পর্ব ৪০

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশেরদেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

বরিশাল বিভাগের একটি জেলা পটুয়াখালী। পটুয়াখালীর উপজেলা রাঙ্গাবালী। সমুদ্রের তীরের এই উপজেলা সব দিক থেকে বিচ্ছিন্ন। নদী-চর আর ম্যানগ্রোভ বন নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উপজেলা।

রাঙ্গাবালীর সবচেয়ে দক্ষিণের জনপদ চরমনতাজ। সেখানকার বাসিন্দা খোকন মাঝি। নিজের ফিসিং ট্রলার আছে। সাগরে যায় মাছ ধরতে। কিন্তু শুধু মাছ ধরাতেই তার কাজ থেমে ছিল না। তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল সুন্দরবনের বনদস্যু ও জলদস্যুদের। নিবিড় যোগাযোগ। সুন্দরবনের বড় বড় জলদস্যু দলের নজর ছিল সাগরের জেলেদের দিকে। কারণ, তাদের ধরতে পারলে বা ফিসিং ট্রলারগুলো অপহরণ করতে পারলে একবারে অনেক বড় দাও মারা যায়।

সুন্দরবনের ডাকাতদের ট্রলারগুলি ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট আর খুব দ্রুতগামী। সেই ট্রলার নদীতে দারুন কাজ করতো। কিন্তু সাগরের দুরন্ত ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা সেই ট্রলারগুলির ছিল না। তাই সাগরের জেলেদের ধরার জন্য মানে অপহরণ করার জন্য বড় বড় ঢেউ কাটাতে পারে এমন ফিসিং ট্রলারের দরকার পড়তো। এই ট্রলার জলদস্যুদের যারা সরবরাহ করতো, তাদের একজন হল এই খোকন মাঝি। সে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী থেকে ট্রলার ছুটাতো সাগরের দিকে। সঙ্গে থাকতো জাল আর কয়েকজন জেলে। সাগরে উঠে পশ্চিমের পথ ধরতো ট্রলার। সোজা সুন্দরবনের গভীরের নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যেত রাত থাকতে থাকতে।  খোকন মাঝির আবার বঙ্গোপসাগর আর সুন্দরবনের নদীনালা, পথ ঘাট একেবারে মুখস্থ।

 যে কোনও সময় কীভাবে, কোথায় যেতে হবে সবটাই তার নখদর্পনে।

রওনা দেওয়ার সময় ট্রলারের রং থাকতো কালো অর্থাৎ আলকাতরা মারা। জলদস্যুদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পর খোকন মাঝি ও দস্যুরা মিলে পরিকল্পনা করতো কোন কাজটা কীভাবে হবে। তারপর কয়েকজন সশস্ত্র জলদস্যুকে নিয়ে খোকন মাঝি রওনা দিতো গভীর সমুদ্রে। এই খোকন মাঝি ছিল খেপারুদের মতো মানে ভাড়ায় খাটা মাঝি। তবে সে ভাগেও কাজ করতো।  যে জলদস্যু দল  টাকা দিতো, খোকন মাঝি তাদের নিয়েই চলে যেত সাগরে।  সাগরে গিয়ে ওই জলদস্যুরা বড় বড় ফিসিং ট্রলারগুলিকে আক্রমণ করতো, সেখানকার  মাঝিকে অপহরণ করতো, আবার কখনও পুরো ফিসিং ট্রলারটাকেই নিয়ে আসতো সুন্দরবনের খালের গভীরে, জলদস্যুদের ডেরায়।

অনেক পরিকল্পনা করে এই পুরো কাজটা তারা সংগঠিত করতো।

ধরুন, কোনও একবার খোকন মাঝির সঙ্গে চুক্তি হল জলদস্যু নেতা রাজুর। খোকন মাঝি রাজুকে নিয়ে যাবে সাগরে। সেই সময় খোকন মাঝি ও রাজু দুজনের মধ্যে একটাই ফোন নম্বর ব্যবহার করতো। খোকন মাঝি তার ট্রলার সুন্দরবনের গভীরে রাজুর ডেরায় এনে একটা জায়গায় ঢুকিয়ে দিতো। তারপর সেই ট্রলারের রঙ পাল্টে ফেলতো। এই ভাবে সমস্ত কাজ সম্পূর্ণ করে তারা রওনা দিতো সাগরের দিকে। তারপর সুযোগ বুঝে তারা ‘কোপ’ দিতো। ‘কোপ’ দেওয়া মানে সাগরের জেলে বা তাদের ট্রলারগুলি অপহরণ বা সমস্ত মাছ লুট করা। এমনও হয়েছে, রাজু বাহিনী একটানা ১২০-১২২টা ট্রলারে কোপ মেরেছে বা দস্যুতা করেছে।  একবার রাজু সাগরের প্রায় ২৬টি ট্রলার অপহরণ করে টেনে এনেছিলো সুন্দরবনের ভেতর। সাগর মানে বড় ব্যাপার। সাগরের জেলেদের মুক্তিপণ  জনপ্রতি তিন চার লক্ষ টাকা। আর একটি ট্রলার ছাড়াতে লাগতো প্রায় বিশ লক্ষ টাকা। কারণ,ওই ট্রলারগুলি বড়। এক একটার দাম দুই-তিন কোটি টাকা।

এই যে সাগরের বুকে দস্যুতা, এটা চলতো ডাঙার উপরে যে গডফাদাররা আছে, তাদের ইশারায় বা ছত্রছায়ায়। এমনকি,  কিছু ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল এই জেলেদের বা ট্রলার অপহরণের ক্ষেত্রে।

কারা সেই গডফাদার ? কিভাবে সংগঠিত হতো গোটা প্রক্রিয়া ?

মনে করুন, আজ দস্যুদল বের হলো। তারা সাগরে পৌঁছে এমন ভাবে ট্রলার চালাতো যেন সেটা একটা সাধারণ ফিসিং ট্রলার। জেলেদের ছদ্মবেশ নিতো। সাগরে একটা অলিখিত নিয়ম আছে, কোনও একটি ট্রলার বিপদে পড়লে অন্য ট্রলার তাদের দেখতে পেলে এগিয়ে আসে, সাহায্য করে। আর ঠিক সেই সুযোগ নিতো জেলের ছদ্মবেশে থাকা দস্যুরা। কোনও ট্রলার দেখলেই তারা সাহায্যের আবেদন করতো। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে অন্য কোনও ফিসিং ট্রলার কাছে আসলেই তাদের কোপ দিতো। প্রথমে তারা মূল মাঝিকে অপহরণ করতো। তারপর সেই ট্রলার মাঝ সমুদ্রে বিকল করে দিয়ে আসতো যাতে  সেটি তাদের পিছু নিতে না পারে বা অন্য কারও কাছে সাহায্যের জন্য যেতে না পারে। তবে দস্যুরা সেই ট্রলারকে ধরতো না যারা আগাম চাঁদা দিতো। এর জন্য ডাঙায় তাদের লোক থাকতো। সেই লোককে আগাম চাঁদা দিয়ে সাগরে যেতে হতো। কে চাঁদা দিয়েছে, সেটা জানার জন্য দস্যুরা অনেক উপায় বার করতো। এজন্য চাঁদা টোকেন থাকতো। সেটা যেমন খুশি উপায়ে হতে পারে। যেমন কখনও ভিজিটিং কার্ড ,কখনও কাগজে নিশানা দেওয় , কখনও একটা টাকা ছিঁড়ে তার দুই ভাগ দুজনের কাছে থাকতো।

তবে এই পদ্ধতিগুলির বেশিরভাগটাই প্ৰশাসনের লোকেরা জেনে  যাওয়ার ফলে তারা নোটের নম্বর আদানপ্রদান করে চাঁদার প্রমাণ রাখতো।  এই সব প্রমাণগুলির যে কোনও একটা দেখাতে পারলে দস্যুরা ট্রলার ছেড়ে দিতো।

চাঁদা নেওয়ার কর্মকাণ্ডের পুরোটাই হতো ডাঙার গডফাদারদের পরিচালনায়।  সুন্দরবনের গডফাদার বিশেষ কোনও একজন ছিল না। বরং বলা যায়, কিছু মানুষ তাদের কমন ইন্টারেস্টে এই কাজ পরিচালনা করতো। এর মধ্যে যেমন ছিল বড় বড় মাছ ব্যবসায়ী, তেমনি অস্ত্র পাচারকারী। প্রশাসনের কিছু কর্তা, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি কিছু সাংবাদিকের নামও ছিল সেই খাতায়। সুন্দরবনের জলদস্যুতার কারবারে এরা সবাই অংশীদার। সবার ভাগ ছিল আলাদা আলাদা। তাই কিছু লোক চায়নি সুন্দরবনের জলদস্যুরা আত্মসমর্পণ করুক। জলদস্যুরা খুব ভাল করে জানতো, কারা এইসব ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। তাই গডফাদারদের ভয় ছিল,  জলদস্যুরা যদি ৱ্যাবের জেরায় সবকিছু বলে দেয়, তবে তাদের বিপদ হতে পারে।

কিন্তু সত্যি কি তাই হয়েছিল? না হয়নি। তারা আজও আছে। সুন্দরবনের জলদস্যুদের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের পরেও এমন কোনও ঘটনা শুনিনি, যেখানে বলা হয়েছে, জলদস্যূদের সাহায্য করার জন্য কোনও গডফাদার ধরা পড়েছে। তাই এখনও আশঙ্কা হয়, হয়তো এরাই আবার কোনও দিন জলদস্যুদের বনে নামাবে আগের মতো করে। কাঁচা টাকার লোভ থেকে তারা এখনও বের হতে পারেনি।

(ক্রমশ)