মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন। ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন। প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন।
সুন্দরবন— যেমন তার রূপ, তেমনই রহস্যে ঘেরা। বছরের পর বছর ধরে এই সুন্দরবন, তার ম্যানগ্রোভ অরণ্য অনেক বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে আসছে বাংলাদেশকে। সুন্দরবন পৃথিবীর সুন্দরতম বাঘ বেঙ্গল টাইগারের বন। একটি World Heritage site, আমাদের সম্পদ।
I slept here a night of chaotic dreams,
I could not keep my dreams inside the rest-house,
They spread out through the forest,
Real tigers trod on them.
In the morning the sea
Was a bed of pink rose petals
Where somebody very beautiful had slept
A perfect sleep.
-Ted Hughes
১৯৮৯ সালে, বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে আমাদের দেশে এসেছিলেন ব্রিটিশ কবি টেড হিউস। রূপসা নদীতে নৌকাবিহার করার সময় কাছ থেকে সুন্দরবনকে দেখে তিনি লিখেছিলেন কবিতাটি।
…এই আমাদের সুন্দরবন। অপূর্ব, সুন্দর। আর এখানকার জল-মাটি-জঙ্গলের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে বেঁচে আছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এই অঞ্চল। আর এখানেই আছেন একেবারে দরিদ্র অসহায় বহু মানুষ— যাঁরা বনে যান, মাছ শিকার করেন, কাঁকড়া ধরেন, মধু সংগ্রহ করেন। ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আরও কিছু মানুষ। তারা ভয়ঙ্কর। হয়তো সবটাই ক্ষুধার টানে, একটু ভাল থাকার ইচ্ছায়। এরা জলদস্যু। এছাড়াও আছে আরও কিছু লোক। সুন্দরবনের ভাগ্যবিধাতা। যারা সুন্দরবনের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন জলদস্যুদের। তারাই ভয়ঙ্কর জলদস্যুদের মদতদাতা। তারা সুন্দরবনের মহাজন। কিন্তু এতো চলতে পারে না। কয়েকটা লোক আর তাদের তৈরি কয়েকশো জলদস্যু তো নির্ধারণ করতে পারে না সুন্দরবনের বাকি লোকেদের ভাগ্য…।
ফিরে আসি আমার সুন্দরবনের মূল কাহিনীতে।
ফোনে মোতালেবের সাথে কথা বলে বোঝা গেল না, লোকটির নেটওয়ার্ক কত বড়। তবে লোকমুখে শুনলাম, মোতালেবের বাহিনী পশ্চিম সুন্দরবন এলাকার শেষ কথা। এই অঞ্চলে কিছু ছোট ছোট জলদস্যু বাহিনী আছে, যেমন আলিফ ,আলম, মান্নান আরও কয়েকজন। ছোট ছোট দল বানিয়ে তারা নিজের এলাকায় দস্যুবৃত্তি করে। কিন্তু এঁদের সবাই মেনে চলে মোতালেবকে। তাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া করেই কাজ করে।
সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করে তিনটি বাহিনী— মোতালেব ,রাজু আর জুলফিকার। মোতালেব সাতক্ষীরা অঞ্চলে, রাজু খুলনা এলাকায় ও জুলফিকার বাগেরহাট অঞ্চলে। এছাড়াও আছে জলদস্যুদের পনেরো কুড়িটা মাঝারি ও ছোট দল।
বার বার কথা বলেছি মোতালেবের সঙ্গে। বার বার বুঝিয়েছি, “ফিরে আসুন সাধারণ জীবনে”। মোতালেব শুনেছেন, ভেবেছেন, আবার পিছিয়ে গেছেন। বলেছেন, ‘‘না, ফেরার পথ নেই। একবার হাতে পেলে মেরে ফেলবে আমাদের। ক্রসফায়ারে মেরে ফেলবে।’’ কিন্তু মন থেকে চেয়েছেন সাধারণ জীবনে ফিরে আসতে। বাধা সেই ক্রসফায়ার।
আমি কিন্তু হাল ছাড়িনি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি, মোতালেব যেন তাঁর পুরো বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। বুঝতে পারছিলাম, এই মানুষগুলির মধ্যে অনেকেই চান না জলদস্যুর জীবন। কিন্তু একটা উদাহরণ দরকার। একবার যদি মোতালেব আত্মসমর্পণ করেন…!
তারপর একদিন ছুটে গেলাম মোতালেবের বাড়ি। মোল্লার মিঠাখালীতে তাঁর একটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘর। ঘরে বসে আছেন মোতালেবের মা। গিয়ে বসলাম তাঁর পাশে।
“আমি ডাকাতের মা। সবাই আমাকে ডাকাতের মা বলে ডাকে। আমার ডাকাত ছেলেটা মরেছে। এখন আর আমার কোনও চিন্তা নেই। এখন আর কেউ আমাকে বলবে না — ডাকাতের মা ।”
মোতালেবকে দাফন করা হয়েছে ওই কুঁড়েঘরের পাশে একটি ছোট জায়গায়। ক্রসফায়ারেই মৃত্যু হয়েছে মোতালেবের। লোকটি কিন্তু আত্মসমর্পণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওঁর আশঙ্কাটাই সত্যি হল। দিনের পর দিন কথা বলেছি মোতালেবের সঙ্গে। চেষ্টা করেছি, ওঁদের আত্মসমর্পণ করানোর। যেদিন আমার সুন্দরবনের গহীনে দেখা করতে যাবার কথা, তার আগের দিন ক্রসফায়ারে মোতালেবের জীবন শেষ হয়।
মোতালেব কিন্তু সুন্দরবনের জঙ্গলে মারা যাননি। তাঁকে ধরা হয়েছিল লোকালয় থেকে। যতদূর জানি, তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী। ওই স্ত্রীর সাথে দেখা করতে লোকালয়ে এসেছিলেন মোতালেব। আমাকে কথা দিয়েছিলেন, নির্দিষ্ট সময়ে দেখা হবে। কিন্তু এই জলদস্যুদের যাঁরা স্পনসর করেন, যাঁরা এঁদের গডফাদার, তাঁরা ভাল ভাবে নেননি বিষয়টা। তাই যশোরের একটি হোটেল থেকে ধরিয়ে দেওয়া হয় মোতালেবকে। শুনেছি গডফাদারের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন মোতালেবের দ্বিতীয় স্ত্রী।
মোতালেবের বাড়ি গিয়ে আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। এত বড় দস্যু সর্দারের এ কি ঘরের হাল! কোথায় গেল তাঁর কাড়ি কাড়ি টাকা।
খোঁজ পেয়েছিলাম। সে কাহিনি পরে একদিন বলা যাবে।
সুন্দরবনের ডাকাতের আত্মসমর্পণের পরে দেখেছি, অনেকের স্ত্রী-রা খুশি নন। কারণ, যে টাকা ডাকাতেরা সংগ্রহ করেন, আত্মসমর্পণের পরে সেই টাকার আর যোগান নেই। ফলে বাড়িতে অভাব। এটাই মেনে নিতে পারেন না স্ত্রী-রা। কিন্তু অনেক মায়ের আশীর্বাদ পেয়েছি আমি, তাঁরা আমাকে স্নেহ করতেন। বাড়ি গেলে খুশি হতেন।
যাই হোক, মোতালেব মারা যাওয়ার পরে মনে হয়েছিল, আমার এতদিনের চেষ্টা হয়তো মাঠে মারা গেল। আবার নতুন উদ্যমে শুরু করতে হবে।
মোতালেবের কবর দেখে ফিরে আসার পথে বেজে উঠল আমার ফোন। একটা অচেনা নম্বর। পরিচয় দিলেন, আল আমিন। মোতালেবের বাহিনীর বর্তমান প্রধান। আলাপ করতে চান আমার সঙ্গে।
(ক্রমশ)