(ড্রাগ চক্রের পিছনে ছুটে বেড়ানো সঞ্জয় গুপ্ত-র কাজ। মাদক চক্রের অপারেশন নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘একটি অসমাপ্ত কাহিনী’। প্রকাশিত হবে মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবারে।)
খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছে না অমিত।
শহরটা খুব বড় নয়। একদম চুপচাপ থাকলে অস্বস্তি বোধ হয়। টুকটাক কথা। অনেক মহানগরীর মতো এই শহর রাতে জেগে থাকে না। শহরের সীমানা থেকে একটু বাইরে একটা ধাবা আছে। আপাতত সেখানেই যাচ্ছে অমিত।
ধাবার মালিকটি, কর্মচারীরা চেনে অমিতকে। তাই, অবাক হলেও বুঝতে দিলো না। বরং কোণার দিকের একটা টেবিল যথাসাধ্য পরিষ্কার করে বসতে দিলো। রাতবিরেতে, এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার বাস, গাড়ি, ট্রাক থামে। লোকে এখানে এসে বসে। দরকার নেই, তবু অমিত রিভলবারটা বাইরে বের করে টেবিলে রাখলো। উৎপটাং লোক ভয়ে কাছে ঘেঁষবে না।
একটু যেন হাসলো মেয়েটি। তারপর বলল, “ভয় পেও না। বেশিক্ষণ থাকবো না। বাড়িতে তো নিয়ে গেলে না। গিন্নির ভয় আছে বুঝি? “
অমিত একবার মুখ তুলে তাকালো। ভাল করে দেখলো মুখটি। তারপর বললো, “না, বাড়িতে আসলে কেউ নেই।”
—মাসিমা, মেসো?
—নেই। মাসিমা নেই। মেসো অন্য শহরে থাকেন। এখানে আমি একলাই থাকি।
মুখে স্পষ্ট সমবেদনার ছবি। কিন্তু কিছুই বললো না। একটুখানি কথা খোঁজার চেষ্টা। কফি যথাসাধ্য বানিয়ে এনে দিয়েছে ছোকরাটি।
তাতে চুমুক দিয়ে, নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করলো রূপাঞ্জনা— তুমি একবারও আর আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলে না কেন? কত খুঁজেছি তোমাকে। সেই যে বাস স্টেশনে বিদায় নিলে, তারপর একবারও আমার কথা মনে পড়েনি?
—তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম তো। গেছিলাম।
—কবে … কবে…
—তুমি গ্র্যাজুয়েশন করতে গেলে। সেই যে পুরো মেয়েদের কলেজে। তখন গিয়েছিলাম। এক বন্ধুর সঙ্গে বাইকে করে। প্রায় একশো কিলোমিটার ।
—তারপর, দেখা করলে না কেন?
—হস্টেলে বললো, আত্মীয় না হলে দেখা করতে দেয় না। কলেজেও। একটা মেয়েকে রাস্তায় দেখে, বোন বলে ডেকে, খুব রিকোয়েস্ট করে একটা কাগজে লিখে পাঠিয়েছিলাম। মেয়েটা ফিরে এসে বললো, তুমি নাকি খুব রাগ করেছো। কাগজ না দেখেই ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছো।
দু’চোখে হতাশা আর অনেকখানি ব্যথা ভরে রূপাঞ্জনা দেখলো বক্তাকে। তারপর বললো, “নতুন পড়তে এসেছি। ছেলেরা বিরক্ত করতো। প্রেমপত্র পাঠাতো। না দেখেই ছিঁড়ে ফেলতাম। হয়তো এভাবেই… কিন্তু তুমি তো দাঁড়িয়ে থাকলে পারতে। রাস্তায় দেখে ডাক দিয়ে কথা…”
—আসলে বেশ কিছু বছর পর তোমার খবর পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম। ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছো। রাগ করেছো, জেনে আর সাহস হয়নি পথে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার। বাইক নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে ফেরত চলে গিয়েছিলাম।
কফি শেষ হয়ে এসেছে। শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালো রূপাঞ্জনা। তারপর বললো, ” এখন কিন্তু একটু সাহস হয়েছে। অজানা অচেনা মহিলাকে গাড়ি করে হোটেলে নামিয়ে দেওয়া, এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেওয়া আটকাচ্ছে না। “
রিভলবার গুছিয়ে, চোখের ইশারায় বিল দিতে বললো অমিত। এটা একটা অসুবিধা। দোকানগুলো নিতে চায় না। মিছিমিছি ভয় পায়।
ভয় পায় না একমাত্র আবহাওয়া। কথা নেই, বার্তা নেই হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি। বেশ জোরে। দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়ি অবধি পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ ভিজে গেল দু’জনেই।
গাড়িতে উঠে দু’বার সশব্দে হাঁচি। বললো, “এক্ষুনি হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অথচ ভিজে কাপড়ে থাকলে জ্বর নির্ঘাত। কি করা যায় অফিসার সাহেব? “
নিঃশব্দেই গাড়ি এগিয়ে নিলো অমিত। একসময় থামলো তার বাড়ির দোরগোড়ায়।
—এসো। এখানেই থাকি।
শুকনো তোয়ালেতে মুখ মোছা। খুব বেশি ভেজেনি সালোয়ার কামিজ। তাও সেটাকে ফ্যান চালিয়ে শুকোতে দিয়ে গ্যাস জ্বালালো রূপাঞ্জনা। এখন তার পরনে অমিতের ফুলস্লিভ ভারী শার্ট আর ট্র্যাকসুট। আদার টুকরো, সঙ্গে একটু কাঁচামরিচ দিয়ে তোফা লাল চা।
দেখছিল অমিত। ড্রেস পাল্টায়নি বলে, মেয়েটি একদম কুণ্ঠাহীন সুরে ধমকে অবধি দিলো অমিতকে।
চা খেতে খেতে, ঘুরে ঘুরে দেখছিল ঘরটা। খুব তৃষ্ণা ভরে। একবার জিজ্ঞেস করলো, ম্যাগি ছাড়া পৃথিবীতে আরও কিছু খাবারের নাম জানা আছে কি না?
পুরনো ছবি খুব বেশি নেই। তবু সেগুলোই ফিরে ফিরে দেখা। ওর মা, এখনো অমিতের কথা মনে রেখেছেন। এইসব কথা। তারপর হঠাৎ আবার কথা ফুরিয়ে যাওয়া। তখন আবার বাড়ির সবকিছু উল্টেপাল্টে , আলমারি খুলে দেখা।
এর ফাঁকে হঠাৎ অমিতের আলমারি খুলে দেখতে গিয়ে দেখতে পেল, সাদা রঙের শার্ট। পুরনো , ছোট সাইজের । তার মধ্যে নীল রঙের কালির দাগ লাগানো। এখন ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে।
শার্টটা হাতে নিয়ে, অমিতের দিকে তাকাতেই… দু’জনের চোখ মিললো। দু’জনেরই মনে পড়ছে ঘটনাটা। দোলের দিন। সত্যেন স্যারের কাছে ক্লাস ছিল। বাকি সবাই রং নিয়ে এসেছিল। পড়া শেষ করে বেরুতেই খেলা শুরু। স্বভাবলাজুক অমিত কাউকে রং দেয়নি। দেওয়ার সাহস জোগাড় করে উঠতে পারেনি। কিন্তু বাকিরা সবাই দিয়েছিল ওকে। সবচেয়ে বেশি রূপাঞ্জনা। শুধু রং দিয়েই শেষ করেনি, কলমের নীল কালি ছিটিয়ে দিয়েছিল শার্টে। এটাই সেই শার্ট। নীল রংটাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতো রূপাঞ্জনা। ওর প্রিয় রং নীল।
শার্টটা যথাস্থানে রেখে, একবার ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো, “এটা বোধহয় আর ধোয়া হয়নি কখনও? “
মাথা নাড়লো অমিত। হয়নি। সেদিনের পর থেকে, এই রকম ভাবেই রয়েছে। অন্য সব কিছুর দাগ চলে গেছে, হালকা স্মৃতি রেখে। কিন্তু নীল কালির রংটি বড্ড উজ্জ্বল।
রূপাঞ্জনা বললো, “আমি কিন্তু অনেক খুঁজেছি। কেউ বলতে পারে না। তারপর এলো ফেসবুক। সেখানেও রোজ খুঁজতাম। কিন্তু তুমি তো নেই। বনানীদি আমার ফেসবুক বন্ধু। ওর বোন আমার কলেজের বন্ধু। কয়েকদিন হলো, হঠাৎ বনানীদির একটা ছবি দেখলাম। সঙ্গে আমার এতদিন ধরে খোঁজা চেহারাটি।”
অমিতের মনে পড়লো, কিছুদিন আগেই সেই অনুষ্ঠানের কথা। হ্যাঁ, বনানীদির সঙ্গেও ছবি উঠেছিল বটে।
—এমনিতেও হয়তো আসতাম। কিন্তু সুযোগ হয়ে গেল। এসেই তোমার অফিসে গিয়েছিলাম। বললো, বাইরে গেছো। কবে ফিরবে ঠিক নেই। তাই ফেরার টিকিট কেটেছি। কিন্তু আবার আসতাম। বারবার আসতাম। বড্ড দরকার ছিল একবার তোমার সাথে দেখা হওয়ার।”
—কেন?
—সে তুমি বুঝবে না। খুব জরুরি ছিল একটা কথা জানা।
আবার বেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর রূপাঞ্জনা বললো, “বাবা হার্টের অসুখে আক্রান্ত। তোমার কোনও খবর নেই। জানো, বিয়ের পিঁড়িতে বসেও আমার চোখ শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছিল একজনকে। কিন্তু তার দেখা পাইনি।”
—ছিলাম তো আমিও সেই ভিড়ের মধ্যে। নীল রঙের বেনারসি শাড়িতে তোমাকে খুব মানিয়েছিলো।
—তুমি এসেছিলে?
— হ্যাঁ। খবর পেয়ে, অনাহুত অতিথি। দূর থেকে তোমাকে বধূবেশে দেখেছি। সাহস পাইনি অথবা ইচ্ছে হয়নি সামনে গিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে।
—কেন? কেন একবারও সামনে এলে না।
—তুমি তো জানো আমাকে। খবর রাখতাম তোমার। ভেবেছিলাম, পাশ টাশ করে নেই, একটা ভাল চাকরি জুটিয়ে নিয়ে, তারপর তোমাদের বাড়িতে যাবো। কিন্তু খুব দেরি হয়ে যাচ্ছিল। ইন্টারভিউ দিয়ে রেজাল্ট আর বেরোয় না। সেই ফাঁকে…. আমার সময় আর এলো না।
একটু থেমে, গলাটা পরিষ্কার করে নিলো অমিত। তারপর বললো, “তোমার স্বামী কিন্তু খুব সুন্দর। সিঙ্গাপুরে বাড়িটাও খুব সুন্দর। ফেসবুকে দেখেছি। তুমি খুব ভাল আছো রূপাঞ্জনা। ভালো থাকবে। আমাদের মতো অনেকের শুভকামনা, ভালবাসা তোমাকে সব সময় ঘিরে রাখবে।”
ড্রেস শুকিয়ে গেছে। সেগুলো ফের পরে হোটেলে আসা। হোটেল থেকে সুটকেস উঠিয়ে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে চারটে। প্লেন ছাড়তে দেরি আছে।
গাড়িটা পার্ক করে, ধীরে সুস্থে ট্রলিতে মাল উঠিয়ে প্রবেশ দরজার সামনে পৌঁছল দু’জনে।
একটুখানি সময় এখনও হাতে আছে। তিনটে করে কালো রঙের স্টিলের চেয়ার। তাতে, দু’টি নির্বাক মানুষ বসে রইলো বেশ কিছুক্ষণ।
একটু পরে পরেই মাইক্রোফোন ডাক দিচ্ছে। একসময় বলবে, এই শেষ বারের মতো ডাকছি কিন্তু। এর পর আর ডাকবো না।
দু’জনের মধ্যে একজন উঠে চলে যাবে ওই দরজা দিয়ে। একবার ঘুরে, দাঁড়িয়ে হাত নাড়বে। বুড়ো আঙুল উঠিয়ে , থামস আপ দেখাবে। তারপর একসময় তাকে আর দেখা যাবে না।
সে চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ ওই চেয়ারটিতে বসে থাকবে একজন। সে উঠবে, প্লেন আকাশে উড়ে চলে যাওয়ার পর। আস্তে আস্তে, পা টাকে টানতে টানতে বসবে গাড়িতে। স্টার্ট দেবে। সকাল দশটায় তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে।
ফিরে যাবে, যেতে হবে দু’জনকেই তাদের জীবনে… যতই অসম্পূর্ণ লাগুক না কেন সেই জীবন।
(ক্রমশ )