পর্ব-২১

আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারীপাচার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন বালিহাঁস- এর পাতায়

  কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী বিবাহ আট প্রকার।

১) ব্রাহ্ম-বিবাহ: অলঙ্কৃতা কন্যাকে পাত্রের হাতে সমর্পণ,

২) প্রাজাপত্য বিবাহ: বর কন্যা একত্রে ধর্মাচরণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বিবাহ,

৩) আর্ষ-বিবাহ: বরের নিকট থেকে দুটি গরু নিয়ে কন্যাপ্রদান,

৪) দৈববিবাহ: যজ্ঞবেদি মধ্যে ঋত্বিকের নিকট কন্যাপ্রদান,

৫) গান্ধর্ববিবাহ: নিজেদের ইচ্ছায় পুরুষ নারী মিলিত হলে,

৬) আসুরবিবাহ: কন্যার পিতাকে শুল্কধন দিয়ে কন্যাগ্রহণ,

৭) রাক্ষস-বিবাহ: বলসহকারে কন্যাগ্রহণ, এবং

৮) পৈশাচ-বিবাহ: ঘুমন্তকন্যাকে হরণ করে বিবাহ।

            দেখা যাচ্ছে, প্রাজাপত্য বিবাহ ও গান্ধর্ববিবাহ ছাড়া অন্য কোনও বিবাহে কন্যার মতামতের গুরুত্ব ছিল বলে মনে হয় না। ‘বিবাহ’ যাকে নারীর একমাত্র ভবিতব্য ধরা হয়, তাতে নারীদের সেরকম কোনও ইচ্ছাপ্রকাশের অবকাশ নেই। কিন্তু পুরাণে সাবিত্রী, দময়ন্তী এবং স্বয়ং গৌরী (পার্বতী) নিজ নিজ স্বামী নির্বাচিত করেছিলেন। ইতিহাসের পাতায় অনেক স্বয়ংবর সভার উল্লেখ পাই।

         আজকাল হিন্দু সমাজে অনুষ্ঠান করে যে বিবাহ হয়, তা সবই ব্রাহ্ম-বিবাহ। গান্ধর্ববিবাহ সরাসরি না হলেও ছেলে ও মেয়ে দুজনের পছন্দ মতো বিবাহ আজ সবচেয়ে বেশি, তবুও শেষে অনুষ্ঠান করে বিবাহের সময় ব্রাহ্ম-বিবাহের পথ নিতে হয়। এখন বিয়েতে যতই মেয়েদের মত নেওয়া হোক না কেন, বলা হয় – মেয়ের বিয়ে হল ও ছেলে বিয়ে করল। আজও বিয়ের বাজারে কনে পিতৃতান্ত্রিকতার নিয়ন্ত্রণে।

          সে যুগে মেয়েদের যে বয়সে বিয়ে হতো তখন, মেয়েদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিপক্কতা আসতো না। শুধু মেয়েদের কেন ছেলেদেরও অল্প বয়সে বিয়ে হতো। তবে শাস্ত্রে সাবালক যুবকের সঙ্গে নাবালিকা কন্যার বিবাহের বিধান আছে। মনুসংহিতায় বলা আছে, “তিরিশ বছরের যুবক মনোমতো বারো বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। চব্বিশ বছরের যুবক মনোমতো আট বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে।”

         কৌটিল্য বলেছেন, “বারো বৎসর বয়স হলে স্ত্রী প্রাপ্তবয়স্কা বলে ধরা হবে এবং স্বামীগৃহের কাজকর্মে নিয়োজিত হবে। স্বামীর বয়স ষোল বছর হলে সেও সাবালক হবে।” কৌটিল্য মেয়েদের বিবাহের উপযুক্ত সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন – মেয়েদের রজঃস্বলা হবার সাথে সাথে। সাতটি ঋতু অতিবাহিত হবার পরেও যে কন্যার বিবাহ দেওয়া হয়নি, সেই কন্যার পিতা তার উপর অধিকার হারাবেন। মনু বলেছিলেন, ঋতুমতী কন্যাকে তিন বছরের মধ্যে পিতা-মাতা যদি বিবাহ না দেন তাহলে কন্যা নিজের পছন্দমতো নিজের স্বামী মনোনয়ন করবেন; এতে কোনও পাপ হবে না। রজঃস্বলা কন্যার পাত্র বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও কন্যা সে সময় প্রায় নাবালিকা থাকে। নাবালিকা কন্যার বিবাহ তখন একমাত্র ভবিতব্য ছিল।

             সে যুগ তবু ভাল ছিল; মেয়েরা রজঃস্বলা হলে বিবাহ দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে বাংলায় শিশু বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো। যাকে মহিমান্বিত করার জন্য বলা হত “গৌরীদান”। দেখা গেছে চার বছরের শিশু কন্যারও বিবাহ হতে। যেমন, প্রথম বিধবা বিবাহের পাত্রী কালীমতি দেবীর প্রথম বিবাহ হয়েছিল মাত্র চার বছর বয়সে। এবং তিনি বিধবা হন ছ’ বছর বয়সে। পুনরায় বিবাহ অর্থাৎ বিধবা বিবাহ হয় ১০ বছর বয়সে। এখনের হিসাবে তখনও তিনি নাবালিকা।

           এই গৌরীদান মাহাত্ম্যের বাল্যবিবাহ বাংলায় আমদানি করে কনোজিয়া ব্রাহ্মণরা। কিংবদন্তি অনুসারে গৌড়ের রাজা আদিশূর বৈদিক যজ্ঞ করার জন্য কান্যকুব্জ থেকে ৫ জন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ এনেছিলেন। আদিশূর রাজার ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায় না। তবে সেন রাজত্বে বল্লাল সেনের আমলে এদের মর্যাদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বল্লাল সেন কৌলিন্য প্রথা চালু করেছিলেন। কৌলিন্য প্রথা বাল্যবিবাহকে ভীষণ ভাবে উৎসাহিত করেছে।

           গৌরী দানের স্বপক্ষে বলা হয় হতো, মেয়ে শৈশবে শ্বশুরবাড়ি গেলে নতুন পরিবেশে সে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে; তাতে সংসারের মঙ্গল হবে। পরবর্তীকালে এই প্রথা কুলিনদের থেকে সর্বস্তরের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, বাংলায় অস্থিরতা ও নিরাপত্তা হীনতা। যেমন –  মুসলিম আক্রমণ, হার্মাদের লুঠ, মগের মুলুক, ইংরেজদের আগমন ইত্যাদি। তখন বাঙালি পরিবারের কিশোরী ও যুবতী মেয়েরা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। তাই তাদের বাল্যকালে বিয়ে দিয়ে অভিভাবকেরা নিশ্চিন্ত হতে চাইল। বিবাহিত মেয়ে লুট হয়ে গেলে স্বামী আবার বিয়ে করতে পারবে। এতে বংশমর্যাদা হানি হবে না। কিন্তু কুমারী মেয়ে লুট হয়ে গেলে বংশের মুখে কালি পড়বে।

             বর্তমান যুগে যে এই অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়েছে তার নয়। আজও বাংলার বহু মেয়েকে সাবালিকা হওয়ার আগে বিয়ে দিয়ে দিতে হয়; ছেলেদের পিছনে লাগার ঠেলায়। স্কুলের রাস্তায়, টিউশনির গলিতে ওত পেতে থাকে রোমিওর দল। অভিভাবকেরা বদনামের ভয়ে কিশোরী মেয়েদের বিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। বাল্যবিবাহ আটকাতে সরকারি প্রচেষ্টায় ত্রুটি নেই। সরকার এনেছে নানা প্রকল্প। যেমন – কেন্দ্রীয় সরকার “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও”, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের “কন্যাশ্রী”, “রূপশ্রী”। চাইল্ডলাইন সদা তৎপর। তা সত্ত্বেও খবর কাগজে প্রায় উঠে আসে বাল্যবিবাহের খবর।

          আগেকার দিনে বাল্যবিবাহের দরুণ বাল্যবিধাবার সংখ্যা বাড়তো। আর বাল্যবিধবারা সহজেই পাকচক্রে পতিতাপল্লীতে আশ্রয় পেত। আধুনিক যুগে বাল্যবিবাহের ফলে অল্প বয়সি বিবাহ বিচ্ছিন্নার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। অনেকে অল্প বয়সেও বিধবাও হচ্ছে। আমাদের সমাজ এখনও দ্বিতীয় বিবাহ বা বিধবা বিবাহে সড়গড় নয়। তাই এইসব অসহায় মেয়েদের ভরণ পোষণের দায় তাদের নিজেদের নিতে হয়। আর সমাজ তাদের জন্য ফেঁদে রেখেছে পৃথিবীর ‘আদিম ব্যবসা’।

              বাল্যবিবাহের অন্যান্য কুফল আর বলার দরকার নেই। আমরা বলতে পারি, বাল্যবিবাহের ‘অভিশাপ’ নারী পাচারকারীদের ‘বর’ দিয়েছে।

তথ্যসূত্র:

১. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র: সংক্ষিপ্ত অনুবাদ – সুকুমার শিকদার (অনুষ্টুপ)

২. মনুসংহিতা: সম্পাদনা ও ভাষান্তর- চৈতালী দত্ত (নবপত্র প্রকাশন)।

৩. বাংলাদেশের ইতিহাস (১খন্ড) – শ্রী রমেশচন্দ্র  মজুমদার।

৪. বৃহৎ বঙ্গ – দীনেশচন্দ্র সেন