সৈয়দ রেজাউল করিম

সুচরিতাদির মলিন মুখে হাসি ফোটাতে হবে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলাম না।
টের পেলাম সকাল আটটায়। সুচরিতাদির ডাকে। তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম। মুখ ধুয়ে, স্নানটান করে, জামাকাপড় পরে নিলাম। সাধনবাবুর বাড়ি থেকে সকালের জলখাবার দিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো দু’জনে খেয়ে নিলাম। সুচরিতাদি বলল— থানায় যাবি?
আমি বললাম— যাব তো। তুমি রেডি হয়ে নাও।
সুচরিতাদি চোখ কপালে তুলে বলল— আমাকে আবার যেতে হবে!
আমি রাগত স্বরে বললাম— যেতে হবে মানে? তোমার কাছে এসেছি, তুমি ছাড়া আমার সঙ্গ দেবে কে?
সুচরিতাদি বলল– রাগ করছিস কেন?
বললাম— আমি কোথায় রাগারাগি করলাম?
সুচরিতাদি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল— আমাকে ওসব শেখাতে আসিস না। আমি যেন কচি খুকি, কিছু বুঝি না।
আমি বললাম— ঘাট হয়েছে সুচরিতাদি! আমাকে মাফ করে দাও।

সুচরিতাদি বিনা বাক্যব্যায়ে কাপড় চেঞ্জ করে এলো। ঘরে তালা দিয়ে দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বালুরঘাট থানাতে। আইসি সাহেবের ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম। অপরিচিত লোকজন দেখে সেন্ট্রি কনস্টেবল আটকে দিল। হোমগার্ড রাজা সামন্ত, মিনির স্বামী সেখানে দাঁড়িয়েছিল। আমাকে আর তার শাশুড়িমাকে দেখে সেন্ট্রিকনস্টেবলকে ইঙ্গিত করে ছেড়ে দিতে বলল। আমরা দু’জনে ঢুকলাম আইসি ডি কে সারকির চেম্বারে। সারকি আদর করে আমাদের বসতে দিল। কি খাব না খাব জিজ্ঞেস করল। সুচরিতাদি বলল— কিচ্ছু খাব না আমরা। এইমাত্র খেয়ে আসছি।
সারকি তা শুনল না। এককাপ চা খেতে দোষ কি, বলে অনেককিছুই অর্ডার দিয়ে বসল। তারপর কথাপ্রসঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলল— স্যার! আপনার কাজটা করে দিয়েছি।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম— তার মানে? আমার আবার কি কাজ?
—গতকাল আপনি চকভৃগুর মধুমতী ম্যাডামের কথা বলছিলেন না স্যার! কাল সন্ধেয় আমি একজনকে খোঁজখবর নিতে পাঠিয়েছিলাম। সেখানে মধুমতী ম্যাডামের সাথে দেখা হয়েছিল পরেশবাবুর। উনি ওনার পিসিমার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে এসেছিলেন। তাঁকে সকালে থানায় আসার কথা বলে এসেছিলেন। দুই ভাইপোকে সাথে নিয়ে উনি থানায় এসেছেন। যা কিছু বলার আপনি ওদের বলে দিন স্যার!
মুধুমতীর কথা শুনে সুচরিতাদির টনক নড়ল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল— এতদিন পরে তোর নায়িকার সন্ধান পেলি তাহলে…। ওকে খুঁজে পেতে কতদিন আমি চকভৃগুতে গেছি তার ইয়ত্তা নেই। অবশেষে বিশ্বসুন্দরীর দর্শন পাবো তাহলে।

সুচরিতাদির খোঁচামারা কথায় হৃদয়বিদ্ধ হলেও প্রত্যুত্তর দেওয়া ঠিক হবে না ভেবে চুপ করে থাকলাম। ঠিক সেই সময়ে পাশের রুম থেকে দুই ভাইপো ও এক ভাইঝিকে সাথে নিয়ে সারকির চেম্বারে ঢুকল মধুমতী। তার লালিত্যহীন মলিন চেহারা, মাথায় ছোট ছোট করে ছাঁটা সাদাকালো চুল দেখে খুব একটা বিব্রতভাব ফুটে উঠল না সুচরিতাদির চোখে মুখে। ওরা চারজন আমাদের পাশের চেয়ারে এসে বসল। আমাদের দুজনকে চিনতে পারল না মধুমতী ও তার ভাইপো, ভাইঝিরা।
আমি মধুমতীর দিকে তাকিয়ে বললাম— আমাদের চিনতে পারছো?
মধুমতী বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর মাথা নেড়ে বলল—হ্যাঁ। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল আমাদের। বললাম— আর কখনও তুমি বাড়ি ছেড়ে মালদাতে গিয়ে থেকো না। এখানে তোমার পরিবার পরিজনেরা আছে। তাদের ছেড়ে ওখানে থাকা কি তোমাকে মানায়?

আমার কথা শুনে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মধুমতী। তাকে সান্ত্বনা দিতে সুচরিতাদি বলল—কাঁদার কিছু নেই মধুমতী! সংসারে এ সব হরহামেশা ঘটে থাকে। মান অভিমান, অনাদর অবজ্ঞা এসব কিছু পরোয়া করো না তুমি। দেখবে তোমাকে সবাই মেনে চলছে। আদর করছে।

মুধুমতীর ভাইঝি নন্দিতা বলল— পিসিকে আমরা কোনওদিনই ছাড়ব না। পিসি আমাকে ছোটবেলা থেকে মানুষ করেছে। অভিমান করে কিছু না বলে ভোরবেলায় মালদায় চলে গিয়েছিল পিসি।
এই সব নিয়ে অনেক কথাবার্তা হল। কথাবার্তা চলার সময় সুচরিতাদি বলল— তোমাদের মধুমতী পিসির নামে ক’বিঘে জলজমি আছে তা তোমরা জানো?
নন্দিতা বলল— কেন জানব না! পাঁচ বিঘে সম্পত্তি আছে পিসির নামে।
—ওই সম্পত্তি, মধুমতীর পিসি মধুমতীর নামে লিখে দিয়ে গেছেন। পিসি জমিটা পেয়েছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। বাবা পেয়েছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। অতএব বুঝতেই পারছো জমিজমা কেউ স্বর্গে নিয়ে যায় না। সম্পত্তি থেকে যায় বংশবংশানুক্রমে। তোমাদের পিসিও তার সম্পত্তি নিয়ে চলে যাবে না কোথাও। সম্পত্তি থেকে যাবে তোমাদের কাছে । তাহলে কেন তার সম্পত্তি কেড়ে নেবার জন্য তাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেবে? ওকে একটু শান্তিতে থাকতে দিও তোমরা। অন্যথা হলে আইসি সাহেব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কসুর করবেন না।
বক্তৃতা দিয়ে একটু থামল সুচরিতাদি। আমি তাকিয়ে দেখলাম মধুমতীর দিকে। পরাজিত সৈনিকের মতো যে বিষণ্ণতা বিরাজ করছিল তার চোখেমুখে,তা অনেকটা উধাও হয়ে গেল সুচরিতাদির কথা শুনে। আমার দিকে একবার তাকাল মধুমতী। সে দৃষ্টিতে ছিল না পুরনো প্রেমের কোনও ঝিলিক। বরং ঝরে পড়ছিল একরাশ কৃতজ্ঞতা। আমি চোখ নামিয়ে সুচরিতাদির সাথে গলা মিলিয়ে নন্দিতাদের বললাম— থানা প্রশাসনের ভয় না পেয়ে পিসিকে ভালোবেসো, ভালোবাসা ফিরে পাবে। ওর নিজের বলতে এখন তোমরাই। তোমরা যদি…।

কথাটা শেষ করতে পারলাম না। বেআক্কেলের মতো মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। আমার আর বলা হয়ে উঠল না— আমি যতবারই বালুরঘাটে আসব, ততবারই তোমাদের পিসির খোঁজখবর নিয়ে যাব। তা ছাড়া আইসি সাহেব তো এখান আছেন। উনি নজর রাখবেন।

তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফোনটা বার করে স্ক্রিনে চোখ রাখলাম। দেখতে পেলাম সাধনবাবুর নাম। নিশ্চয়ই কোনও জরুরি দরকারে ফোন করছেন ভেবে বাইরে এসে ফোনটা ধরলাম। সাধনবাবু বললেন— আপনারা স্যার কোথায়? যোগেশবাবু এসেছেন। আপনাদের খুঁজছেন।
আমি বললাম— থানায় এসেছি। এখনই আসছি।
যোগেশবাবুর কথা শুনে আমরা বিন্দুমাত্র বিলম্ব করলাম না। মধুমতীদের বিদায় দিয়ে সারকিকে বলে বেরিয়ে পড়লাম।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম সাধনবাবুর কোয়ার্টারে। যোগেশবাবু তখন সোফাতে বসে গভীর আমেজে চা-পান করছিলেন। আমরা নমস্কার জানালাম তাঁকে। তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন— তোমরা সবাই ভালো আছো তো?
মাথা নেড়ে বললাম— হ্যাঁ স্যার।
সুচরিতাদি বলল— চলুন স্যার! আমার কোয়ার্টারে। ওখানেই আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

(ক্রমশ)

অলংকরণ-রাতুল চন্দরায়