পর্ব ৩৮

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

জলদস্যু মাস্টারদের কাছে আমি গিয়েছিলাম ২৭ তারিখ। ২০১৬ সালের ২৭ মে। তারপর কেটে গেছে চার দিন তিন রাত। এই কয়েকটা দিনের প্রতিটি মুহূর্ত আমি কীভাবে কাটিয়েছি সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। এক রকম ঘোরের মধ্যে কেটেছে দিনগুলো। ২৭ তারিখ থেকে ৩১ তারিখ সকাল এই সময়ের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারিনি। শরীর বিদ্রোহ করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও জেগে ছিলাম। এই তিনরাত আমি আমার সহকর্মীদের পালা করে ঘুমানোর সুযোগ দিলেও নিজে এতটুকুও ঘুমাইনি। ৩১ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে মাস্টারদের আত্মসমর্পণের পরে তাদের নিয়ে পুলিশ ভ্যান রওনা দিলো মংলা থানার উদ্দেশে। যেহেতু তারা অবৈধ অস্ত্রগুলি জমা দিয়েছে, তাই তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা রুজু হল। ৩১ তারিখ পুরো দিনটাই ওরা ছিল মংলা থানায়। তার পরের দিন ওদের নিয়ে যাওয়া হল বাগেরহাট আদালতে, সেখানে থেকে বিচারক ওদের জেলে পাঠালেন। সবাই যখন ভাবছে, যাক একজন ভয়ঙ্কর দস্যু ধরা পড়েছে, কিছুটা হলেও স্বস্তি, তখন আমি ভাবছিলাম মাস্টারের কথা। আজ সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবে। জেলের কুঠুরিতে হলেও অনেকদিন পরে একটু ঘুমাতে পারবে।  আমি একদিন  মাস্টারকে বলেছিলাম—  কি হবে টাকাপয়সা দিয়ে, কি হবে ডাকাতি করে, দিনের শেষে যদি শান্তিতে ঘুমাতে না পারেন। একথা সত্যি সুন্দরবনের ডাকাতদলের সর্দাররা ঘুমায় না। ওরা প্রায় সব সময় জেগে থাকে। আতঙ্ক গ্রাস করে রাখে ওদের। সমস্ত দস্যুদের হাতে অস্ত্র। কার মনে কি আছে, কে জানে?  ঘুমালেই হয়তো কেউ গুলি চালিয়ে দেবে।

আর আমি… এই যে বললাম, তিনরাত চারদিন ঘুমাইনি। পুরো কাজটা শেষ হবার পরে আমার মনে হল, ঘুম সত্যি একটা প্রয়োজনীয় জিনিস। আমাকে এখন বিছানার কাছে আত্মসমর্পণ করতে হবে। আর পারা যাচ্ছে না।

তবে এই যে তিনরাত না ঘুমানোর কথা বললাম, সেই রকম অসংখ্য বিনিদ্র রজনী আমি কাটিয়েছি।

জঙ্গল জীবন নিয়ে অনেক গল্পেই লিখেছি, সুন্দরবনে দস্যুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের জন্য আমরা রাতে রাতেই চলাফেরা করেছি। নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে আর নির্ঝঞ্ঝাট চলাফেরার জন্য রাতই ভাল। বনদস্যু-জলদস্যুদের সঙ্গে দেখা করার দিনক্ষণ সাধারণত আমি নিজেই সরাসরি কথা বলে ঠিক করতাম। সেই মতো, সময় অনুযায়ী মংলা কিংবা সাতক্ষীরার মুন্সিগঞ্জ থেকে রাতের ভাটায় ট্রলার ভাসাতাম। চার ঘণ্টা থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা পর্যন্ত নদীপথ অতিক্রম করে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছতাম। কখনও সঙ্গে সঙ্গেই দেখা হতো দস্যুদের সঙ্গে। কখনও আবার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষাও করতে হতো। এসব ক্ষেত্রে সব সময়েই চোখ কান খোলা রাখতে হয়। রাতের বেলা হলে আলোর ইশারা কখন আসবে, সেই হিসেবে পাল্টা ইশারা করতে হতো সঙ্গে সঙ্গে। দিনের বেলা হলে দূর থেকে হাতের ইশারা বিনিময় করতাম আমরা। তারপর দস্যু দলের মুখোমুখি হতাম।

দস্যুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত নিজেকে দৃশ্যমান রাখতে হতো। ট্রলার চলা অবস্থায় গলুই-এ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ট্রলারের পাইলট বেলায়েত সরদার আর আমি, দুজনই মূলত পুরো সময় জেগে থাকতাম, শরীর ভেঙে ঘুম এলেও উপায় ছিল না। রাত জেগে লম্বা পথ পেরিয়ে জলদস্যুদের সঙ্গে দেখা হতো। তার পরও আমার ঘুমানোর উপায় থাকতো না নানা কারণে। আবার সবাই মিলে তো রাত দিন জেগে থাকার প্রয়োজনও নাই। তাই আমার সফর সঙ্গীরা রাত শেষে ঘুমাতে যেতেন। ট্রলারের ভিতরে সীমিত জায়গা। সেখানেই গাদাগাদি করে আমরা ঘুমাতাম, সেভাবেই অভ্যাস হয়ে গেছে আমাদের।  কয়েক রাত ঘুম ছাড়া কাটানো, আবার কোনও সফরে দস্যুদের সঙ্গে কাজ শেষে ট্রলারেই  দিয়েছি লম্বা ঘুম।

সহযাত্রীদের মধ্যে ঘুমানোর জায়গা দখল নিয়ে চলতো খুনসুটি। অবশ্য সব সময়েই পলিনের ঘুমানোর জায়গা বা সময় নিয়ে তেমন একটা সমস্যা হয় না। ট্রলারের ভিতরে, ছাদে, গলুইয়ে একটু জায়গা হলেই তার চলে। রোদ, বৃষ্টি বাদলও মানুষটার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না। ট্রলারে বা নৌকায় জায়গার সংকট হলে, পলিন আর আমি গলুইয়ে ছোট্ট জায়গায় ঘুমিয়েছি অনেক রাত। জায়গার অভাবে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমানোর সুযোগ হয়নি রাতের পর রাত…।

সুন্দরবনে গেলে আমার কিন্তু এমনিতেই ঘুম হতো না। দুই-তিন রাত আমি অক্লেশে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম। আগেই বলেছি, আমাদের সুন্দরবন যাত্রা হতো রাতে। আর আমি ওই রাতের সুন্দরবনকে একেবারে মিস করতে চাইতাম না। প্রতি মুহূর্তে প্রতিদিন সুন্দরবন নতুন নতুন রূপে ধরা দিতো আমার কাছে।  বেশির ভাগ সময়েই বেলায়েত সরদার আমার এই না ঘুমানোর সময়ের সঙ্গী হতো। বেলায়েত যদিও বা একটু ঘুমাতো আমি প্রায় ঘুমাতামই না।

একটু কল্পনার দেশে নিয়ে যাই আপনাদের। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রলার ভেসে চলেছে। পূর্ণিমার রাত। নদীর জোয়ারের সরসর শব্দ, সামনের বন আমার সামনে একটা কালো অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে। নদীর জলে চাঁদের রূপ আর একা আমি। সত্যি বলুন, ঘুমানো যায়? হয়তো দূরে ডেকে উঠছে বেঙ্গল টাইগার অথবা কোনও হরিণ। তবে পূর্ণিমা রাতের মায়াবী সৌন্দর্যের থেকে অমাবস্যায় সুন্দরবনের রহস্য আমাকে টানে বেশি। অন্ধকার।  দু-হাত দূরে কিছু দেখার উপায় নেই। শুধু জোনাকির আলো মিট মিট করছে। রাতের আকাশে মেঘের ফাঁকে তারার সাথে মিশে গেছে যেন সেই আলো। অদ্ভুত সুন্দর নিস্তব্ধতা। একটানা ঝিঝি পোকার ডাক, নদীর নিজস্ব শব্দ, বনের পশুর ডাক। সব মিলিয়ে আমাকে ভীষণ টানে সুন্দরবনের রাতগুলি। আমি ঘুমাতাম না। যদি কেউ পাশে না থাকতো, তবে ওই রাতে একটা ছিপ নিয়ে বসে যেতাম মাছ ধরতে।

আমার সুন্দরবনের যাত্রার আরও কিছু ঘটনা আছে, গল্প আছে। সেগুলি সামনের পর্বগুলিতে আপনাদের বলবো।

(ক্রমশ )

1 COMMENT

Comments are closed.