সুন্দরবন শব্দটা শুনলেই মনে আসে জল-জঙ্গল অধ্যুষিত আঠারো ভাটির দেশের কথা, যার জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘ। কিন্তু সত্যিই কি সুন্দরবন মানেই বাদাবন আর বাঘের সাম্রাজ্য? না। এর বাইরেও একটা সুন্দরবন রয়েছে যার ভৌগোলিক সীমানা উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ১৯টি ব্লক জুড়ে। যেখানে বাস করেন প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ। সুন্দরবনের ভূগোল, ইতিহাস, জীববৈচিত্র্য থেকে শুরু করে জনজীবনকে উপজীব্য করে ২০১০ সালের অক্টোবর মাস থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ পত্রিকাটি। সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী, পেশায় ভূগোল শিক্ষক। আদ্যোপান্ত সুন্দরবন বিষয়ক পত্রিকা হলেও পত্রিকাটি প্রকাশিত হয় হুগলী জেলার গুড়াপ থেকে। শুধুমাত্র পত্রিকা প্রকাশ করাই নয় বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে সুন্দরবনের অন্তত কিছু মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হয়ে উঠেছে এই পত্রিকাটি। পত্রিকার ব্যয়বহির্ভূত অর্থ খরচ হয় সুন্দরবনের উন্নয়নে। অবশ্যই সরকারি বা বহুজাতিক বেসরকারি সংস্থার মতো বিরাট আকারের উদ্যোগ নেওয়া মফস্বলের এই লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও ছোট ছোট উদ্যোগ নিয়ে কিছু মানুষের স্বপ্ন সত্যি করাই ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’র লক্ষ্য। এ বিষয়ে সহযোগী হিসেবে রয়েছে ‘তেপান্তরের স্বপ্ন’ সংস্থা। আর এরাই এখন নতুন স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে।
আইলা পরবর্তী সময়ে প্রান্ত সুন্দরবনের শান্তিগাছি হাই স্কুলের লাইব্রেরী পুনঃর্গঠন এর মাধ্যমে ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ ও ‘তেপান্তরের স্বপ্ন’র সুন্দরবনের কর্মকাণ্ড শুরু। এর পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে সুন্দরবন অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের সর্বাঙ্গীন বিকাশের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয় স্তরের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ছবি আঁকা, প্রবন্ধ রচনা, বিতর্ক, কুইজের মতো সহপাঠ্যক্রমিক বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন, অভাবী মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য মেধাবৃত্তি প্রদান, ছাত্রছাত্রীদের জন্য সুন্দরবন এবং কলকাতায় শিক্ষামূলক ভ্রমণের আয়োজন ইত্যাদি উদ্যোগ বিগত বছরগুলিতে গ্রহণ করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পাঠ্যবহির্ভূত বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করা, পরিবেশ সচেতনতা তৈরি করা, হাতে কলমে শিক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের নানান উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিধ্বস্ত সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের নতুন ভাবে জীবন সংগ্রামে ফিরে আসতে সাধ্যমত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হলেও এই উদ্যোগে আন্তরিকতার অভাব ছিল না কোন সময়েই। সুন্দরবনবাসীর স্বজন হিসাবে তাদের দুঃখের সমব্যথী হয়ে পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে কোন দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক নেই।
দীর্ঘমেয়াদী উদ্যোগ হিসাবে সংস্থা তরফে গোসাবা ব্লকের বালি দ্বীপের বিজয়নগরে ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা লাইব্রেরী’। স্থানীয় বিদ্যালয় বিজয়নগর আদর্শ বিদ্যামন্দিরের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক সুকুমার পয়রার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ওই অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে লাইব্রেরীটি ইতিমধ্যেই সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করেছে। পাথরপ্রতিমা ব্লকের প্রত্যন্ত দ্বীপ জি-প্লট। এখানকার বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা গ্রাম গোবর্ধনপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বিবেকানন্দ অঙ্কন শিক্ষাকেন্দ্র’। করোনার প্রকোপে স্বাভাবিক ভাবে এই উদ্যোগে সাময়িক ভাবে ছেদ পড়লেও জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসার সাথে সাথে এলাকার কচিকাঁচারাও আগের মতো মনের আনন্দে রঙ নিয়ে মেতে উঠেছে।
বিগত দশকে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘তেপান্তরের স্বপ্ন’ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তর থেকে মেঘনাদ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছে (২০১৫)। ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির তরফে পেয়েছে লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার (২০১৫)। এই বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বিশেষ ভাবে সম্মান জানিয়েছে পত্রিকাটিকে।
যে কোনও পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থমূল্য সুন্দরবনের ছাত্রছাত্রীদের জন্যই ব্যয় করাই দুই সংস্থার রীতি। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে পুরস্কার হিসাবে পাওয়া অর্থ দিয়ে গত ৬ অগস্ট বালির বিজয়নগর আদর্শ বিদ্যামন্দিরে একটি পরিবেশ বিষয়ক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এই দ্বীপের দুটি উচ্চমাধ্যমিক ও তিনটি মাধ্যমিক স্কুলের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শতাধিক ছাত্রছাত্রী এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নদী বিজ্ঞানী তথা বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সভাপতি কল্যাণ রুদ্র। তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল, ‘সুন্দরবনের নদী ও তার পরিবেশ’। বিশ্ব উষ্ণায়ন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট সুন্দরবন অঞ্চলের পরিবেশগত সমস্যা বিষয়ে তিনি আলোচনা করেন। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হুগলি মহসিন কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং ইউজিসি এমেরিটাস ফেলো ড. শুভ্র কুমার মুখোপাধ্যায়। তিনি ছাত্রছাত্রীদের বিজ্ঞান মনস্কতার পাঠ দেওয়ার পাশাপাশি হাতে কলমে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘কী দেখি? কেন দেখি?’। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক সুজিতকুমার মণ্ডল এবং শ্রীরামপুর কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শুভদীপ সরকারের বক্তব্যের বিষয় ছিল যথাক্রমে পাখি এবং সাপ। অধ্যাপক মণ্ডল ছাত্রছাত্রীদের সুন্দরবনের বিভিন্ন পাখির ছবি দেখিয়ে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের সহজ পাঠ দেন। সাপ বিষয়ে বিভিন্ন কুসংস্কার ও ভুল ধারণাগুলি খণ্ডন করে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে তোলেন শুভদীপবাবু।
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে বিজয়নগর বিবেকানন্দ ফার্মার্স ক্লাবে প্রতিষ্ঠিত ‘শুধু সুন্দরবন চর্চা লাইব্রেরী’তে শতাধিক বই প্রদান করা হয়। প্রসঙ্গত গত বছর থেকে প্রায় ৫০০ বইও পত্রপত্রিকা নিয়ে এই লাইব্রেরীটি পথচলা শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই লাইব্রেরী সদস্য সংখ্যা ৫০ পেরিয়েছে। এদের প্রত্যেকের হাতেও উপহার হিসেবে বই তুলে দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই আয়োজনের সহযোগী ছিল সুন্দরবন বিজয়নগর দিশা ও বিবেকানন্দ ফার্মার্স ক্লাব।
‘শুধু সুন্দরবন চর্চা’র সম্পাদক জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী বলেন, “আমাদের লক্ষ্য সুন্দরবনের কথা বৃহত্তর বাঙালি পাঠকদের সামনে তুলে ধরা”। আর ‘তেপান্তরের স্বপ্ন’ স্বপ্ন দেখে মাটিতে পা রেখে আকাশ ছোঁয়ার। প্রান্ত সুন্দরবনের তথাকথিত পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে এই দুই সংস্থা করছে।” তাঁর কথায়, “স্বীকৃতি, পুরস্কার বাদ দিয়ে আমাদের প্রাপ্তির ভাণ্ডার পূর্ণ হয় যখন দেখি, শান্তিগাছি হাই স্কুলের সেদিনকার ছোট ছাত্র তরণী গায়েন আজ বন দফতরের আধিকারিক হিসেবে চাকরি করছে। আলো-আঁধারিতে থাকা অনেকগুলো মানুষের স্বপ্নকে একটা রূপ দিতে পাশে থাকার চেষ্টা করছি আমরা। চাইছি তাঁদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার হতে। আমাদের পা রয়েছে সুন্দরবনের কাদামাটিতে। তবে স্বপ্ন আকাশ ছুঁতে পারে কিনা তা ভবিষ্যতই বলবে।”
চমৎকার প্রতিবেদন। সামান্য দিনাতিপাতের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা বর্জিত প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে যে নিরাময়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে, নিশ্চিত বিশ্বাস এর ফলাফল সুদূর প্রসারী। এই কর্মকাণ্ড আগামীদিনে মশাল হয়ে আরো লক্ষ সৎ সাধু উদ্যোগের মশাল জ্বালিয়ে তুলুক, আশায় ্থাকবো