পর্ব ৩২

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

আপনি ভাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বরিশালে আসেন— আদনানের আমন্ত্রণ যেন আমার মনকে তখনই বরিশালে নিয়ে গেল। অপেক্ষা আর নয়। ভোর থাকতেই আমি রওনা দিলাম। খুলনা থেকে বরিশাল পৌঁছতে প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় লাগলো।  একবারে সোজা চলে গেলাম বরিশালের রূপাতলী, ৱ্যাব-৮ এর অফিসে। দেখা করলাম আদনানের সঙ্গে। আত্মসমর্পণ করার ইচ্ছার কথা জানিয়ে মাস্টার যে চিঠিটা আমাকে দিয়েছিল, সেই সমস্ত ডকুমেন্টস দেখালাম। তারপর আমরা দু’জনে বসলাম আত্মসমর্পণের পরিকল্পনা নিয়ে। শুরু হল আমাদের যৌথ কাজ। 

সেই সময় ৱ্যাব-৮ এর অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল ফরিদ।  উনি আমাদের বললেন, তোমরা তোমাদের কাজ এগিয়ে নিয়ে চলো।

মেজর আদনানের সাথে আমি আর পলিন

সুন্দরবনের জলদস্যুদের জীবনে ফেরার পুরো সফর অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে যদি মেজর আদনানের অবদানের কথা না বলি। আমি অনেক অফিসারের সঙ্গে আগে দেখা করেছি, কথা বলেছি। কিন্তু আদনানের মতো এতো ডেডিকেটেড কাউকে দেখিনি। সুন্দরবনের দস্যুদের নিয়ে ওর জ্ঞানের পরিধি আমাকে বিস্মিত করেছিল। তার সাথে কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম সে অনেক কিছু জানে। সত্যি বলতে কি, আদনান আমাকে একেবারে অবাক করে দিয়েছিল। আমি যে ডাকাতের প্রসঙ্গই তুলি বা তাদের কর্মপদ্ধতির কথা বলি— দেখলাম, আদনান সেই সব কিছু সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল।  সে সুন্দরবনের এই জলদস্যুদের নিয়ে অনেক কাজ করেছে। অনেক খোঁজখবর রেখেছে। একেবারে মাটির সাথে মিশে কাজ করেছে আদনান। আমি বুঝে গেলাম, আদনান তার কাজে নিজের একশ’ শতাংশ দিয়েছে। আমি জানতাম সে বেশ কিছু সফল অভিযান করেছে। সেই সময় সুন্দরবনে একটা বড় বাহিনী ছিল— শিষ্য বাহিনী। সেই বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি শেলার চর, নারকেলবেড়িয়া অঞ্চলে সফল অভিযান করেছিল আদনান। তার নিজের একটা টিম ছিল।  সেই টিম ঘুরে ঘুরে মাঠ ময়দান থেকে নানা খবর  সংগ্রহ করতো। আমি বুঝতে পারলাম, সুন্দরবনের বাস্তব চিত্র আদনানের কাছে পরিষ্কার। তার এই স্পষ্ট চিন্তা আমাকে সাহায্য করলো।  প্রথমদিনই আমাদের বন্ডিং হয়ে গেল। একেবারে দুয়ে দুয়ে চার। আমার ভিতরে আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। নাহ! এইবার কাজ হবে। শুরুতেই আমরা ঠিক করে নিলাম, কাজটা খুব গোপনে করবো। যাদের একান্তই না জানালে নয়, আমাদের কাজকর্মের কথা তারাই শুধু জানবে। বাকি কাউকেই কিছু জানানো যাবে না।

আদনানের সঙ্গে আমার পরিচয় সেদিন প্রথম নয়। কয়েক বছর আগে। আদনান আমার কয়েক বছরের জুনিয়র। আমি রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে পড়াশুনা করেছি আর আদনান করেছে বরিশাল ক্যাডেট কলেজে। দু’জনই ক্যাডেট কলেজের ছাত্র হওয়ায় আমাদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তবে আদনানের সঙ্গে আমার ভাল মতো পরিচয় হয়েছিল যখন সে ছিলো ক্যাপ্টেন, পোস্টেড ছিল বর্ডারগার্ড বাংলাদেশের মহাপরিচালকের এডিসি হিসেবে। তারপর মাঝে অনেকদিন কোনও যোগাযোগ ছিল না। দেখা হল বরিশালে। আদনান কবীর এখন লেফেটন্যান্ট কর্নেল। তখন অবশ্য ৱ্যাবের সদর দফতর ও খুলনা-বরিশাল পর্যায়ে আমার সম্পর্কে ধারণা ছিল যে আমি অপরাধীদের সহযোগিতা করছি, সুবিধা নিচ্ছি দস্যুদের কাছে থেকে। তাদের অনেকেই ভাবতেন, আমি জলদস্যুদের সঙ্গে মিশে রয়েছি। আদনানের সাথে মাটির যোগ থাকায় সে বুঝতে পেরেছিল আমার প্রকৃত অবস্থা। বিশ্বাস করেছিল আমাকে।   

এরপর মাস্টার ও সোহাগের সঙ্গে আমি মেজর আদনানের যোগাযোগ করিয়ে দিলাম। ঠিক হল, আমরা তিনপক্ষ কথা বলে সমস্ত পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাবো। মাস্টারকে আমি সতর্ক করলাম— বিষয়টি যেন একান্ত গোপন থাকে।

সেই সময়টা ছিল ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। তারপর কেটে গেল তিন মাস। মোটামুটি এপ্রিলে গিয়ে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা শেষ হল। এইবার আসছে বাস্তবায়নের পালা। এর মধ্যে আমি আর এক দফা মাস্টার বাহিনীর ডেরা থেকে ঘুরে এসেছি। মাস্টারকে আশ্বস্ত করলাম। পুরোটাই পরিকল্পনা মতো এগোচ্ছে। সরকার এখন এই আত্মসমর্পণের  বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। তোমরা এবার প্রস্তুত হতে শুরু করো। এর ঠিক একমাস পরে প্রথম আত্মসমর্পণ করে মাস্টার বাহিনী।

পুরো পরিকল্পনা করতে গিয়ে আমরা চুড়ান্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলাম। যেমন, বরিশাল ৱ্যাবের উপ-অধিনায়ক ও অধিনায়ক আর  ৱ্যাব হেড কোয়ার্টার্স-এ গোয়েন্দা প্রধান ও মহাপরিচালক ড. বেনজির আহমেদ ছাড়া কেউই বিষয়টা জানতো না। এমনকি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তখণও জানতেন না এবিষয়ে। সবকিছু চুড়ান্ত করে তবেই মন্ত্রীকে জানাবো বলে আমরা ঠিক করেছিলাম।

অন্যদিকে মাস্টার বাহিনীর মাস্টার ও সোহাগ ছাড়া যাতে আর কাউকে কিছু না বলে, তা নিয়েও সতর্ক করেছিলাম। অবশ্য এর মধ্যে তার দলের অনেকে দল ছেড়ে চলে গেছে। তারা কাউকে কাউকে বলেছিলো কী হতে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ তা বিশ্বাস করেনি।

৩১ মে ২০১৬। এল সেই মহেন্দ্রক্ষণ। মাস্টার বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র-সহ আত্মসমর্পণ করল ৱ্যাবের কাছে।

সেই ঘটনাও খুবই চমকপ্রদ।

এই আত্মসমর্পণে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা বোধহয় লেগেছিল ৱ্যাব-৬ এর ব্যাটালিয়নের ভিতরে। আফশোস করছিল তারা। ইস! এই কাজটা তো আমাদেরই করার কথা ছিল। কিন্তু কী করা যাবে! তারা নিজেরাই কাজটি করতে অসম্মত হয়েছিল। প্রথমে ঠিক হয়, ২৯ মে মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে ৱ্যাবের কাছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ৱ্যাবের মহাপরিচালক-সহ সরকারি সমস্ত স্তরে কথা বলেই ঠিক করা হয়েছিল দিনটি।  কিন্তু চরম বৈরী আবহাওয়ার কারণে দু’দিন পিছিয়ে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত দিন ঠিক করা হয় ৩১ মে।

আমরা নদীতে নাও ভাসালাম ২৭ মে। আমরা বলতে আমার টিম— আমি, পলিন, রাজীব ও বেলায়েত। রওনা হলাম গভীর বনে মাস্টার বাহিনীর উদ্দেশে। মাস্টার আগেই ঠিক করে দিয়েছিল কোথায় যেতে হবে আমাদের। তার কথা মতো আমরা প্রথমে গেলাম সুন্দরবনের পাশাখালি ফরেস্ট অফিসে।

সবকিছু ঠিকঠাক করে সেভাবে আমরা ঢাকা থেকে রওনা দিলাম। ওদিকে বেলায়েত সরদারকে বলেছিলাম যে আসবো। ট্রলারে তেল তুলে তৈরি থাকবেন। কোথায় যাবো, কখন যাবো কিছুই বলিনি। কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আমার ফোন ট্র্যাক করছে কেউ না কেউ। মংলা পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হলো। আমার গাড়িতে যমুনা টিভির ব্রান্ডিং করা ছিলো। গোপালগঞ্জ পার করে সেই স্টিকারগুলো তুলে ফেরলাম। মংলার বেশ আগে একটি জায়গায় গাড়ি থেকে নেমেছিলাম। পথে আত্মসমর্পণ করবে এমন আরও দুজন দস্যুকে লোকালয় থেকে নিয়েছিলাম। মংলার হোটেল পশুর-এ উঠেছিলাম সেই সন্ধ্যায়। বের হইনি। যাতে কেউ জানতে না পারে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে।

সুমন ও সোলাইমান। এরা দু’জন সারেন্ডারের আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলো। রাতে ট্রলারে একসঙ্গে যাবো। তারা দুইজনই চিহ্নিত বনদস্যু। ধরা পড়লেই ক্রস ফায়ার। তাই তাদের নিরাপত্তা নিয়েও বেশ সতর্ক ছিলাম আমি। গভীর রাতে রওনা হবো আমরা। পশুর ধরে এগিয়ে যাবো শেষ জোয়ারে। যাবো পাশাখালীতে, মাস্টারের ডেরায়, তাদের নিয়ে আসতে….

(ক্রমশ)

2 COMMENTS

  1. আস-ছালামুয়ালাইকুম
    লেখার পরিমাণটা যদি আর একটু বাড়ানো যেত তাহলে অনেক ভালো লাগতো। যদি সম্পূর্ণ লেখা পরতে ১ মিনিট সময় লাগে তাহলে তার সাথে আর ৩০ সেকেন্ড যোগ করা যাই কি না একটু ভেবে দেখুন। অপেক্ষাই থাকলাম। শুভ কামনা।

Comments are closed.