরি করার একটা সুযোগ সব সময়ই খুঁজে বেড়ায় এই বয়েস। অন্তত অমিতদের সময় হতো।

একটু প্রশ্রয়, একটু মোলায়েম চোখে উৎপলের দিকে তাকিয়ে হাসলো অমিত। ছেলেটা ভাল। ওদের গ্রূপের ছেলেগুলো এইসব প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। খারাপ না। ওদের দেখলে সেই বয়সটা ফিরে পায়। তাই যখন প্রথম এসেছিল সাহায্য চেয়ে, না করতে পারেনি। বরং চাকরির সুবাদে যে সব পরিচয় হয়েছে, সেখান থেকেও যথাসাধ্য সাহায্য জোগাড় করে দেয়।

রূপাঞ্জনাও চ্যাম্পিয়ন হতো। ওর গ্রুপে। সেই গ্রুপে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতো। ওর আর জয়শ্রীর মধ্যে।

তবে সব মিলিয়ে অমিত  দু-বছরই ছিল ওই শহরে। বাবা ট্রান্সফার হয়ে আসায়, এসেছিল মিড সিজনে। বহু ধরাধরি করে একটা স্কুলে ভর্তি  হওয়া। এমনিতে মুখচোরা হওয়ায়  বিশেষ বন্ধুবান্ধব হয়নি। কিন্তু যে পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল, সেখানকার একটা ছেলে তাকে জোর করে নিয়ে গিয়েছিল ওদের ক্লাবে। সেই প্রতিযোগিতা করার কাজে। সেখানেই প্রথম রূপাঞ্জনাকে দেখা। কথা প্রথম রূপাঞ্জনাই বলেছিল। মাইকটা অ্যাডজাস্ট করে দিতে বলেছিল ।

তারপর গান শুনে মুগ্ধ হবার পালা। তারপর  প্রতিযোগিতার ফর্ম থেকে ঠিকানা দেখে, বাড়ির সামনে পায়চারি। হা করে দাঁড়িয়ে থাকার অপরাধে একদিন পাড়ার ছেলেদের হাতে আড়ং ধোলাই খাওয়া।

না, আজকাল নিশ্চয়ই পাড়ার ছেলেরা একটু দয়ালু হয়েছে। কেউ আর ধোলাই খায় না বোধহয়। উৎপলকে জিজ্ঞেস করে দেখলে হতো।

মনে চিন্তাটা আসতেই, অমিতের হাসি পেয়ে গেল।

আর দু-চারটে গান শুনে বেরুবে ভাবছিল, এমন সময় ব্যস্ত হয়ে উৎপল ডাকতে এলো।

—‘‘অমিতদা, চলুন। আপনার সঙ্গে একজনের পরিচয় করিয়ে দিই। আমাদের প্রেসিডেন্ট। বনানীদি। উনি অনেক বার বলেছেন, আপনি এলে যেন পরিচয় করিয়ে দিই।’’

একটু না না করেও , যেতেই হল গ্রীন রুমে। হাতজোড় করে নমস্কার। একটু কথা বলা।

ভদ্রমহিলার তাড়া ছিল। এমনিতে কলেজে পড়ান। কলেজ থেকেই চলে এসেছেন বললেন। বেরিয়ে যাবেন এক্ষুনি। কথা শেষ হচ্ছে না, দেখে অমিত বাইরে এগিয়ে দিতে এলো। বিদায় নেওয়ার সময় বললেন, একদিন আসুন বাড়িতে। নতুন অনুষ্ঠান নিয়ে কথা হবে।

ঠিক আছে। কোথায় থাকেন জিজ্ঞেস করতেই ঝাঁপিয়ে এলো উৎপল।

—”আরে অমিতদা, উনি তো ডিস্ট্রিক্ট জজ সাহেবের মিসেস। জায়গাটা তো তুমি চেনোই।”

(ক্রমশ)