পর্ব ৯
(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)
উত্তরায় আমার দুটি ফ্ল্যাট আছে!
নিজের গাড়িও আছে!
রাজুবাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ প্রচারের পর থেকেই এসব বলাবলি চলছিলো আমার নামে। বনদস্যুদের থেকে টাকাপয়সা নিয়ে আমি নাকি উত্তরায় ফ্ল্যাট কিনেছি..। নিজের গাড়িও আছে…মাঝেমধ্যে লং ড্রাইভে যাই। সব মিলিয়ে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের পর্বে আমি নাকি কয়েক কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছি। তাতে আমার পরিবার অনেক বছর নিশ্চিন্তে আরামে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।
কয়েকটি সংবাদপত্র ও মিডিয়ার কিছু লোকজনের মুখে মুখে আমার এই টাকা নেওয়ার হিসাব বেশ চলছিলো। তবে আমিও লিখে রেখেছি কিছু হিসাব। হয়তো তাতে একটু বেশিই লেখা রয়েছে। ডাকাতদের হিসাবের ডায়েরি রয়েছে আমার কাছে। হয়তো কোনওদিন প্রকাশিত হবে সেই সব। প্রকাশিত হবে কোন টাকা, কীভাবে, কার কাছে গেছে। কোন কর্মকর্তা, কোন সাংবাদিক অথবা কোন মাছ ব্যবসায়ীর কাছে।
আমার অদৃশ্য বাড়ি গাড়ি নিয়ে কাদা ছোড়ার ব্যাপারটা সময়ের সাথে সাথে মিটে গেছে। বাকি রয়েছে কাঁচা টাকার কলঙ্কের হিসাব। আমার টাকার হিসাবে পুরোটাই আমি দেব এই লেখাতে। আপাতত বলেছি, রাজুবাহিনী আমাকে দিয়েছিল দু’টি পাঁচশ টাকার বান্ডিল। তার থেকে আমি নিয়েছিলাম পাঁচ হাজার টাকা, যা পরে ফিরিয়ে দিয়েছি মজিবরকে।
থাক সে প্রসঙ্গ। আসি নিজের কথায়।
২০০০ সাল। বিজ্ঞানের ছাত্র মোহসীন-উল হাকিম আচমকাই ঢুকে পড়েছিল সাংবাদিকতার জগতে। সাংবাদিকতার কোনও ডিগ্রি নেই, অভিজ্ঞতাও নেই।
কাকে বলে রিপোর্টার, কাকে বলে জার্নালিস্ট— সাংবাদিকতার খুঁটিনাটি মাথায় ঢুকতো না। তবে এই জগতে ঢোকার শুরু থেকেই আমার উদ্দেশ্য ছিল একটাই— কিছু কাজ করা। সেটা কেবলমাত্র নিত্য আহার যোগানোর জন্য নয়, মানসিক সন্তুষ্টির জন্যও।
সাংবাদিকতার প্রথম জীবনে পেয়েছিলাম প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক প্রয়াত আহমেদ ফারুক হাসানকে। আমার ওস্তাদ, আমার সাংবাদিকতার গুরু। হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন আমাকে। তাঁর কাছেই আমার সাংবাদিকতার শিক্ষা। সেই সময় একটা চিন্তা আমার মনে আসতো। ভাবতাম, কী কাজ আমার? শুধু কি কোনও ঘটনাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা, নাকি তার কারণ অনুসন্ধান করা, কোনও সমাধানের রাস্তার কথা ভাবা। জলদস্যুদের খবর করার সময়ে এই দোলাচল আমার মধ্যেও ছিল। ভাবতাম, আমি কি শুধু জলদস্যুদের নিয়ে রিপোর্টিং করে ক্ষান্ত দেব, নাকি আরও এগিয়ে যাবো। উত্তর আমাকে দিয়েছিলেন এটিএন নিউজ-এর সেই সময়ের সিইও স্যার আশফাক মুনির, আমাদের সবার প্রিয় মিশুক মুনির। যে কথাগুলি স্যার শিখিয়েছিলেন, সেটাই ছিল আমার জীবনের পাথেয়। দিশা পেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকে। স্যার আমাকে বলেছিলেন— মোহসীন সবার আগে তুমি মানুষ, দেশের একজন নাগরিক। তারপরে যদি তোমার পরিচয় থাকে— সেটা হল, তুমি একজন সাংবাদিক। আমাদের নিজের দেশের কাছে, মানুষের প্রতি কিছু কর্তব্য আছে। সেই কর্তব্যকে অবহেলা করবে কী করে ? কোনো সমস্যা নেই মোহসীন। তুমি এগিয়ে যাও। ঠিক যে ভাবে কাজ করতে চাইছো, করো।
সেইদিন বোধহয় ঠিক হয়ে গিয়েছিল এই সাংবাদিকের ভাগ্য। তাই যে সব সমালোচনা এসেছিল, তার তেমন প্রভাব পড়েনি আমার উপর। প্রতিটি কাজের সমালোচনা হয়। আমার কাজেরও হয়েছে। এইসব সমালোচনার থেকেও সরকারি লোকেদের প্রতিক্রিয়ার দিকে আমার নজর ছিল বেশি।
তখন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন। সেই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী ছিলেন শামসুল হক টুকু। আমি তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। রাজুবাহিনী তাঁদের সাথে কথা বলতে চায়— সেই কথাও জানিয়েছিলাম। সে সময়কার বনমন্ত্রী ড: হাছান মাহমুদের সঙ্গেও কথা হয়েছিল। যেখানে যাঁকে পেয়েছি, বড় রাজনৈতিক নেতা বা আমলা— সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি আমি। আফসোস, কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি।
রাজুবাহিনীর আত্মসমর্পণের ইচ্ছা নিয়ে সাক্ষৎকারটি প্রচারের পরে পরেই একটি ঘটনা ঘটে। যে রাজুবাহিনী আত্মসমর্পণের জন্য আমাকে ইন্টারভিউ দিয়েছিল, তাদের আস্তানায় হল ৱ্যাবের একটি বড়সড় অভিযান।
সরকারি উদ্যোগে কিছুদিন আগে তৈরি হয়েছিল ‘বনদস্যু-জলদস্যু প্রতিরোধ টাস্কফোর্স’। ৱ্যাবের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে কোস্টগার্ড-পুলিশ সব মিলিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়। সরকারি এই উদ্যোগটি সেই সময় খুব সাড়া ফেলেছিল। পত্রপত্রিকায় লেখাও হয় প্রচুর। নিশ্চয়ই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি দেখে আমার কেমন একটু সংশয় লেগেছিল। এই টাস্কফোর্সের সঙ্গে বনবিভাগের কোনও সম্পর্ক নেই! বনবিভাগকে সঙ্গে না নিয়ে কোনও অভিযান চালানো সম্ভব? যে সুন্দরবনে আপনি অভিযান চালাবেন, সেই বনকে যাঁরা চেনেন— তাঁরাই নেই বাহিনীতে! এই অভিযান কী ভাবে সফল হবে?
সুন্দরবন এত সহজ জায়গা নয়। এক আশ্চর্য গোলকধাঁধা। এই বনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে আছে রহস্য। প্রতিটি দস্যু এই বনকে হাতের তালুর মতো চেনে। তাদের প্ৰতিদিনের যোগাযোগ এই জঙ্গলের সঙ্গে। আপনি যাঁদের ধরতে যাচ্ছেন, আক্রমণ করতে যাচ্ছেন, সে কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আপনাকে দেখতে পাচ্ছে, আপনার চলার শব্দ পাচ্ছে। কিন্তু আপনি তাকে দেখতে পাচ্ছেন না।
জলদস্যুদের সাথে বছরের পর বছর আলাপ করে বুঝেছি, এই বনদস্যুরা অনেক সময়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সহজেই গুলি করতে পারতো। কারণ, তারা গাছের আড়াল থেকে সব কিছু দেখতে পেত। আমার মনে হয়, এই ক্ষেত্রে জলদস্যুরা বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল। তারা কোনওদিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের আঘাত করার চেষ্টা করেনি।
আর একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেই নয়। অনেক পত্রপত্রিকায় দেখেছি, বনদস্যুরা নাকি জেলেদের মেরে ফেলেছে। আমার আড়াইশ’ বারের সুন্দরবন যাত্রায় এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখেনি বা শুনিনি। সুন্দরবনের বেশিরভাগ মৃত্যু গোষ্ঠী সংঘর্ষের জেরে। এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রুপের লড়াই। জলদস্যুরা বিশ্বাসঘাতককে শাস্তি দিতে তাকে গুলি করে মেরেছে বা নেতৃত্বের বিরাগভাজন হয়ে হত্যা অথবা নেতাকেই মেরে ফেলেছে বলে আমি খবর পেয়েছি। কিন্তু জেলেদের মেরে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে— এমন খবর আমার কাছে অন্তত নেই।
এই একটা কারণ আমাকে কিছুটা হলেও জলদস্যুদের প্রতি সংবেদনশীল করে তুলেছিল। আমি জলদস্যুদের মুখে প্রচুর কাহিনী শুনেছি, কেন তারা জলদস্যু হয়েছে? জেনেছি রাজনীতি, বঞ্চনা, অভাব— কীভাবে তাদের এই পেশায় আসতে বাধ্য করেছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে জেলেদেরও মৃত্যু হয়েছে , সেগুলির সিংহভাগ দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে মৃত্যু।
রাজুবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানটি হয়েছিল রাসমেলার পর পর। সুন্দরবনের নিশানখালী এলাকায় রাজুবাহিনী একটি সাময়িক ঘরবাড়ি তৈরি করে কিছুদিন ছিল। সেখানেই ৱ্যাব-কোস্টগার্ড অভিযানটি করেছিল। সাতক্ষীরার গাবুরার মান্নান-সহ তিনজন জলদস্যু ওই অভিযানে মারা যায়। একসময় মান্নান নিজেই একজন দস্যুনেতা ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি রাজু বাহিনীতে যোগ দেন। যাই হোক, অভিযানটি হয়। রাজুবাহিনী ছত্রখান হয়। কিন্তু বিষয়টি আমার মনে কিছু খটকা তৈরি করেছিল।
দস্যুদের সঙ্গে বনেবাদাড়ে ঘুরে আমার কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছিল, সুন্দরবনের ভিতরে কোনও দস্যুকে ধরা প্রায় অসম্ভব কাজ। কারণ, আমি যত ঘটনা দেখেছি, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে দস্যুদের ক্রসফায়ার করা হয়েছে তারা কেউ বনের ভিতরে ধরা পরেনি। যতটা আমি জেনেছি, মান্নান-সহ বাকি দু’জন আগেই ধরা পড়েছিল এবং তারাই রাজু বাহিনীর আস্তানার খোঁজ ৱ্যাবকে দিয়েছিল। সেই অভিযানটি হয়েছিলো সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায়। সেখানে রাজুসহ কয়েকজনের স্ত্রী-সন্তানরাও ছিলো। সব মিলিয়ে শতাধিক মানুষ সেখানে। অভিযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ না করে পিছিয়ে যায় দস্যুরা। আইন শৃংখলা বাহিনী তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিলো। ফাঁকা দিকটি দিয়ে দস্যুরা হাঁটা দেয়। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে তারা চলে যায় পাশাখালীর দিকে।
এই অভিযানের পর পরদিন সকালে রাজু অন্য একটি ফোন থেকে আমাকে ফোন করে।
-অনেক হয়েছে ভাই। আর না। আমরা আর আত্মসমর্পণের ব্যাপারে নেই।
(ক্রমশ)