পর্ব ১৯
(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারীপাচার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)
ঘৃতকুম্ভসমা নারী তপ্তাঙ্গার সমাঃ পুষান্।
তস্মাদ্ঘৃতঞ্চ বহ্নিঞ্চ নৈকস্থানে চ ধারয়েৎ।।
যথৈব মত্ত মাতঙ্গ সৃণিমুদগর যোগতঃ।
স্ববশং কুরুতে যন্তা তথা স্ত্রীনাং প্ররক্ষকঃ।।
[পদ্মপুরাণ]
নারী হল ঘিয়ের কলস ও পুরুষ তপ্ত অঙ্গার। তাই ঘি আর আগুনকে কাছাকাছি রাখতে নেই। মাহুত যেমন মুগুর দিয়ে মত্ত হস্তিকে বশ করে, তেমনি বশ করতে হবে নারীকে।
আগুন আর ঘি পাশাপাশি রাখলে ঘি গলবে। এতো প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু এতে যতো দোষ হল ঘিয়ের! যে গলালো, সেই আগুনের কোন দোষ হবে না! মুগুর দিয়ে নারীকে শাসন করতে হবে, পুরুষকে কিছু বলা হবে না? এরকমই সব ধর্মীয় বিধান আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রে।
আরও আছে, হিন্দু সমাজে অনুলোম বিবাহ নারীর বর্ণোন্নতি ঘটে না, প্রতিলোম বিবাহে নারীর বর্ণচ্যুতি ঘটে। উচ্চবর্ণের ছেলে ও নিম্নবর্ণের মেয়ে বিয়ে হলে অনুলোম বিবাহ। আর উচ্চবর্ণের মেয়ে ও নিম্নবর্ণের ছেলের বিয়েকে প্রতিলোম বিবাহ বলা হয়। হবে নাই বা কেন তৈত্তিরীয় সংহিতায় বলা আছে, সর্বগুনাম্বিতা নারী ও অধমতম পুরুষের থেকে হীন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, “নারী মোক্ষ দ্বারের কপাট, হরিভক্তি বিরোধী, সংসার বন্ধন স্তম্ভের রজ্জু, যা ছিন্ন করা যায় না। নারী বৈরাগ্যনাশের বীজ, সর্বদা অনুরাগ বর্ধনকারী, সাহসের ভিত্তি ও দোষের গৃহ। নারী অভিশাপের ক্ষেত্র, মূর্তিমতী কপটতা অহংকারের আশ্রয়, নারীর মুখে মধু ও অন্তরে বিষ।”
এরকম দোষারোপ শুধু হিন্দু ধর্মে নয় অন্যান্য ধর্মেও আছে। বাইবেলে বলা হয়েছে, নারীরা হল সব অনিষ্টের মূল (Root of all evil)। হাদিসে বলেছে, “নারীর চেয়ে ক্ষতিকর কোনো দুর্যোগ আমি রেখে যাচ্ছিনা।” বোঝাই যাচ্ছে, পৃথিবীতে প্রচলিত প্রধান ধর্মমতগুলি কী চোখে নারীদের দেখতো।
কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসে সব দিন এরকম ছিল না। সৃষ্টির শুরুতে সভ্যতা ছিল মাতৃতান্ত্রিক। এই মাতৃ প্রধান্যের অর্থ এই নয় যে, পুরুষের চেয়ে নারী বলবান ছিল বা শৌর্য-বীর্য অধিক ছিল। এর কারণ ছিল, ‘মা’ হিসাবে নারীর পরিচিতি। সন্তান একমাত্র মাকেই চিনত, মা-ই ছিল তার একমাত্র আশ্রয় বা অবলম্বন। পারিবারিক বন্ধনের মূল যে প্রেম, স্নেহ প্রভৃতি হৃদয় বৃত্তির প্রকাশ সে একমাত্র মায়ের মধ্যে দেখতে পেত। মা-ই ছিল পরিবারের কেন্দ্রে।
আদিম মানুষ মনে করত, সন্তানের জন্ম দেওয়া রহস্যময়ী দৈবশক্তি বা দেবতার কাজ। তাঁরা বিশ্বাস করত— নারীর মধ্যে সেই শক্তি বা দেবী আছেন। কারণ, সে লক্ষ্য করত, জগতে সব স্ত্রী জাতীয় জীবই সন্তানের জন্ম দেয়। এজন্য অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, মানুষের আদি-দেবতা মাতৃদেবতা। নারীর মধ্যে যে শক্তি বা দেবতা আছেন, তিনি হলেন মাতৃদেবতা।
মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পায় অনেক পোড়ামাটির নগ্ননারী মূর্তি পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এগুলি মাতৃদেবতা বা ধারিত্রী দেবতা। মাটি ফসল দিত, তাই ধারিত্রীকে নারী হিসাবে কল্পনা করতো। ফলে পৃথিবীও হয়ে উঠল মাতৃদেবতা। তখন মানুষ মানব শিশুর জন্ম রহস্য জানতো না। কেমন করে নারীর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে একটি নতুন জীবন, তা সে বুঝতে পারতো না। যখন মানুষ জানতে পারল, সন্তান জন্ম একটি জৈবিক ব্যাপার, এতে পুরুষের ভূমিকা আছে বুঝতে পারল, তখন থেকেই সমাজের রাশ নিজের দিকে টেনে নিতে থাকে।
সন্তানের জন্মদাতা হিসাবে আধিপত্য বিস্তারের জন্যই হোক বা সম্পদ নিজের পরিবারের মধ্যে কুক্ষিগত করে রাখার জন্যই হোক পরিবারে এলো পিতৃপ্রাধান্য। ততদিনে কৃষিকাজ আবিষ্কার হয়ে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে সম্পত্তির চেতনা চলে এসেছে। ক্রমে সমাজ হয়ে উঠল পিতৃতান্ত্রিক। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ধর্মমতও হল পিতৃতান্ত্রিক। ধর্মগ্রন্থে সমাজে নারীর ভূমিকা পুরুষের তুলনায় খাটো করে দেখালো। তার নিদর্শন আগেই দেওয়া আছে।
সমাজে নারীর প্রধান ভূমিকা ছিল, সন্তান জন্ম দেওয়ার মধ্য দিয়ে জীবের অস্তিত্ব জগতে টিকিয়ে রাখা। নারীদের এই প্রজনন ক্ষমতাকে অস্বীকার করার জন্য হিন্দু পুরাণ নারীর জরায়ুকে প্রত্যাখ্যান করল। সেখানে দেখা যাচ্ছে দেবতা বা ঋষিরা যেখানে সেখানে বীর্যপাত করছে, আর সেখানে জন্ম নিচ্ছে সন্তান। এমনকী গ্রীকপুরাণে পিতা জিউসের শির থেকে জন্ম নিচ্ছে সম্পূর্ণ যুবতী রূপে অ্যাথেনা।
নারীদের ঋতুমতী হওয়া একটা প্রাকৃতিক ঘটনা, এটাকেও সমস্ত ধর্মপুস্তকে দেখা হয়েছে ভয়ের চোখে এবং ঋতুমতী নারীদের নির্দেশ করা হয়েছে নিষিদ্ধ ও দূষিত প্রাণী রূপে।
এই কারণে কয়েক হাজার বছর ধরে নারী শুনে আসছে সে ‘নিকৃষ্ট’। এর ফলে তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এক হীনমন্যতাবোধ। তার ওপর ধর্মের সরাসরি বিধান তুমি পুরুষের অধীন। হিন্দু মতে ‘পতি পরম গুরু’। বাইবেলে – ‘সে তোমার উপর কর্তৃত্ব করবে’, কোরানে – ‘পুরুষ নারীর কর্তা’। ফলে সমাজে যদি কোন কারণে নারীর পদস্খলন হয় বা পাকচক্রে অন্ধকার জগতে গিয়ে পড়ে, সে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। ফলে নারী পাচারের পথ হয় সুগম।
তথ্যঋণ-
১) শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা- প্রথম খন্ড- উপেন্দ্রকুমার দাস- রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার।
২) নারী – হুমায়ুন আজাদ (আগামী প্রকাশনী, বাংলাদেশ)।