স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভারতের বহু ধনী মানুষ তাঁদের অর্থ দান করেছেন। মহিলারা গা থেকে খুলে দিয়েছেন সোনার গয়না। সুভাষচন্দ্রের গলার একেকটি মালা নিলামে কিনে নিয়েছেন দেশভক্ত তাঁর অনুগামীরা। ইতিহাসের পাতায় সেসব কথা রয়ে গিয়েছে সোনার অক্ষরে। কিন্তু সমাজ যাদের দূরে সরিয়ে রেখেছে, সেই সোনাগাছি, চিৎপুরের পতিতারাও তাঁদের সংগ্রহ করা অর্থ তুলে দিয়েছেন স্বদেশী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের হাতে। এমনকি, অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের হাতেও টাকাপয়সা তুলে দিতে চেয়েছিলেন তাঁরা।
সময়টা ১৯০৬ সাল। আগের বছরেই বঙ্গভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। বাংলা জুড়ে স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার। উত্তাল সেই দিনগুলিতে স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত রাস্তায় নেমে পড়েছে। এমনকি, স্বদেশী আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমেছেন পতিতারাও। দলে দলে বিভক্ত হয়ে রাস্তায় রাস্তায় স্বদেশী গান গেয়ে তাঁরাও টাকা তুলেছেন।
তবে সেই টাকা তাঁরা দিলেন কোথায়?

প্রশ্নটা মনে এসেছিল অরবিন্দ ঘোষের ছায়াসঙ্গী অবিনাশ ভট্টাচার্যের। বাংলার বিপ্লব আন্দোলনের ইতিহাসে অবিনাশ ভট্টাচার্য কার্যত উপেক্ষিত একটি নাম। অথচ অরবিন্দ ও তাঁর ভাই বারীন ঘোষের সঙ্গে একই ছাদের নীচে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন তিনি। বাংলায় গুপ্তসমিতি গঠনের শুরু থেকেই নীরবে সংগঠনের কাজ করেছেন। আড়বেলিয়া থেকে এসে কলকাতায় এসে যুবক অবিনাশ প্রথমে যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, পরে বারীন ঘোষ এবং শেষে অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে এক ছাদের নীচে কাটিয়েছেন। যুবক অবিনাশ ছিলেন সেই অগ্নিযুগের অন্যতম মুখপত্র ‘যুগান্তর’ পত্রিকার ম্যানেজার। আলিপুর বোমা মামলায় অরবিন্দের সঙ্গে কলকাতার একই বাড়ি থেকে একসঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। আন্দামান সেলুলার জেলে কাটিয়েছেন দীর্ঘকাল। সেই অবিনাশ ভট্টাচার্য তাঁর লেখা ‘পুরনো কথা’-য় ‘পতিতার টাকা’ বিষয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছিলেন।
১৯০৬ সাল। স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ারে ভাসছে কলকাতা। মহানগরের রাস্তায় রাস্তায় স্বদেশী গান গেয়ে অনেক টাকা তুলছে পতিতারাও। অবিনাশ প্রথমে অনুশীলন সমিতি পরে যুগান্তর দলের সক্রিয় কর্মী। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীরা তখন গোপনে গোপনে অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করে ইংরেজকে বড়সড় ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু টাকার বড় অভাব। বিপ্লবী অবিনাশের মনে প্রশ্ন এসেছিল, পতিতাদের তোলা এত টাকা যায় কোথায়? এ নিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদকে…।

পুরোনো সোনাগাছি

অবিনাশ লিখছেন—
…ক্ষীরোদবাবুকে জিজ্ঞাসা করলুম সে কথা, তিনি বললেন, ‘‘টাকা ওরা অনেক পায়, সমস্তই দেশের কাজে দেয়।’’
—কার কাছে দেয়?
—অনেক স্বদেশী কর্মীর হাতে সব দিয়ে দেয়। তুমি চাও, বল তো আমি সে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
—নিশ্চয়ই চাই। আপনি করে দিন।
ক্ষীরোদবাবু তিনখানি চিঠি লিখে আমাকে দিলেন। একটি সোনাগাছীর সর্ব্বশ্রেষ্ঠা বাঈজীর নামে, দ্বিতীয়খানা চিৎপুর রোডে এক বাঈজীর নামে, তৃতীয় পত্রটি আর একটি বাঈজীর নামে। প্রথমে সোনাগাছিতে গেলুম। বেলা তখন প্রায় তিনটা। প্রকাণ্ড বাড়ি, গেটের ফাঁক দিয়ে একটা বড় বাঁধান উঠোন দেখা যায়। উঠানের পরে দোতলার ঘর থেকে গানের ঝঙ্কার ভেসে আসছে। কাউকে দেখা যায় না। বন্ধ গেটের মধ্যে টুলের ওপর একজন দরওয়ান বসে আছে। ভেতরে যেতে চাইলে বললে, ‘হুকুম নেই বাবু। আপনি কাকে চান, কি দরকার এই শ্লেটে লিখে দিন।’ শ্লেটটাতে আমার নাম লিখে ক্ষীরোদবাবুর লেখা চিঠিখানা তার হাতে দিয়ে দিলুম। প্রায় পাঁচ মিনিট পরে এসে দরজা খুলে আমায় নিয়ে গেল…।
কার সঙ্গে কোথায় পৌঁছলেন, কী কথা হল তা-ও বিস্তৃত ভাবে শুনিয়েছেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী অবিনাশ ভট্টাচার্য।
…একজন সুরুচি সজ্জিতা, হাস্যমুখী শ্যামবর্ণা নারী, বয়স প্রায় তিরিশ, এগিয়ে এসে আমায় অভ্যর্থনা করে নিয়ে এসে বসালেন বাঁ-দিকের একটা খুব বড় ঘরে। ঘরের সাজসজ্জা, আসবাবপত্র দেখে আমার তো আক্কেল গুরুম। এত দামী জিনিস বোধহয় কোন ধনী লোকের বাড়িতে নেই। আমায় একটা উৎকৃষ্ট কৌচে বসিয়ে স্মিতহাস্যে বললেন, ‘ক্ষীরোদবাবুর চিঠিতে আপনার পরিচয় পেলুম। আপনাদের মতো ব্যক্তির পদধুলি পাবার যোগ্য আমরা নই। ‘যুগান্তর’ আমরা নিয়মিত পড়ি, ‘সন্ধ্যা’ ও পড়ি। দেশের কাজে আমরা যদি কিছু সাহায্য করতে পারি নিজেদের ধন্য বলে মনে করি। আপনাদের কাছে যাবার সাহস আমাদের হয় না। তাই যে কেউ ভদ্রলোক আসেন দেশের কাজ করছি বলে তাঁদের আমরা ফেরাই না। দেশের কাজের জন্য সত্যই তা ব্যয় হয় কি না নিশ্চয় করে আমরা বলতে পারি না। তবে এখন থেকে আর কাউকে দেবো না আমরা, যা তুলি সমস্তটাই আপনার হাতে দেবো।’’
অবিনাশ জিজ্ঞাসা করেন, প্রতিদিন কত টাকা ওঠে?
মহিলা জবাব দিলেন, ‘‘চারটি দলে বিভক্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রাস্তায়, গলিতে গলিতে এরা গান গায়। প্রতিদিন দশ থেকে কুড়ি টাকা পর্যন্ত প্রত্যেক দল পায়। চার দলে প্রায় ষাট টাকা আনে। খরচ খরচা বাদে পঞ্চাশ টাকা পাওয়া যায়’’
—‘‘খরচ খরচা কি?’’
—‘’যারা ঢোল বাজায় তাদের টাকা দিতে হয়।’
—‘‘তা হোলে সপ্তাহে অন্ততঃ তিনশ টাকা ওঠে।
—”না, সপ্তাহে চার দিন বেরোন হয়। তাতে সপ্তাহে দু’শ টাকা প্রায় পাওয়া যায়।’’
—’তা হ’লে মাসে প্রায় আটশ’ হয়। এখন টাকাটা পাবো কি করে?’’
— ‘আপনি আসবেন, আপনার হাতেই টাকা দেবো। প্রতি সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট দিনে আপনি এলেই টাকা পাবেন।
—“তাই হবে, একটা দিন ঠিক করে আপনাকে লিখে জানাব। আজ তবে উঠি।’
—‘‘জলসা শুনতে পাচ্ছেন তো, কোন পুরুষ মানুষকে ওখানে যেতে দেওয়া হয় না, বাজনাওয়ালারা ছাড়া। একবার চলুন না একটু দেখে আসবেন।’’
— ‘‘আমার জন্য নিয়ম ভঙ্গ করবেন?’’
—‘’না, তা নয়, মজলিসে আপনাকে যেতে হবে না, পাশের ঘর থেকে সব দেখতে পাবেন।’’
—‘‘না, আজ থাক, এবার যে দিন আসবো দেখা যাবে।
অবিনাশ লিখছেন, তিনি উঠে দাঁড়াতেই মহিলা তাঁকে নমস্কার করেন ও গেট পর্যন্ত এসে ছেড়ে দিয়ে যান।
টাকার সন্ধানে সোনাগাছির পর চিৎপুরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন অবিনাশ।

ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ

‘‘এবার দ্বিতীয়ার সন্ধানে চিৎপুর রোডে বেরিয়ে পড়লুম। তাঁর সঙ্গে দেখা হ’ল, অনেক কথা হল। তাঁর একটি মেয়ে বি. এ. পাশ করেছে, ভিন্ন পরিচয়ে ভিন্ন স্থানে থেকে। তাঁর একটি ছেলে এনট্রান্স ক্লাশে পড়ছে, পরীক্ষা দেবে। সে এখানেই থাকে, তবে ভিন্ন বাসার ঠিকানা দেওয়া আছে স্কুলে। তিনি ব্রাহ্মণকন্যা, যৌবনে বুদ্ধির দোষে এই ঘৃণিত পথে এসে যে ভুল করেছেন, অনুতাপের আগুনে এখন পুড়ছেন। দেশের কাজে যতটা তিনি পারেন, টাকা দিয়ে সাহায্য করবেন।
তৃতীয়ার কাছে আর সেদিন যাওয়া হল না।’’
পতিতাদের তোলা টাকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করে আস্তানায় ফিরে এলেন অবিনাশ। কিন্তু তারপরেই শুরু হয়ে গেল বিতর্ক।
পতিতাদের টাকাকে দেশসেবার কাজে ব্যবহার করা নিয়ে মতভেদ দেখা দিল বিরাট ভাবে। অবিনাশ লিখেছেন,
…মনে আমার খুব আনন্দ হয়েছে, মাসে মাসে আটশ করে টাকা পাবো। অনেক রিভলবার, বন্দুক এবার কেনা যাবে। ক্ষীরোদবাবুকে সর্ব্বাগ্রে এই শুভ সংবাদ দিয়ে বাসায় ফিরলুম, রাত তখন আটটা। বারীন তখন মফঃস্বলে, অরবিন্দবাবুও এখানে নেই, তাই পরের দিন অশ্বিনীবাবু (বরিশালের অশ্বিনীকুমার দত্ত) ও পি. মিত্র মশাইকে (প্রমথনাথ মিত্র, অনুশীলন সমিতির পরিচালক) এই শুভ খবরটা দেবো মনে করলুম।
প্রায় সন্ধ্যার সময় পি. মিত্র এবং অশ্বিনীবাবুকে এই শুভ সংবাদ দেবার জন্য পি. মিত্র মহাশয়ের লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হলুম। এই খবর শুনে ও আমার আনন্দের আতিশয্য দেখে অশ্বিনীবাবু বললেন, ‘অবিনাশ, এ টাকা নেওয়া হবে না।’ শুনে যেন আমার মাথায় বজ্রাঘাত হোল।
অশ্বিনীবাবু বলতে লাগলেন—‘মাতৃ-সেবার পবিত্র কাজে ও টাকা নেওয়া যেতে পারে না।’
পি. মিত্র মশাই বললেন, ‘ও তো ওদের টাকা নয়, দেশের লোকেরই টাকা, ওরা এনে দিচ্ছে মাত্র, তা নিতে দোষ কি?’
—’না, না, ও নেওয়া যেতে পারে না। ওদের দেহ বিক্রীর টাকা, সে-ও তো দেশের লোকেরই টাকা, ও সব নেওয়া হবে না।’
মিত্র মশাই বললেন, – ‘যদি তাই হয় তাতে ক্ষতি কি, ওরা কি মায়ের সন্তান নয়? মায়ের সেবার জন্য যদি দেয়, কেন নেবো না।’

অবিনাশ ভট্টাচার্য


—‘প্রশ্ন টাকার নয়, সংস্রবের এবং তার ফলের। দেহের কোন অঙ্গ যদি বিষাক্ত হয় সেটা বাদ না দিলে শেষ পর্যন্ত প্রাণহানিও ঘটতে পারে। সমাজদেহের বেলাও তাই। সংস্পর্শ দোষ জনিত দোষে, কত লোকই না দুঃখ পায়। দেহের ছোট্ট একটা বিষফোড়াকে উপেক্ষা করলে শেষপর্যন্ত হয়ত তা প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায়। অবিনাশ, তুমি আর কখনও ওদের কাছে যাবে না। আমার কয়েকটি সচ্চরিত্র ছাত্র এই রকম সংস্রবে পড়ে উৎসন্ন গিয়েছে। এ সব বিষয়ে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে।’
অবিনাশ লিখেছেন, ‘‘বিষণ্ণ মনে ফিরে এলুম। এই টাকা নিতে আর আমি যেতে পারলুম না।’’
(বানান অপরিবর্তিত)

(অলঙ্করণ -রাতুল চন্দ রায়)