৭৪ বছরের বৃদ্ধ টমাস কার্লোভিচ (Tomás Carlovich) আপন খেয়ালে সাইকেল চালিয়ে ফিরছেন নিজের ঘরে। সন্ধে হয়ে এসেছে। আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের এই জায়গাটায় অপরাধ একটু বেশি হয়। চার-চারটে সাইকেল চুরি হয়ে গিয়েছে এর আগে। প্রতিবারই ব্রুনো তাঁকে সাইকেল কিনে দিয়েছে। জীবন থেকে তেমন কিছু চাওয়ার নেই কার্লোভিচের। একটু মাছ ধরা আর শহরের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। একটা বদভ্যাসও অবশ্য আছে। এই রোজারিও শহর, নিজের বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে মন চায় না! না, আর কোনও চাহিদা নেই জীবন থেকে। নইলে …।
আচমকা কয়েকটা ছেলে এসে দাঁড়াল কার্লোভিচের সামনে। ঘিরে ধরলো তাঁকে। আবার এসেছে ওরা! না, এবার আর সাইকেল দেবো না। কতবার সাইকেল কিনে দেবে ছেলেটা! এই শহরেই তো জন্ম চে গুয়েভারার। বিপ্লবী হয়ে উঠল মনটা। আর নয়! আঁকড়ে ধরেন সাইকেলটাকে। ছেলেগুলির মধ্যে কেউ একজন একটা ইট দিয়ে বাড়ি মারল কার্লোভিচের মাথায়। সাইকেলটা ছেড়ে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ৭৪ বছরের বৃদ্ধ মানুষটি।
ওই ঘটনার দু’দিন পর, না ফেরার দেশে চলে গেলেন টমাস কার্লোভিচ। সকলের প্রিয় এল ট্রিঞ্চে। আর্জেন্টিনা জুড়ে পালিত হল শোক। দুনিয়া হারালো সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলারকে।
কী বলছেন! টমাস কার্লোভিচ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ফুটবলার! পাগল! নামই তো শোনেনি কেউ। না, অন্য কেউ নন। কার্লোভিচকে ‘বিশ্বের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবল খেলোয়াড়’ আখ্যা দিয়েছিলেন ফুটবলের রাজপুত্র মারাদোনা স্বয়ং। ইতালি, স্পেন ঘুরে ১৯৯৩ সালে মারাদোনা যখন ‘নেওয়েলস ওল্ড বয়েজ’ ক্লাবে যোগ দিয়েছেন, এক সাংবাদিক এয়ারপোর্টে ফুটবলের রাজপুত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ফুটবলার কি আবার আর্জেন্টিনায় ফিরছে? এতটুকু সময় নেননি মারাদোনা। জবাব দিয়েছিলেন, ‘‘দুনিয়ার সেরা ফুটবলার কোনওদিন রোজারিও ছেড়ে বেরোননি। তাঁর নাম, ট্রিঞ্চে কার্লোভিচ।’’
কার্লোভিচকে নিয়ে আর্জেন্টিনার ২০০৬ সালের জাতীয় দলের কোচ জোসে পেকারম্যান বলেছিলেন, ‘‘আমার দেখা সবচেয়ে আশ্চর্যজনক খেলোয়াড়।” ১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী দলের কোচ সিজার লুইস মেনোত্তি কী বলেছিলেন শুনুন। কার্লোভিচকে নিয়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘আমি ওঁকে জাতীয় দলে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু রাজি হল না। বলেছিল, মাছ ধরছি। তাই জাতীয় দলে খেলতে পারব না!’’
কী এমন ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন কার্লোভিচ— যাঁর খেলার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন মারাদোনা, পেকারম্যান কিংবা মেনোত্তি। না, আর একজনের নাম বাদ পড়ল। পেলে! কসমস ক্লাব একটি কন্ট্রাক্ট লেটার পাঠিয়েছিল কার্লোভিচকে। অনুরোধ এসেছিল পেলের থেকে। পেলে তখন আমেরিকার কসমস ক্লাবে খেলছেন। একবার যোগ দাও আমাদের টিমে। দুনিয়া দেখুক তোমার খেলা! না! কসমস পারেনি তাঁকে নিতে।
রোজারিও শহরের বিখ্যাত সন্তান লিওনেল মেসি, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, মার্সেলো বিয়েলসা
১৯৭৪ সাল। আর্জেন্টিনার জাতীয় দল অনুশীলন ম্যাচ খেলছে সে দেশেরই দ্বিতীয় বিভাগের একটি টিমের সঙ্গে। খেলার বিরতি হল। আর্জেন্টিনার কোচ ভলাদিসলাও ক্যাপ দ্বিতীয় বিভাগের দলটির কোচের কাছে গিয়ে বললেন, কার্লোভিচকে দ্বিতীয়ার্ধে নামানো যাবে না। কারণ, প্রচুর অসম্মান হয়েছে আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের। বিরতির আগের ফলাফল, রোজারিও ৩-জাতীয় দল ০। কার্লোভিচকে কিছুতেই আটকাতেই পারছেন না জাতীয় দলের ডিফেন্ডাররা।
১৯৭৯ সাল। বিখ্যাত এসি মিলান খেলতে এসেছে আর্জেন্টিনায়। জিয়ান্নি রিভেরা, ফ্যাবিও ক্যাপেলো, তরুণ ফ্রাঙ্কো বারেসিদের নিয়ে গড়া টিম। খেলবে স্থানীয় একটি ফুটবল দল আন্দেস ট্যাগলিরেসের বিরুদ্ধে। আন্দেস ট্যাগলিরেস কয়েকজন খেলোয়াড়কে অন্য দল থেকে নিয়ে এসেছিল। তাঁদের মধ্যে কার্লোভিচ একজন। ফলাফল ২-০। জগৎবিখ্যাত এসি মিলানকে হারিয়ে দিয়েছে অখ্যাত টিম আন্দেস ট্যাগলিরেস। সে দিনের ম্যাচের কান্ডারী সেই কার্লোভিচ।
তারপর গোটা ইউরোপের নামীদামী প্রায় সব ক্লাব থেকেই খেলার অনুরোধ এসেছিল কার্লোভিচের কাছে। কিন্তু যে লোকটি মাছ ধরবে বলে নিজেদের জাতীয় টিমে খেলতে যেতে চায় না, সে যাবে অন্য কোথাও!
…আমি আমার পাড়া, বাবা-মায়ের বাড়ি, প্রিয় পানশালা আর বন্ধু এল ভাস্কো আর্টোলার থেকে দূরে থাকা পছন্দ করি না—ফুটবল খেলি আনন্দ পাওয়ার জন্য। সেখানে তৃতীয় ডিভিশনে খেলাও যা জাতীয় দলে খেলাও তাই। জীবনে আনন্দে থাকাই বড় কথা— ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কার্লোভিচ।
খ্যাতি-অখ্যাতি, অন্তহীন প্রতিযোগিতা, আরও বেশি স্বাচ্ছন্দে থাকা— সবটাই ক্লিশে হয়ে যায় এই সব মানুষের কাছে। কার্লোভিচ শুধু কোনও ফুটবলার নন। একজন দিকদর্শক। কার্লোভিচ একটা উদাহরণ। এক অন্য জীবন দর্শন।