পর্ব ১৫
মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।
রাজি নয় ইলিয়াস। রাজি নয় তার অন্য সাথীরাও। ৱ্যাবের আক্রমণে রাজু বাহিনীর অনেক সদস্যের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিল। ওরা আমাকে বিশ্বাস করলেও সরকারকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার উপরে রাজু বাহিনীর উপর ওই অতর্কিত আক্রমণের পরে আরও বেশ কিছু দস্যু মারা পড়েছিল ক্রসফায়ারে। সব মিলিয়ে বিষয়টি জটিল হয়ে পড়েছিল। সুন্দরবনের বেশিরভাগ জলদস্যু যেন সেই সময় ধরে নিয়েছিল সারা জীবন তাদের জলে থেকে দস্যুবৃত্তি করে যেতে হবে। অন্য কোনও সুযোগ যে থাকতে পারে, সেটা তারা বিশ্বাস করতে চাইছিল না। সুন্দরবনের জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ায় এই পর্যায়ে আমার কাজটা খুব জটিল হয়ে পড়েছিল। আমি কয়েকটা জিনিস ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম। এর মধ্যে একটি মূল বিষয় স্পষ্ট হচ্ছিল যে সুন্দরবনের জলের অধিকারের চাবি জলদস্যুদের হাতে নেই। ওই চাবি রয়েছে উপরে। চক্রের হাতে। তারা ওই চাবি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে সুন্দরবনকে।
বুঝতে পারলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও খবর করার সুযোগ আমার কাছে সেই সময় ছিল না। কারণ, অকাট্য তথ্য প্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যায় না। কিন্তু আমি সুন্দরবনের জায়গায় জায়গায় বেড়াতাম, শুনতাম এই চক্রের নানা কাহিনী। সেই রকম একটা ঘটনা আজ আপনাদের শোনাই।
দুবলার চরের একজন জেলে। নামটা অপ্রকাশিত থাক। তিনি নিজের মতো করে প্রায় পনেরো লক্ষ টাকা জোগাড় করে মাছ ধরতে গেলেন সুন্দরবনে। আগে সেই জেলে একজন মহাজনের হয়ে মাছ ধরতেন। “আমি আর দাদন নেবো না “— বলে তিনি ওই মহাজনের থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন সুন্দরবনে মাছ তুলতে। ওই মহাজন ছিলেন দুবলার একজন নামকরা সাহেব। যাই হোক, সেই জেলে সুন্দরবন থেকে প্রায় বারো চোদ্দ লক্ষ টাকার মাছ কিনলেন বা ধরলেন। একদম কাঁচা মাছ। এইবার ওই মাছ ট্রলারে প্যাক করে রওনা দিলেন খুলনার দিকে। তখন শীতকাল। দুবলার চর থেকে তিনি যখন রওনা দিয়েছিলেন সময় তখন সন্ধ্যা ছয়টা। রাত দশটা নাগাদ ভদ্রা নদী ও পশুর নদীর সংযোগের আশপাশে একটি ডাকাতদল ট্রলারটি আটকে দিল। শুধু আটকাল বললে ভুল হবে, ট্রলার শুদ্ধ মাছ কেড়ে নিল। অন্যসময় হয়তো ডাকাতদল ট্রলার ধরে মুক্তিপণ চায়। মুক্তিপণ পেলে ট্রলার ছেড়ে দেয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তা হয়নি। কারণ, ওই মহাজনরা খবর দিয়েছিলেন ডাকাতদলকে। জানিয়েছিলেন ঠিক কী করতে হবে। মাছ ছাড়া হবে না। পুরোটাই বাজেয়াপ্ত করেছিল দস্যুরা। মাছগুলো চলে গেলো। ধারদেনা করে গোছানো মূলধন হারিয়ে গেলো। ওই জেলে আজও সেই দুর্ঘটনা থেকে বেরোতে পারেননি। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি কাজ করেন ওই মহাজনদের কোনও এক আড়তে। মহাজন সাহেব কেন করলেন এই কাজ? কারণ একটাই— নিজেদের বিস্তৃত সাম্রাজ্যে আর কাউকে ঢুকতে না দেওয়া। একজন জেলে মাথা তুলে দাঁড়াক— সেটা সহ্য হয়নি মহাজনদের। তাই নিজেরাই খবর দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছিলেন জেলেটিকে। এই ঘটনা একবার নয়, ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে আমার কাছে।
একটা জিনিস জানবেন, সুন্দরবনের দস্যুদের কিন্তু একটা বিশেষত্ব আছে। এরা সবাই ওই সুন্দরবন এলাকার লোক। যাদের তারা ধরছে বা যাদের মাছ লুঠ করছে, সবাই তাদের পরিচিত। হয়তো পাশাপাশি গ্রামের অথবা তারা কখনও এক সঙ্গে মাছ ধরেছে অথবা একই সঙ্গে ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে, খেলা করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনও দেখেছি, যারা লুঠ করছে আর যাদের জিনিস লুঠ হচ্ছে— তারা আত্মীয়। ভেবে দেখুন তো এই কাজগুলি কোনও মানুষের পক্ষে করা কি এত সহজ ! নিজের লোকেদের অপহরণ করা বা তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া। আমি যেটা বলতে চাইছি, এই কাজগুলি বেশিরভাগ সময় তাদের করতে হয়। বাধ্য হয়ে করতে হয়। সুন্দরবনের জলদস্যুদের মূল টার্গেট কিন্তু সাগরের জেলে। কিন্তু তা-ও তারা এইসব কাজ করতো। বলা ভাল, মহাজন তাদের দিয়ে করাতো। প্রান্তিক জেলেরা যেন উঠে দাঁড়াতে না পারে, তাঁরা যাতে অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন না হতে পারে। এটাই ছিল মহাজনদের মূল উদ্দেশ্য। ব্যাপারটা হল, এই সুন্দরবনের যাবতীয় সম্পত্তি ভোগ মহাজনরাই করবে। তার জন্য তারা জলদস্যুবাহিনীকে উৎসাহিত করবে। যারা তাদের কথা শুনবে তাদের কাউকে নেতা বানাবে। আবার সেই বাহিনীর কেউ বেগরবাই করলে তাদের সরিয়ে দেবে। যেন তেন প্রকরেন সুন্দরবনের অধিকার শুধু নিজেদের হাতে রাখাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
এদিকে আমি তো দমবার পাত্র নই। দস্যুদের আত্মসমর্পণের ইচ্ছা নিয়ে আরেকটা খবর প্রচার করলাম। চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে। আমার সে সময়ের কর্মক্ষেত্র। গেলাম আবার সরকারের কাছে। সেই দফাতেও সরকার প্রস্তাবটা নাকচ করলো। কিছুটা হতাশা ঘিরে ধরলো আমাকে। একটু চুপ করে গেলাম আমি।
এমন অবস্থায় মধ্যেই খবর পেলাম ইলিয়াস আত্মগোপন করেছে। ও আর সুন্দরবনে নেই। ফের নেতৃত্বের ভার পড়লো নোয়া মিয়ার উপর। দুর্বল প্রকৃতির নোয়া মিয়ার সক্ষমতা ছিল না দস্যুদলকে নেতৃত্ব দেওয়ার। ফলে যা হবার তাই হল, ফের ভাঙন শুরু হল দস্যুদলে। সুন্দরবনে দস্যুদল পরিচালনা করা এতো সহজ কাজ নয়। এটা সবাই পারে না। কিন্তু যারা পারে তারাই হল জঙ্গলের রাজা।
দস্যু সর্দারদের নিয়ে কথা উঠলে বলতে হয়, অনেক আগে সুন্দরবনের দস্যুদলকে পুরোপুরি ডাঙা থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। কখনও খুলনা থেকে, কখনও সাতক্ষীরা থেকে, অথবা কখনও কিছু মাছ ব্যবসায়ী এই দস্যুদলগুলির মালিক ছিল বলা যায়। প্রথমদিকে তারাই নিজেদের বিশ্বস্ত লোকেদের লিডার বানিয়ে সুন্দরবন দখলের চেষ্টা করতো। কিন্তু সময় যত গেছে দস্যুদলের উপর উপরের লোকেদের প্রভাব কমেছে। জলদস্যু দলগুলির নেতারা ধীরে ধীরে অস্ত্র কিনে নিজেরাই দলের কর্তৃত্ব হাতে নিয়েছে। তবুও কিছু লোক ছিল দসুদলগুলি যাদের মেনে চলতো। তবে সুন্দরবনের ডাকাত হবার জন্য যোগ্যতা থাকার দরকার ছিল। হয়তো পুঁথিগত শিক্ষা নয়। কিন্তু লিডারশিপ কোয়ালিটির পুরোটাই দরকার ছিল এই দলগুলি চালানোর জন্য। এই প্রসঙ্গে একজন জলদস্যুর কাহিনী বলি। সুন্দরবনের এক দস্যু নেতা ছিলেন নূর হাবিব। তাকে অনেকে নুরাবি বলে ডাকতো। বয়স্ক মানুষ। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যিকরের নেতা। উনি সবসময় দস্যুবৃত্তি করতেন না। একটি মরসুম ধরে তিনি দস্যুবৃত্তি করতেন। এমনি সময়ে তিনি দেশের অন্য কোথাও গিয়ে গা ডাকা দিয়ে থাকতেন। তারপর সুন্দরবনে যখন মাছের, মধুর বা গোলপাতার মরসুম শুরু হতো সেই সময় তিনি দস্যুবৃত্তি শুরু করতেন। আমার দেখা সুন্দরবনের দুই ডাকসাইটে দস্যুনেতা রাজু আর জুলফিকার। এই দুই দস্যুনেতার ওস্তাদ কিন্তু ছিলেন এই নূর হাবিব। এই দু’জনেই একই সময়ে নূর হাবিবের দলে দস্যুতা শুরু করেছিল। আর এই দু’জনের মধ্যে বনিবনা একদম ছিল না। নূর হাবিব ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান। উনি বুঝতে পেরেছিলেন এরা ভবিষ্যতে নেতৃত্বের পথের কাঁটা হয়ে উঠতে পারে। তখন তিনি দু’জনকে দু’টি দু’টি করে অস্ত্র দিয়ে আলাদা করে দিয়েছিলেন। পশুর নদীর পূর্বদিক তিনি দিয়েছিলেন জুলফিকারকে আর পশুর নদীর পশ্চিমদিকে দিয়েছিলেন রাজুকে। এই ভাবে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দু’টি জলদস্যু দলের জন্ম হয়েছিল। যাই হোক, নূর হাবিব ছিলেন অত্যন্ত সৌখিন মানুষ। সাদা পাঞ্জাবি। আর সাদা লুঙ্গি। এই ছিল তার পোশাক। সুন্দরবনে দস্যুবৃত্তি করার সময়ও সেই পোশাক। ভাবুন একবার, একজন জলদস্যু নেতা সাদা পাঞ্জাবি, সাদা লুঙ্গি আর মুখে পান দিয়ে যেতেন ডাকাতি করতে। কতটা করিশ্মা থাকলে সম্ভব হয়। তার নেতৃত্বের গুণের জন্যেই দস্যুদলের সকলে তাকে সম্মান করতো। তবুও নূর হাবিবের মৃত্যু হয়েছিল নিজের দলের লোকের হাতেই । তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলার জন্য গাছে উঠেছিলেন। সেই সময় দলেরই এক সদস্য তাকে গুলি করে মেরে ফেলে।
যাই হোক, ইলিয়াস চলে যাবার পরে নোয়া মিয়া চেয়েছিলেন দলটিকে সংগঠিত করতে। অনেক পুরনো দস্যুদের আবার তিনি দলে নিয়ে আসেন। এদের একজন মোস্তফা শেখ।
মোস্তফা শেখ! নামটা চেনা লাগছে? ঠিক ধরেছেন, উনি হলেন মাস্টার বাহিনীর মাস্টার। তার কথা বলবো পরের পর্বগুলিতে।
(ক্রমশ )