পর্ব ২০
আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারীপাচার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।
“সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে ঘোর নিদ্রায় মগ্ন করিলে, তিনি নিদ্রিত হইলেন; আর তিনি তাহার একখান পঞ্জর লইয়া মাংস দ্বারা সেই স্থান পূরাইলেন। সদাপ্রভু ঈশ্বর আদম হইতে গৃহীত সেই পঞ্জরে এক স্ত্রী নির্মাণ করিলেন ও তাহাকে আদমের নিকটে আনিলেন।”
এই হল বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুসারে নারী সৃষ্টির গল্প। এজন্য হাদিসে বলেছে, স্ত্রীগণকে সদুপদেশ দাও, কেননা পাঁজরের হাড় দ্বারা তার সৃষ্টি। পাঁজরের ওপরের হাড় সর্বাপেক্ষা বাঁকা— যদি ওকে সোজা করিতে যাও তবে ও ভেঙ্গে যাবে, যদি ছেড়ে দাও তবে আরো বেঁকে যাবে।”
আদি পুরুষ আদমের বক্ষপঞ্জর দিয়ে তৈরি আদি নারীর নাম ‘ইভ’। ইভ আদমকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে প্ররোচিত করে; যার ফলে তাদের জ্ঞান চক্ষু উন্মোচিত হয়। এই অপরাধের জন্য সদাপ্রভু ঈশ্বর নারীকে বলেন, “স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকিবে; এবং সে তোমার উপরে কর্ত্তৃত্ব করিবে”।
এই কারণে ল্যাটিন ধর্মতাত্ত্বিক টারটুলিয়ান (155-220 AD) লিখেছিলেন, “নারী তুমি শয়তানের দ্বার, তুমি পুরুষকে বিপথগামী করেছো, যাকে শয়তান সরাসরি আক্রমণের সাহস করেনি”।
প্রায় সব ধর্মেই মেয়েদের ‘ভিলেন’ করে দেখানো হয়েছে, নৈতিকতার বিচারে। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে, “স্ত্রী জাতি লঘুচিত্ত এবং সকল দোষের মূল। তারা সদ্বংশীয় রূপবতী ও সধবা হলেও সদাচার লঙ্ঘন করে। ধনবান রূপবান ও বশীভূত পতির জন্যও তারা প্রতীক্ষা করতে পারে না, যে পুরুষ কাছে গিয়ে কিঞ্চিৎ চাটুবাক্য বলে, তাকেই কামনা করে। উপযাজক পুরুষের অভাবে এবং পরিজনদের ভয়েই নারীরা পতির বশে থাকে। তাদের আগম্যা কেউ নেই, পুরুষের বয়স বা রূপ তারা বিচার করে না”। পরিশেষে ভীষ্ম অবশ্য বলেছেন, “স্ত্রী লোককে সর্বদা রক্ষা করা উচিত। সাধ্বী ও অসাধ্বী দুই প্রকার স্ত্রী আছে, লোকমাতা সাধ্বী স্ত্রীগণ এই পৃথিবী ধারণ করেন। … তাদের (অসাধ্বী) সাবধানে রক্ষা করতে হয়, নতুবা তারা ব্যভিচারিণী হয় এবং প্রাণহানি করে।”
মহাভারতের বাক্য সবৈব মিথ্যা নয়; তবে একথা ঠিক পিতৃতান্ত্রিকতায় দুষ্ট। এখানেও চাটুকার পুরুষদের বিরুদ্ধে কিছু বলা হয়নি। শুধু তাই নয়, মহাভারতের নারীবিদ্বেষী কথাগুলি বলানো হয়েছে নারীর মুখ দিয়ে। কথাগুলি অপ্সরা পঞ্চচূড়া বলেছেন নারদকে। শুধু মহাভারতে নয় অন্য শাস্ত্রে স্ত্রী জাতির কুৎসা করানো হয়েছে স্ত্রী জাতিকে দিয়ে। এ এক পুরুষ জাতির কৌশল।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পিতৃতন্ত্রের একটি সুন্দর ষড়যন্ত্র হচ্ছে নারীদের এক শ্রেণীকে লাগিয়ে রাখা আরেক শ্রেণীর বিরুদ্ধে। যেমন বেশ্যার বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা সতী নারীকে, কর্মজীবী নারীর বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা গৃহিনীকে, পরিবারে শাশুড়ি-বউ-জা এদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে রাখা। পুরুষ বিচরণ করে ঘরে বাইরে দু জায়গাতেই। আর নিজের সামাজিক, আর্থনীতিক ক্ষমতার সাহায্যে নারীদের দু-দলকে লিপ্ত রাখে চিরশত্রুতায়।
এছাড়া পুরুষতন্ত্র স্বীকৃতি দেয় কিছু নারীদের। তাদের স্বীকৃতি দেয় চাকরি দিয়ে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা দিয়ে, রাজনীতিতে নেতৃত্বের স্থান দিয়ে, শিল্পকলা জগতে সুখ্যাতি দিয়ে। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সব প্রতিষ্ঠিত নারীরা কাজ করে পুরুষতন্ত্রের পক্ষে। সরকারি দফতরে নারী আধিকারিক থাকলেও উপভোক্তা নারীরা বাড়তি কোনও সুবিধা পান না, ব্যবসায়ী নারী ব্যবসার জগতে নারীদের নিয়োজিত করে বাড়তি ঝুঁকি কেউ নিতে চান না, রাষ্ট্রতন্ত্রে নারী যতই ক্ষমতা পান— অন্য নারীকে দায়িত্ব ভার দিতে সাহস পান না। শিল্প কলা জগতে নারী এখনও সৌন্দর্য বর্ধনকারী।
নারীজাতির দুর্নাম করার উদ্দেশ্যে অনেকে বলেন, “নারীরাই, নারীর শত্রু।” এর মধ্যেও পুরুষতন্ত্রের কারসাজি আছে। তবে নারীপাচার জগতে নারীদের প্রত্যক্ষ মদত দেখা যায়। আজ যে নারীপাচারের বিস্তৃত জগত, তার সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে মহিলারা। আমাদের দেশে যে যৌনপল্লী আছে, তাতে যারা মালকিন আছে, যারা সাধারণ ভাবে ‘মাসি’ নামে পরিচিত— তারা তো সব মহিলা। এরাও এক সময় আড়িকাঠির মাধ্যমে বা বাধ্য হয়ে এই পেশাতে এসেছিল। বিগত যৌবনা হলে তারা এই পেশার ধারক হয়েছে। নারীপাচারে সাহায্যকারীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা অনেক বেশি। কাজ দেওয়ার নাম করে নিয়ে গিয়ে দূর দেশে বিক্রি করে দেওয়া বা কাজ করিয়ে পয়সা না দেওয়া এটা নারীপাচারের অন্যতম কৌশল। এই কাজের টোপ সাধারণত মেয়েরা দেয়। সেও একসময় হয়তো এইভাবে পাচার হয়েছিল, ফিরে এসে তার জীবনের ভুয়ো রঙিন গল্প শুনিয়ে নিয়ে যায় আরও কয়েকজনকে। বিয়ের নাম করে যে পাচার হয় তাতেও পাত্রের খোঁজ নিয়ে আসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরা। সেই মেয়েদেরও দালাল মারফৎ যোগাযোগ হয়ে বিয়ে হয়েছিল। এখন সেই মেয়েরাই দালালি করে, শ্বশুরবাড়ির দেশে মেয়ে পাচার করে। সবচেয়ে মারাত্মক যে পাচার, তা হল প্রেমের অভিনয় করে পাচার। এক্ষেত্রে মূল নায়ক অবশ্যই একটি সুদর্শন পাত্র কিন্তু তার চিত্রনাট্যে সহযোগিতা করে নানা মহিলারা। এগুলি পরে বিস্তৃত আলোচনা করা হবে।
দেখা যাচ্ছে, এটা একটা আবর্ত। যে নারী একসময় পাচার হয়েছিল, সে-ই পাচারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে। এর থেকে মুক্তির উপায় আছে? পাচার হওয়া নারীরা যদি একটু ঘুরে দাঁড়ায় তবে একটা দিশা আছে। কিন্তু তার বৃদ্ধাবস্থায় ভরণপোষণ বা ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দায়িত্ব কে নেবে!
তথ্যঋণঃ-
১. মহাভারতঃ সারানুবাদ – রাজশেখর বসু।
২. পবিত্র বাইবেল- ভারতের বাইবেল সোসাইটি।
৩. নারী – হুমায়ুন আজাদ (আগামী প্রকাশনী, বাংলাদেশ)।