পর্ব-১৮
(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)
“মণি-মাণিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন না, তাহা দুষ্প্রাপ্য। এই হিসাবে নারীর মূল্য বেশি নয়, কারণ সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটা নিত্য প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই। কিন্তু যদি কখন ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধ করি একফোঁটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্তত করেন না। তেমনি- ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইহার যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাবে— আজ নহে। আজ ইনি সুলভ।”
– শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (নারীর মূল্য)।
বাজার অর্থনীতি নিয়ম অনুসারে যে জিনিস সহজলভ্য, সেই জিনিসের দাম কম। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যে তারই স্বীকৃতি। তিনি প্রবন্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মূল্যমানের অন্যতম সূচক ধরেছেন। উদাহরণ স্বরূপ তিব্বত ও ফিজি— দুই দেশের রমনীদের কথা বলেছেন—
“তিব্বতের রমনীদের চরিত্র বিষয়ে খুব সুনাম নাই। শুধু যে তাহার সব কয়টি ভাইকেই স্বামীত্বে বরণ করে তাহা নহে, করুণা হইলে পাড়া-প্রতিবেশীর আবেদন-নিবেদনও অগ্রাহ্য করে না। তথাপি দেশের পুরুষেরা তাহাদের নারীকে অত্যন্ত সম্মান করে।”
এটা ঠিক নারীর যৌন স্বাধীনতা আপাতদৃষ্টিতে নারীর সম্মান বৃদ্ধি না করলেও নারীর মূল্য বৃদ্ধি করে এবং সমাজে সম্ভ্রম আদায় করে। এই উদাহরণে মনে হতে পারে নারীদের বহুগামিতাকে সমর্থন করা হচ্ছে বা অসৎ চরিত্রের গুণগান করা হচ্ছে; তবে এখানে মানব সমাজের একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়েছে মাত্র।
এর বিপরীত দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ফিজি দ্বীপ নিয়ে। তিনি বলেছেন, “এমন প্রতিব্রতা স্ত্রী আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ – স্বামীর গোরের উপর ইহারা স্বেচ্ছায় উদ্বন্ধনে প্রাণ দেয়, কিন্তু পুরুষেরা শুধুই বহুবিবাহ করে না, কথায় কথায় স্ত্রী হত্যা করে – নারীর স্থান এখানে গৃহপালিত পশুর সমান, বরং নীচে।”
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পতিব্রতা বা তথাকথিত সতী হলেই সমাজের সম্মান পাওয়া যাবে বা মূল্য থাকবে তার কোনও মানে নেই। আমাদের সমাজে পুরুষের মূল্য বেশি; কিন্তু পুরুষের সংখ্যা তো অপ্রতুল নয়। ভারতবর্ষে পুরুষের সংখ্যা নারীর থেকে বেশি। সেন্সাস ২০২১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের নারী ও পুরুষের জাতীয় অনুপাত ৯৪৩:১০০০ আর পশ্চিমবঙ্গের অনুপাত ৯৪৭:১০০০; তাহলে তো নারীর মূল্য থাকা উচিত।
প্রাচীন যুগে পুরুষের সংখ্যা নারীর তুলনায় কম ছিল। পুরুষের তখন প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধ ও শিকার করা। যুদ্ধ ও শিকার করতে গেলে লোকক্ষয় হতো। ফলে পুরুষের সংখ্যা কমে যেত নারীর তুলনায়। কিন্তু নারী পুরুষের অনুপাত ঠিক রাখার জন্য শিশু কন্যা হত্যা করা হতো। আদিম জাতিরা তো করতোই, সুসভ্য ভারতে রাজপুতরা করতো, ধনী আরব শেখরা করতো। সেই ঐতিহ্য এখনও বহমান। আজও কন্যা সন্তান হলে মুখে নুন দিয়ে মেরে ফেলা হয়, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্যে নিয়ে কন্যা ভ্রুণের খবর জেনে ‘ভ্রুণহত্যা’তো আকছার ব্যাপার। যদিও লিঙ্গ নির্ধারণ আইনের চোখে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আদিম যুগে নারীর স্থান ছিল উচ্চে। তাহলে নারীর মূল্য ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকলো কেন? এ বিষয়ে হারবার্ট স্পেন্সর লিখেছেন, “দেশের লোক যত যুদ্ধ প্রিয়, অন্তত আত্মরক্ষার জন্য তাহাদিগকে ঘরে বাইরে যত বেশি লড়াই করতে হয়েছে, তারাই তত বেশি নারীর ওপর অত্যাচার করেছে, তত বেশি গায়ের জোর খাটিয়েছে। নারী যে স্বাভাবিক কোমলতা ও নম্রতার জন্যই স্বেচ্ছায় এত নির্যাতন এবং অধীনতা স্বীকার করেছে তা নয়। তারা গায়ের জোরে পেরে ওঠেনি বলে স্বীকার করেছে; পারলে স্বীকার করতো না। কারণ, দেখা গেছে যেখানে সুবিধা এবং সুযোগ পেয়েছে সেখানে নারী-পুরুষের থেকে একতিলও কম নিষ্ঠুর বা কম রক্তপিপাসু নয়।”
অতএব মেয়েরা গায়ের জোরে পিছিয়ে গেল বলে ছেলেরা নিজের মতো করে পৃথিবী গড়ে নিলো, এমনকি মনের মতো করে মেয়েদের সাজিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। লড়াইয়ের পর বিজিত দলের নারীদের মনে করলো অধীকৃত সম্পদ, সেইসঙ্গে তাদের মনে করলো ভোগের বস্তু। এই জন্য এক পুরুষের বহু স্ত্রী সম্মান ও বলের চিহ্ন ছিল। এভাবে নারী ক্রমশ হয়ে উঠল ভোগ্যপণ্য। শুধু ভোগ্যপণ্য নয় সুলভ পণ্য; যার সামাজিক মূল্য অধিকাংশের কাছে শূন্য।
আমাদের শাস্ত্রে রস ছয় প্রকার। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ রস ‘মধুর রস’। মধুর রসের উৎপত্তি মানবের যৌন বন্ধন থেকে। এই রস অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য মানুষ সতীত্বের তত্ত্ব সৃষ্টি করেছে, এই রস মাহাত্ম্য গেয়েই মানুষ কবি হয়েছে। এই রস-বোধের প্রধান উপাদান নারীর সৌন্দর্য। তাই সমাজ সংসারে নারীর মূল্য তার রূপে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ বিষয়ে লিখেছেন, -“নারীত্বের মূল্য কি? অর্থাৎ, কি পরিমানে তিনি সেবা পরায়ন, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে কষ্টে মৌনা। অর্থাৎ তাঁহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমানে তিনি রূপসী। অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন।”
আপাত মূল্যহীন নারীর প্রকৃত মূল্য নির্ধারণে তিনি বলেছেন, “আশ্চর্য, এত অত্যাচার, অবিচার, পৈশাচিক, নিষ্ঠুরতা সহ্য করা সত্ত্বেও নারী চিরদিন পুরুষকে স্নেহ করিয়াছে! যাহাকে সে পিতা বলে, স্বামী বলে, সে যে এত নীচ, এমন প্রবঞ্চক, একথা বোধ করি সে স্বপ্নেও ভাবিতে পারেনা। বোধ করি এখানেই তাহার মূল্য।”
আমাদের সমাজে নারীরা আপাত মূল্যহীন বা সমাজ নারীদের মূল্য দেয় না; সমাজ বলতে আমি নারী-পুরুষ উভয়কেই বোঝাচ্ছি। তাই নারীপাচার বা নারী বিকিকিনি খুবই সুলভ।
তথ্যসূত্র:
১. বঙ্গীয় শব্দকোষ – হরিচরণ বন্দ্যেপাধ্যায়
২. নারীর মূল্য – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়