তখনও বাংলা জুড়ে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের দাপাদাপি শুরু হয়নি। ক্ষুদিরাম বসু-প্রফুল্ল চাকীদের নামও শোনেনি কেউ। সেই সময়ে অর্থাৎ বিংশ শতকের একেবারে শুরুর পর্বে কলকাতারই একজন মহিলা ‘ভারতী’ পত্রিকার মাধ্যমে বাঙালিকে মৃত্যুচর্চার আহ্বান জানালেন। বললেন, ‘‘মৃত্যুকে যেচে বরণ করতে শেখো।… তাকে স্পর্ধা করো, তার সম্মুখীন হও।’’ বাঙালির ভীরুতা কাটাতে তাঁর আর একটি নতুন লেখাও সামনে এসে গেল— ‘বিলিতি ঘুষি বনাম দেশী কিল’। আর তার পরেই ‘ভারতী’-র পাঠকদের উদ্দেশে একেবারে অন্য ধরনের লেখা পাঠানোর জন্য আহ্বান জানালেন তিনি। ভারতীতে লেখা হল, ‘রেলে, স্টিমারে, পথেঘাটে যেখানে সেখানে গোরা সৈনিক বা সিভিলিয়ানদের হাতে স্ত্রী, ভগ্নী, কন্যা কিংবা নিজের অপমানে মুহ্যমান হয়ে আদালতে নালিশের আশ্রয় না নিয়ে— অপমানিত ক্ষুব্ধ মানী ব্যক্তি স্বহস্তে তখনি তখনি অপমানের প্রতিকার নিয়েছে, সেই সকল ইতিবৃত্তের ধারাবাহিক বর্ণনা পাঠান।’ পাঠকেরা নিরাশ করেননি। তাদের মনের ভিতরে থাকা লুকনো আগুন জ্বলে উঠল। স্কুল কলেজের ছেলেরা দেখা করতে শুরু করল লেখিকার সঙ্গে। তাদের থেকে বেছে বেছে একটি অন্তরঙ্গ দল গঠন করলেন ওই মহিলা। ভারতের মানচিত্র সামনে রেখে তাকে সেবা করার শপথ নিল যুবরা।
শেষে তাদের হাতে একটি রাখি বেঁধে দিতেন এসবের মূল কারিগর, সরলা দেবী। আর কয়েক বছর পরে বঙ্গভঙ্গের দিনে এই লাল সুতোয় রাখি বন্ধনই গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল — যার নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং ররীন্দ্রনাথ।
সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথ নিজের মামা। সরলা দেবীর মা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী। ১৮৭৩ সালে জন্মের পর জীবনের শুরুর দিনগুলি কেটেছে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। আর সেখানেই ভাবনা ও সুরের জগতে রবিমামার সঙ্গে সরলার মেলবন্ধন ঘটে গিয়েছে দারুণ ভাবে। দু’জনে মিলেই সুর দিয়েছেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গানটিতে। যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল মন্ত্র হয়ে গিয়েছে। বন্দেমাতরম -এর শুরুর অংশে সুর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শেষে সরলা। এই গানই শত সহস্র ভারতবাসীকে আন্দোলিত করে এসেছে।
‘জীবনের ঝরাপাতা’ বইটিতে সরলা দেবী গান নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছেন,
…আমি গানের বাতিকগ্রস্ত ছিলাম। যেখান সেখান থেকে নতুন নতুন গান ও গানের সুর কুড়তুম। রাস্তায় গান গেয়ে যাওয়া বাঙ্গালী বা হিন্দুস্থানী ভিখারীদের ডেকে ডেকে পয়সা দিয়ে তাদের কাছে তাদের গান শিখে নিতুম। আজও সে ঝোঁক আছে।
কর্তাদাদামহাশয় চুচড়ায় থাকতে তাঁর ওখানে মাঝে মাঝে থাকবার অবসরে তাঁর বোটের মাঝির কাছ থেকে অনেক বাউলের গান আদায় করেছিলাম। যা কিছু শিখতুম তাই রবিমামাকে শোনাবার জন্যে প্রাণ ব্যস্ত থাকত— তাঁর মত সমজদার আর কেউ ছিল না। যেমন যেমন আমি শোনাতুম — অমনি অমনি তিনি সেই সুর ভেঙ্গে, কখনো কখনো তার কথাগুলিরও কাছাকাছি দিয়ে গিয়ে এক একখানি নিজের গান রচনা করতেন। “কোন, আলোকে প্রাণের প্রদীপ”, “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে”, “আমার সোনার বাংলা” প্রভৃতি অনেক গান সেই মাঝির কাছ থেকে আহরিত আমার সুরে বসান।
মহীশূরে যখন গেলাম সেখান থেকে এক অভিনব ফলের সাজি ভরে আনলাম। রবিমামার পায়ের তলায় সে গানের সাজিখানি খালি না করা পর্যন্ত, মনে বিরাম নেই। সাজি থেকে এক একখানি সুর তুলে নিলেন তিনি, সেগুলিকে মুগ্ধচিত্তে নিজের কথা দিয়ে নিজের করে নিলেন— তবে আমার পূর্ণ চরিতার্থতা হল। “আনন্দলোকে মঙ্গলা লোকে”, “এস হে গৃহদেবতা”, “এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ”, “চিরবন্ধু চিরনির্ভর” প্রভৃতি আমার আনা সুরে বসান গান।
রবীন্দ্রনাথই একদিন সরলাকে বলেছিলেন বন্দেমাতরম-এ সুর দেওয়ার জন্য। আত্মজীবনীতে সরলা দেবী লিখেছেন,
…জীবনের প্রথম দিকে কাব্য বা সঙ্গীতের রসগ্রাহিতায় রবীন্দ্রের আত্মপর বিচার ছিল না। যে কবির যেটি ভাল লাগত সেটিতে নিজের সুর বসিয়ে, গেয়ে ও গাইয়ে তার প্রচার করতেন। কোন কোন বৈষ্ণবপদাবলীতে, যেমন, “ভরা বাদর, মাহ ভাদর” এবং বিহারী চক্রবর্তীর দু-চারটি গানেও তাঁরই সুর দেওয়া “গাছে ফল শোভা যেমন”, “পাগল মানুষ চেনা যায়”, “বুঝতে নারি নারী কি চায়” ইত্যাদি, এমন কি “বাল্মীকি প্রতিভায়” বিহারী চক্রবর্তী রচিত একটি গান একেবারে সশরীরে সন্নিবিষ্ট।
রবীন্দ্রনাথই “বন্দেমাতরম”-এর প্রথম সুর বসিয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া সুরে ঐ দুটি পদে গানটি সর্বত্র চলিত হল। একদিন মাতুল আমায় ডেকে বললেন—“তুই বাকিটুকুতে সুর দিয়ে ফেল না।’’ ওরকম ভার মাঝে মাঝে আমায় দিতেন। তাঁর আদেশে “সপ্তকোটিকণ্ঠ কলকলনিনাদ করালে” থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবের সঙ্গে ও গোড়ার সূরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুর দিয়ে ফুটিয়ে নিলুম। দুই একটা জাতীয় উৎসবে সমস্বরে বহু কণ্ঠে বহুজনকে গাইতেও শেখালাম। সেই থেকে সভাসমিতিতে সমস্তটাই গাওয়া হতে থাকল।
“বন্দেমাতরম” শব্দটি মন্ত্র হল সর্বপ্রথম যখন মৈমনসিংহের সুহৃদ সমিতি আমাকে স্টেশন থেকে তাদের সভায় প্রোসেশন করে নিয়ে যাবার সময় ঐ শব্দ দুটি হুংকার করে করে যেতে থাকল। সেই থেকে সারা বাঙলায় এবং ক্রমে ক্রমে সারা ভারতবর্ষে ঐ মন্ত্রটি ছড়িয়ে পড়ল— বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে যখন গবর্নর সাহেবের অত্যাচার আরম্ভ হল আহিমালয় কুমারিকা পর্যন্ত ঐ বোলটি ধরে নিলে।
আমার বিয়ের পর (পঞ্জাবের আর্যসমাজের জাতীয়তাবাদী নেতা শ্রীরামভুজ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে সরলা দেবীর বিয়ে হয়) গোখলের সভাপতিত্বে বেনারস কংগ্রেসে প্যান্ডালের দোতলায় মেয়েদের মঞ্চে আমি উপবিষ্ট ছিলাম। আমার পাশে ছিলেন লেডি অবলা বসু। হঠাৎ সভা থেকে গোখলের কাছে অনুরোধ গেল আমাকে দিয়ে “বন্দেমাতরম” গাওয়ানর জন্যে। গোখলে পড়লেন বিপদে। তার কিছু আগে বাঙলাদেশে কোথাও কোথাও ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা “বন্দেমাতরম” সভাসমিতিতে গাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে। তিনি সাবধানপন্থী। গবর্নমেন্টের সঙ্গে ভাব রেখে কাজ করতে চান, গবর্নমেন্টের আদেশের বিরুদ্ধে কিছু করতে চান না। কিন্তু কি করবেন? ভারতের সর্বপ্রদেশ থেকে সমাগত প্রতিনিধিদের “বন্দেমাতরম” শোনার তীব্র ইচ্ছা কিছুতেই নিরোধ করতে পারলেন না। তখন গোখলে আমার কাছে একটি ক্ষুদ্র লিপি পাঠালেন গাইতে অনুরোধ করে— সঙ্গে সঙ্গে লিখলেন, সময় সংক্ষেপ, সূতরাং দীর্ঘ গানের সবটা না গেয়ে ছেঁটে গাই যেন। কোন অংশটা ছাঁটা তাঁর অভিপ্রেত ছিল জানি নে, আমি মাঝখানে একটু খানি ছেঁটে চট করে “সপ্ত কোটির” স্থলে “ত্রিংশ কোটি” বলে সমগ্রটা গাওয়ারই ফল শ্রোতাদের কাছে ধরে দিলুম, তাঁদের প্রাণ আলোড়িত হয়ে উঠল। ভারতের প্রান্ত প্রান্ত থেকে সমাসীন দেশভক্তদের মধ্যে আজও যাঁরা জীবিত আছেন— সেদিনকার গান ভুলতে পারেননি। আজ কংগ্রেস “High Command” থেকে কাটাছাঁটা “বন্দেমাতরম” গাওয়ার হুকুম বেরিয়েছে। তা হোক। হালফ্যাশনের ছাঁটা কুন্তলেও “বন্দেমাতরম” তার তেজ ও দীপ্তিরসে ঢল ঢল করছে।
আজীবন বঙ্কিমের সাহিত্যের ভক্ত ছিলেন সরলা দেবী। ভারতীতে সরলার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন বঙ্কিম। তাঁকে চিঠিও লিখেছিলেন। সরলাকে পাঠিয়েছিলেন নিজের লেখা বই। একসময়ে মামাবাড়ি ছেড়ে সরলা যখন নিজের বাবার বাড়িতে, সেখানেও আসতেন চা-ভক্ত বঙ্কিম। তারপর একদিন বঙ্কিমের মৃত্যু সংবাদ হঠাৎ কানে এল সরলার। তাঁর কথায়, ‘‘মনে হল আমারই জীবনের একাংশ খসে গেল।’’
(বানান অপরিবর্তিত)
(অলঙ্করণ -রাতুল চন্দ রায়)
অসাধারণ বললে ভুল হবে। বন্দেমাতরম নিয়ে এমন অপরূপ বিশ্লেষণ আগে পড়িনি। সাধুবাদ জানাই।