পর্ব ৩৯
মোহসীন উল হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশেরদেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।
বলছিলাম ঘুমের কথা। আমাদের মধ্যে একজন আছে যার ঘুমের কোনও সমস্যা হতো না। সে হল পলিন। যেখানে একটু জায়গা পেত গুটিশুটি মেরে সেখানেই শুয়ে পড়তে পারতো। এত লম্বা কিন্তু কিভাবে যে শরীরটাকে গুটিয়ে একটা ছোট জায়গায় ঘুমিয়ে পড়তে পারে সেটা ভাবতেই আমার অবাক লাগে। ঘুম নিয়ে পলিন আর রাজীবের মধ্যে আবার সারা সময় খুনসুঁটি লেগে থাকতো। আসলে পলিন অনেক রাত পর্যন্ত জাগতে পারলেও রাজীব রাত নামলেই ঘুমিয়ে পড়তো। আর রাজীব ঘুমালেই পলিন গিয়ে ওর পেছনে লেগে ঘুমের ডিস্টার্ব করতো। একই ভাবে পলিন গভীর রাতে ঘুমাতো বলে ওর সকালে উঠতে দেরি হতো আর ঠিক সেই সময় রাজীব গিয়ে ওর পেছনে লাগতো। খুব মজায় কাটতো সেই সময়গুলি।
তবে ঘুম নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় সুন্দরবনের জেলেদের কথা। একটা কথা মনে রাখবেন। সুন্দরবনের জেলেদের কিন্তু দিনরাত বলে কিছু নেই। তাই ঘুমের কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই ওদের। এই ধরুন রাত তিনটের সময় ওদের মনে হল- এটা মাছ ধরার উত্তম সময়, ওরা সেই সময় মাছ ধরা শুরু করবে। আসলে শহরে বসে বাড়িতে মাছের মুড়োটা খেতে ভাল লাগে কিন্তু তার পিছনে থাকে অমানুষিক পরিশ্রম। কৃষকের ঘাম দেখা যায়। জেলেদের ঘাম কিন্তু দেখা যায় না। সুন্দরবনের জেলেদের ঘাম মিশে যায় লবণ জলে।
যাই হোক, আবার ফিরে আসি সুন্দরবনের গল্পে। মাস্টারদের আত্মসমর্পণ সারা বাংলাদেশ জুড়ে আলোড়ন তুলে দিল। একদিকে প্রশাসন অন্যদিকে জলদস্যু দলগুলির সর্দারেরা লাগাতার আমাকে ফোন করছিল। আর এক শ্রেণির ফোন আমি পাচ্ছিলাম- তারা হল সুন্দরবনের জলদস্যুদের গডফাদারেরা। ওরা ভয় পেয়েছিল। এই যে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ, সেটা ওদের নাড়িয়ে দিয়েছিল। ওদের ভয় ছিল, জলদস্যুরা মুখ খুললে ওরা বিপদে না পড়ে যায়।
যেদিন মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, সেই দিন জাহাঙ্গীর বাহিনীর জাহাঙ্গীর , দস্যুনেতা নোয়া মিয়া-সহ আরও কয়েকজন ফোন করেছিল আমাকে। তাদের একটাই প্রশ্ন, যারা
আত্মসমর্পণ করেছে তাদের কি ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে নাকি এখনও তারা বেঁচে আছে? তাদের সন্দেহ ছিল, ৱ্যাব ধরা দেওয়া দস্যুদের বাঁচিয়ে রাখবে না।
এদিকে মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের সাফল্যের পর আমি ভাবতে শুরু করলাম তাহলে এখন আমার কি কাজ? অনেক বড় একটা কাজ তো হল। কিন্তু সুন্দরবনের আসল সমস্যার সমাধান হল কি? এখনও তো অনেক বাহিনী রয়েছে সুন্দরবনের ভেতরে। তারা যদি থেকে যায়, তবে তারাই একদিন মাস্টার বাহিনীর জায়গা ভরাট করে দেবে। মাস্টারদের আত্মসমর্পণ আমার মধ্যে এই উপলব্ধি নিয়ে আসলো। এখানেই শেষ নয়। মাস্টারের আত্মসমর্পণ শুধু দরজাটা খুলেছে। দস্যুরা বুঝতে পেরেছে আত্মসমর্পণ করলে তারা বেঁচে যেতে পারে। এইটুকু উপলব্ধি হয়তো আরও অনেক দস্যুকে আত্মসমর্পণের সাহস জোগাবে। মাস্টার এজন্য অবশ্য ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। সে পথটা দেখিয়েছে।
মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণে বিপাকে পড়েছিল খুলনার ৱ্যাব, কোস্টগার্ড, পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃস্থানীয়রা। তারা বুঝতে পারছিলেন এই কাজটা তাদের করার কথা ছিল। কিন্তু করেছে বরিশাল ৱ্যাব। আর তারাও আমাকে বলতে পারছিলেন না– ভাই আপনি কেন বরিশালে গেলেন? অথচ আমি অনেকবার তাদের কাছে গেছি আর প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। কাজেই আমাকে কিছু বলবে এমন পরিস্থিতিও ছিল না। এই কাজটা হয়ে যাবার পরেও ,তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে সুন্দরবনের দস্যুরা আত্মসমর্পণ করবে। তারা প্রথম থেকেই ভেবেছিল, মোহসীন উল হাকিম একজন প্রতারক। সে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে এই দস্যুগুলিকে বাঁচিয়ে দিবে। নিউজও হল, প্রতারণাও হল। মোহসীন উল হাকিম এবার বাড়ি ফিরে যাবে। আমাকে নিয়ে এমন অপপ্রচারে সরাসরি জড়িত ছিলেন কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা।
এদিনে দস্যুদলগুলো যখন দেখলো যে ক্রসফায়ারের মতো তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি , তখন পশ্চিমের (সাতক্ষীরা অঞ্চল) বড় দস্যু বাহিনীর প্রধান মজনু ফোন করলো আমাকে। বললো -ভাই আমি আত্মসমর্পণ করবো।
শুরু হল আমার নতুন করে পথ চলা।
(চলবে)
মোহসীন উল হাকিম স্যার মানুষ নামকে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করলেন। যে একজন মানুষ হিসেবে কি কি করা দরকার বা দায়িত্ব।🙏🙏❤️❤️🇧🇩🇧🇩