পর্ব ১৯

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

মোস্তফা শেখকে কিন্তু জলদস্যু বাহিনীর নেতারা কেউ খুব একটা পছন্দ করতো না। আবার মজার কথা হল, কেউ তাকে দলছাড়া করতেও চাইতো না। কারণ, মোস্তফা ছিল একজন ফাইটার, সুন্দরবনের বাস্তবতায় অ্যাম্বুশ মাস্টার। একটা বন্দুক হাতে নিয়ে সে অনেক কিছু করতে পারতো। তাই তাকে সবাই ভয় পেত। কেউ চাইতো না মোস্তফা অন্য দলের হয়ে জলদস্যুতা করুক। সবাই ওকে নিজেদের দলে রাখার চেষ্টা করতো। তবে আমার একটা পর্যবেক্ষণ হল, প্রতিটি জলদস্যু নেতা বা উপরের কলকাঠিরা মোস্তফাকে ঠিক ভাবে চিনতে পারেনি। মোস্তফার জঙ্গলের মধ্যে লড়াই করার ক্ষমতাটা ওদের চোখে পড়েছে কিন্তু জলদস্যুতা ছেড়ে সাধারণ জীবনে ফিরে আসার ওর অদম্য ইচ্ছার ব্যাপারটা তাদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে।

বারবার ধোঁকা খেয়ে মোস্তাফা আগেই ভেবেছিল, যা করবে একেবারে সঠিক পরিকল্পনা করেই করবে। তাই ও নোয়া মিঞার দলে নিজের জায়গা পোক্ত করতে চেয়েছিল প্রথমে। তারপর নিজের মনের গোপন ইচ্ছেটা কিছু বিশ্বস্ত সহদস্যুদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিল। বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, জলদস্যুর জীবন কোনওদিন একটা মানুষের জীবন হতে পারে না। হয়তো রোজগার হচ্ছে কিন্তু সেটা ভোগ করতে পারছে কি কেউ ? জুটেও গেলো মোস্তফার কিছু সঙ্গী। ওর সাথে তখন আরও পাঁচ- ছয়জন। নোয়ার দলের ভিতরে আর একটা দল। এবার মোস্তফারা অপেক্ষায় থাকে একটা সুযোগের।

সুযোগ এসে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। সেই সময়ে বড় ট্রলার নিয়ে জেলেরা গেছে সাগরে মাছ ধরতে। আগেই বলেছিলাম, এই সময়টা বড় বড় জলদস্যু বাহিনীর কাছে খুব লোভনীয় সময়। জেলেদের অপহরণ করার অপেক্ষায় থাকে ওরা। তারপর আসে মোটা টাকার মুক্তিপণ।  এই রকম একটি অভিযানের জন্য নোয়া দায়িত্ব দেয় আলিফকে। সেই দলের একজন সদস্য ছিল মোস্তফা। দায়িত্ব ছিল ইলিশের জেলেদের অপহরণ করা। একটি বাহিনী তৈরি করে দেয় সে। ২৫-৩০ জনের বাহিনী। নোয়ার নির্দেশে নদীতে ট্রলার ভাসে ট্রলার। খুব সুচারু ভাবে মোস্তফা ওর সাথে থাকা ৫-৬ জন সেই সাহসী তরুণকেও জুড়ে নেয় বাহিনীতে। সবার হাতে অস্ত্র। মোস্তফার সব পরিকল্পনা রেডি।

ডেরা থেকে ভাসলো ট্রলার। যাবে সাগরে জেলে অপহরণ করতে। কিন্তু কিছুদূর গিয়ে ট্রলার আর এগোলো না। ডেরা থেকে কিছুটা দূরে একটি জায়গায় নোঙর ফেললো সেই ট্রলার। সাগর উত্তাল। আর সেই সুযোগটিই খুঁজছিলো মোস্তফা। দলনেতা আলিফকে থামানো হলো। এই আবহাওয়ায় সাগরে গেলে ডুবে মরতে হবে। এই কথাটি কানে কানে ছড়িয়ে দিলো মোস্তফা। ফলে তারা সেদিন আর বের হয়নি।

কোনওরকম বিদ্রোহের সম্ভাবনার কথা নোয়ার মাথায় আসেনি। কি করে আসবে? মোস্তফার সাথে যারা আছে তাদের বেশির ভাগই তো নোয়ার নিজের লোক। এছাড়া আরেক দস্যুনেতা আলিফও তাদের সাথে। নোয়ার বিশ্বস্ত। আর মাত্র যে ক’জন মোস্তফার সঙ্গে আছে তারা হাতে গোনা মাত্র।

বিদ্রোহ হল। পরদিন সকালে যখন ওই ২০ -২৫ জন জলদস্যু একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায়, সেই সময় অতর্কিতে তাদের ঘিরে ফেললো মোস্তফা ও তার সহযোগীরা। সবার হাতেই অস্ত্র।  বাকিরা নিরুপায়। অস্ত্রের মুখে বশ্যতা স্বীকার করতে বাধ্য হল বাকি জলদস্যুরা। হাত-মুখ বেঁধে দেওয়া হল সেই জলদস্যুদের। কেড়ে নেওয়া হল সবার অস্ত্র। তারপর ওই দস্যুদের নিয়ে গিয়ে ট্রলারের ভিতরে বেঁধে রাখা হল। দস্যুনেতা আলিফও ছিল সেই দলে। তারা প্রায় বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল মোস্তফার দলের কাছে।

নোয়ার দস্যুরা সব নিষ্ক্রিয়। এবার হবে চূড়ান্ত আক্রমণ। কিন্তু সে কথা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেওয়া যাবে না কাউকে।  আলিফের মাধ্যমে ফোনে নোয়াকে জানিয়ে দেওয়া হল— আবহাওয়া ভাল হয়নি। ফলে ওরা আজকেও সাগরের দিকে যেতে পারছে না। এদিকে নিজের ডেরায় সঙ্গীসাথীদের নিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছিলো তারা। কারণ খারাপ আবহাওয়ায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান থাকে না।

একেবারে গল্পের রবিনহুডের দল যেভাবে অতর্কিতে আক্রমণ করে, ঠিক সেই ভাবে নোয়াবাহিনীকে অপ্রস্তুত অবস্থায় রেখে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল মোস্তফা আর তার সঙ্গীরা।

আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানালো সকলকে। কিন্তু সেই আহ্বানের জবাবে গুলি চালিয়ে দিল নোয়ার সঙ্গীরা। শুরু হল গুলির যুদ্ধ। টানা গুলির শব্দে কেঁপে উঠল গোটা এলাকা।

গোলাগুলিতে ফরহাদ নামে এক জলদস্যুর মৃত্যু হয়। রাঙা নামের আর এক জলদস্যু আহত হয়। ওর হাতে গুলি লাগে। আহত হয় আরও কয়েকজন জলদস্যু।

একসময় থেমে যায় গোলাগুলি। জয়ী হয় বিদ্রোহীরা। পুরো দলটির নেতৃত্ব চলে আসে মোস্তফা শেখের কাছে। পানিতে লাফিয়ে পড়ে জীবন নিয়ে পালায় দস্যুনেতা নোয়া মিয়া।

অনেকেই পালিয়ে যায়। অন্যরা আত্মসমর্পণ করে। তখন থেকেই ওই বাহিনীর নাম নোয়া বাহিনী থেকে মাস্টার বাহিনী হয়ে ওঠে। অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, মোস্তফার নাম কেন মাস্টার হয়েছিল। আসলে মোস্তফা শেখের চলনবলন সবটাই ছিল মাস্টারদের মতো। গম্ভীর চেহারায় ঠিক যেন একজন স্কুলমাস্টার। আর ও যে পরিকল্পনা তৈরিতে মাস্টার— সেটা এই বিদ্রোহের পরিকল্পনা সাজানোতেই পরিষ্কার। যদিও জলদস্যুরা ওকে মজা করেই মাস্টার বলতো, তবে আমার মনে হয়, নামটা ওর জন্য একেবারে সার্থক। যদিও পড়াশোনার দৌড় তার শেষ হয়েছে প্রাথমিকের আগেই।

রক্তাক্ত বিদ্রোহ শেষ। বাহিনীর কর্তৃক মাস্টারের কাছে (এখন থেকে মোস্তফাকে আমিও মাস্টার বলবো)।

বিদ্রোহ শেষ করে একটি গাছে উঠে আমাকে ফোন করল মাস্টার।

-ভাই! আমি রেডি ! এখন গোছগাছ করে চলে আসেন। সারেন্ডার করবো।

একটা ঝাঁকুনি খেলাম আমি। কি বলছে মোস্তফা!! না, মাস্টার। একজন দু’জন নয়— একটা গোটা বাহিনী প্রস্তুত আত্মসমর্পণের জন্য!  কিন্তু আমাকে তো এবার এগোতে হবে। যেভাবে হোক রাজি করাতে হবে প্রশাসনকে। অনেক কাজ। আর বসে থাকার সময় নেই। দিন আসছে— সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হবে।

ফোনে কথা বলার সময় মাস্টারের যে কণ্ঠস্বর আমি শুনেছিলাম, সেটা ছিল আনন্দের স্বর। একটা কিছু করতে পারার আনন্দ। আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল সেই কন্ঠস্বর। আমার ভিতরেও সঞ্চারিত হয়েছিল একটা শক্তি। আমাকে পারতে হবে। জলদস্যু দল রেডি। এর আগে তিন দফা ব্যর্থ হয়েছি। এবার নতুন করে আবার নামতে হবে। রাজি করতে হবে প্ৰশাসনকে। অনেক কাজ।

(ক্রমশ)

1 COMMENT

Comments are closed.