পর্ব ১

(ড্রাগ চক্রের পিছনে ছুটে বেড়ানো সঞ্জয় গুপ্ত-র কাজ। মাদক চক্রের অপারেশন নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘একটি অসমাপ্ত কাহিনী’। প্রকাশিত হবে মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবারে।)

রোদ উঠেছে আকাশ জ্বালিয়ে।

ইউনিটের বাকি সবার বয়স হয়েছে। তাছাড়া সিনিয়রদের সব জায়গাতেই একটু আলাদা মানসম্মান থাকেই। যেমন এই ইউনিটে, রাত্তিরে  একসাথে কোথাও সবাই মিলে একটু ড্রিংক নিচ্ছে, সেখানে হয়তো সিনিয়র একজনই ঠিক করে মিশিয়ে, হাতে তুলে দেবে। বোতল শেষ না করে বাড়ি ফিরতে নেই। সুতরাং, তোমাদের বয়েসে আমরা— বলে শেষ পাত্তর জোর জবরদস্তি করে খাওয়াবে। কিন্তু তাই বলে ফস করে সিগারেট জ্বালিয়ে দাদাদের মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়বে, তা হয় না। সেটা খুব অভদ্রতার পরিচয়। খেতে হলে, বাইরে গিয়ে, চুপিচুপি …। সিনিয়রদের কারও চোখে পড়লে একটু অপ্রভিত ভাবে হাসা আর বাকিটা সেই অবস্থায় ফেলে দেওয়া… এটা মিনিমাম ভদ্রতা।

সেই নিয়মেই, রোদে সিনিয়র একজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মালের হিসেব নেবেন, এটা ভূ-ভারতে কোনও প্রিভেন্টিভ ইউনিটে হয় না।

কাগজ কলম নিয়ে অতএব, অমিতই বাইরে বেরিয়ে এলো। সাদা কাগজ। সরলরেখায় একের পর এক, স্বচ্ছন্দে লিখে যাওয়ার অভ্যাস সেই স্কুল জীবন থেকেই তৈরি হয়নি। তাই আগেই রুল টেনে নিয়েছে। এই ধরণের ইউনিটে একটা কালো রঙের মোটা গোলাকার ডান্ডা থাকে। অনেক কাজে লাগে। তার মধ্যে একটা, সাদা কাগজে রুল টানা।

দুটো ঘর। প্রথম ঘর হচ্ছে ক্রমিক নং । আর দ্বিতীয়, তার ওজন।

ট্রাকটা আটকানো হয়েছিল কাল রাতেই। বেচারাদের কপাল খুব খারাপ। পাহাড়ি রাজ্য থেকে নেমে এসেছিল একটা অপ্রচলিত পথ দিয়ে।

রাতে নিয়মিত টহলে বেরিয়েছিল ইউনিটের দু-চারজন, সাদা জিপসি গাড়িটা নিয়ে। পেট্রোল দেদার খায় বটে, কিন্তু দারুণ স্পিড তোলা যায়। মেইন রাস্তায় প্রচুর গাড়ির ভিড়। চেক করলেই কেস হতে পারে। ওই বিদেশি কাপড়জামা, এমনকি সিগারেট। তাছাড়া অনেক ব্যথার ওষুধ ও আজকাল নিয়মিত ড্রাগস হিসেবে ব্যবহার হয় পাহাড়ি রাজ্যে। ধরলে বেজায় হুজ্জোত। বেশ কয়েকটা কেস ধরা হয়েছে। সেগুলো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সবাই।

রাতে না বেরুলে, সকালে আবার বস মুখ ফুলিয়ে অব্যয় সূচক ভাবে কথা বলেন। তাই রাতে বেরিয়ে, ঠিক করা হয়েছিল ওই অপ্রচলিত পথে যাওয়া হবে। নতুন ব্রিজ খেলা শুরু হয়েছে। বাজি রেখে খেলা হবে। সকালে ওই পয়সায় ফিস্টি করে বাড়ি ফেরত।

চারজন অফিসার। দু’জন সেপাই। সঙ্গে ড্রাইভার আলিদা। সাতজন বসতে কষ্ট হয়। তবু … এই গাড়িটাই অফিসিয়াল ভাবে দেওয়া হয়েছে। সেটা নিয়েই রাত্তির এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়া।

শহর ছেড়ে প্রায় পনেরো কুড়ি কিলোমিটার যাওয়ার পর, একটা কালভার্ট পাওয়া যায়।  নতুন করে তৈরি। বেশ জায়গা আছে। সেখানেই গাড়ি রেখে বসা। ভয়ের কিছু নেই। একটু দূরেই পুলিশ ফাঁড়ি আছে একখানা। বেশ কয়েকবার আসা যাওয়ার সুবাদে, চেনা জানা হয়ে গেছে ওদের অনেকেরই সঙ্গে। সিপাইরা ওখানে গিয়েই আড্ডা দেয়। ওদের একটা বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকাবার ব্যবস্থাও আছে। সেটা নামিয়ে মধ্যে মধ্যে ওরা যে দু-চারটে ট্রাক যায় আসে, সেগুলোকে থামায়। তারপর যেতে দেয়।

কাল রাতেও অন্যথা হয়নি। অমিতরা চারজন , নিজেদেরকে গুছিয়ে, ব্রিজ খেলতে বসেছে, আলিদা আর দুজন সেপাই গেছে থানার গেটের সামনে। আগুন জ্বালিয়ে গল্প করা লোকগুলোর সঙ্গে বসতে।

একটা দুটো ট্রাক মধ্যে মধ্যে নামছে। দাঁড়াচ্ছে একটুখন। তারপর আবার নিস্তব্ধ পথ।

ব্রিজ নতুন শিখলে যা হয়, অন্যকে ডাকতে দিতে ইচ্ছেই হয় না। ফোর নো-ট্রাম্প ডেকে, সামাল দিতে না পেরে, অমিত যখন পার্টনারের চোখের দিকে অবধি দেখতে সাহস পাচ্ছে না, তখন হঠাৎ ফিসফিস করে অরুণ পাশে এসে ডাকলো,  “স্যার, একটু আসবেন এদিকে? “

অন্যসময় হলে পাত্তাই দিত না, কিন্তু পালাবার এই সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না। পল্লবদাকে নিজের কার্ড গুলো ধরিয়ে, বললো, “একদম সিউর গেম হবে, আপনি খেলুন। আমি ওর কথা শুনে আসছি।”

একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে, অরুণ ফিসফিস করে বললো,” একটু আগে একটা ত্রিপল দিয়ে পুরো ঢাকা ট্রাক এসেছিল। খালি ভেতরটা। গেটে ওরা ত্রিপল সরিয়ে দেখেছিল। “

বিরক্তির সুরেই অমিত বললো, “তাতে কি হয়েছে? এই রাস্তায় খালি গাড়িই যাওয়ার কথা।”

“না স্যার। গাড়িতে তিনটে লোক ছিল। একটা ভাল পোশাক পরা। ভিতরে থেকে সেই লোকটা ড্রাইভারকে চা খাওয়ার জন্য পাঁচশো টাকা গেটে দিতে বলেছিল। ড্রাইভার নেমে, তাড়াতাড়ি অন্ধকারে দিয়ে চলে যায়। কিন্তু পরে গেটে দেখে, তাড়াহুড়োয় হাজার টাকার নোট দিয়ে গেছে। “

অমিত একটু ভ্রু কুঞ্চন করলো। অরুণ ছেলেটির প্রিভেন্টিভ সেন্স খুব ভাল। তবু বললো, “হয়তো ভুলে দিয়েছে।”

“না স্যার। এর ভেতরে অন্য ঝামেলা আছে। এই রাস্তায় খুব বেশি হলে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে যায়। সেখানে পাঁচশো টাকা… তারপর ভুল করে হাজার টাকা। গেটে ওরা তো কালকে পার্টি করবে বলছে। “

“তো এখন বেরুলে, ওই গেটের ছেলেদের খারাপ লাগবে হয়তো। “

” সোজা রাস্তা। স্যার, দশ কিলোমিটার দূরে ধরে নিলে হবে।”

এমনিই তাসে হারার চান্স খুব বেশি। এই সুযোগে খেলা ভণ্ডুল করে দেওয়ার সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না। সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলে, অমিত গাড়িটা ধাওয়া করে ধরার প্রস্তাব দিল।

সবমিলিয়ে মিনিট দশেক লাগলো সবাইকে গাড়ির মধ্যে ঠেলে ঠুলে বসিয়ে নিতে। তারপরই ঝড় উঠিয়ে গাড়ি ছুটলো আলিদার হাতে। ফর্সা পরিষ্কার চেহারা। ভালই উচ্চতা । খুব নিচু স্বরে কথা বলেন। কিন্তু ড্রাইভিং-এর হাত সোনা দিয়ে বাঁধানো।

দশ কিলোমিটার যাওয়ার আগেই ট্রাকটা নজরে পড়ে গেল। তবে সোজা রাস্তা। আরও একটু এগিয়ে যেতে দেওয়া হল। সুবিধামত জায়গায় থামালেই সুবিধে।

সত্যিই তিনটে লোক। ড্রাইভার আর হেল্পার ছাড়াও পরিস্কার পরিছন্ন পোশাক পরা একজন লোক। বললো, প্যাসেঞ্জার। শহরে নেমে যাবে।

তবে ট্রাকের পিছনে একদম খালি নয়। কয়েকটা বস্তা আছে। অল্প সব্জির চেহারা উকি দিচ্ছে। কয়েকটায় আবার ছেড়া কাগজ।

ছেড়েই দিচ্ছিল গাড়িটা কিন্তু অরুণের কথা মনে রেখে, অমিত বললো, “লোক তিনটাকে গাড়ির কেবিন থেকে নামিয়ে, ভালো করে কেবিনটা দেখে নাও। আর সি কোথাকার দেখো। এমনি রেজিস্ট্রেশন তো দেখছি পাহাড়ি রাজ্যের। “

লোকগুলো দোনামোনা করছিল নামতে। একটু জোর করেই নামানো। তারপর অরুণের ইতিপাতি করে খোঁজা। সিটের গদি সরিয়ে, সামনের গ্লাসের উপরে থাকা দুটো বাক্স।

অরুণের জন্য কষ্টই হচ্ছিল অমিতের। কিছুই হয়তো পাওয়া যাবে না। সবার গালি খাবে। তারমধ্যে যারা তাসে জিতছিল, এরা আরও বেশি করে দেবে।

মিনিট দশেক খুঁজতে দেওয়ার পর অমিত নিজেই উঠলো কেবিনে। আর তক্ষুনি, অরুণ ড্রাইভারের সিটের নিচ থেকে বের করে, ওর চোখের সামনে তুলে ধরলো, দু’টি নাম্বার প্লেট। অন্য রেজিস্ট্রেশন নাম্বারের।

কিছু না বলে, তা নিয়ে নেমে এলো দু’জনেই। সামনে আর পিছনের নাম্বার প্লেট দু’টো দুই সাইজের। মেপে দেখা গেল, একেবারে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে।

পাঞ্জাব বডি ট্রাক। ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। অথচ গাড়িতে তেমন কিছুই নেই।

তাহলে ভুয়ো রেজিস্ট্রেশন নম্বর সঙ্গে নেওয়ার কারণ কি?

গাড়িটা অফিসে নিয়ে যাওয়া দরকার।

(ক্রমশ)