তপন কে ডেকে, সঙ্গে নিয়ে বাইরে এলো অমিত।

একটা ওজন করাবার পাল্লা পাথর বাজার থেকে আনা হয়েছে। যদিও সবারই জানা, মেশিন প্যাক করা গাঁজার পেকেট গুলো সাধারণত হয় দশ কেজি হবে নাহলে পাঁচ কেজি।

একটার পর একটা প্যাকেটে নামানো হচ্ছে। ওজন হচ্ছে। অমিত সিরিয়াল নাম্বার করে টুকে যাচ্ছে। প্যাকেট গুলো মাল জমা রাখার গুদামে জমা দেওয়ার সময়, এই কাগজের একটা কপি দিতে হবে। সেটায় গুদাম রক্ষক পোস্টে যিনি আছেন তিনি সই করে রাখবেন। এই কপিটাই আবার মেজিস্ট্রেট এর কাছে দেখাতে হবে। সুতরাং ওভার রাইটিং কোনমতেই চলবে না।

লিখতে লিখতেই , অমিত চোখের কোনায় দেখতে পেল, একটা পাঁচ কেজির প্যাকেট আস্তে আস্তে, পাশে সরিয়ে রাখছে অরুন। দেখেও, না দেখার ভান করে রইলো অমিত। একসময় সব হিসেব নেওয়ার পর, সাক্ষীদের সই সবুদ নেওয়ার জন্য আবার রুমে এলো। এই কাগজে সাক্ষীদের, ধরা পড়া অপরাধীদের সই নিতে হয়।

প্রায় দুপুর। পল্লবদা এসে বসলেন পাশে। অমিত যখন ওজন নিচ্ছিল, তখন একপ্রস্থ জেরা করে ফেলেছেন। খুব মিষ্টি করে, মায়াবী সুরে জেরা করেন। সাধারণত রাগতে, চেঁচাতে তাকে আজ অবধি অমিত শোনে নি।

বললেন, ড্রাইভার এর গাড়ি নিয়ে কালিয়া গ্রাম অবধি যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে একটা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি রেখে তার আর হ্যান্ডিম্যান চলে যাওয়ার কথা। গাড়ির মধ্যেই চাবি রেখে যাওয়ার কথা। তারপর গাড়িটা নিয়ে কে যাবে, সেটা ওরা জানে না। এই কাজের জন্যে, ওরা তিরিশ হাজার টাকা পাওয়ার কথা। মনে হচ্ছে, সত্যি কথাই বলছে।

– আর ওই লোকটা?

– সেটা নাকি প্যাসেঞ্জার। রাস্তায় উঠেছিল।

– কি করা তাহলে?

– চল, একবার ঘুরে আসি জায়গাটা। পেসেঞ্জার লোকটাকেও নিয়ে যাই। ওখানে ছেড়ে দেব।

বাকি সহকর্মীদের ঘরে যেতে বলে, নতুন চার সেপাই কে নিয়ে বেরুলো । এখন দুটো গাড়ি। পল্লবদা নিজের গাড়িটা নিয়েছেন  বাকিদের অবশ্য সন্ধের মধ্যেই অফিসে আবার আসতে হবে। ঘন্টা চারেকের বিশ্রাম। রাতে পরের দিনের প্লান।

আজকে দুটো গাড়ি। কোমরে লুকানো অস্ত্র। সেটা সঙ্গের সহযাত্রীদের দেখিয়ে আবার শার্টের আড়ালে রাখা। তবে, তিনজনকেই যেভাবে সফ্ট করে রেখেছে, তাতে পালাবার সুযোগ নেবে বলে মনে হয়না।

ঘন্টা খানেক লাগলো পৌঁছাতে। বেশ বড় পেট্রোল পাম্প। অনেক জায়গা চারপাশে। অনেক ট্রাক পার্ক করা রয়েছে। ড্রাইভার নেই। নতুন একটা গাড়ি পার্ক করে কেউ যদি চলেও যায়, মনে হয় না কেউ নজর করবে।

উল্টোদিকে কয়েকটা ছোট ছোট দোকান। দুটো টায়ার ঠিক করার। দু চারটায় চা পাওয়া যায়, স্টিলের থালায় গোল্লা রাখা, কাঁচের দেরাজে। নিমকি কাঁচের বয়ামে। দেখে, খুব একটা ভক্তি লাগলো না। অথচ বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। ভাত ভাত ক্ষিদে। ওই তিনটে লোকেরও পেয়েছে।

লোকেশনে একটু হাটাহাটি করে, অমিত তেমন কিছু দেখতে না পেয়ে, গাড়িতে ফিরে এসে আলীদা কে বলল, চলুন ফিরি। এখানে ভালো ভাত খাওয়ার কোন দোকান দেখছি না। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। আপনাদের ও পেয়েছে নিশ্চয়। এদেরকেও খাওয়াতে হয়। কোথায়  খাবো দেখি?

ট্রাক ড্রাইভার আর সেই লোকটাকে  একসাথেই বসানো হয়েছিল পল্লবদার গাড়িতে।  সঙ্গে বসেছিল অরুন।  সামনে ড্রাইভার আর পল্লবদা।

পেছনে জিপসীতে,  অমিত আর অন্যান্যরা।  আজকাল অমিত গাড়ি চালানো শিখছে। সুযোগ পেলেই অফিসের গাড়ি চালায়। আজকেও চালিয়েছে। আলীদা পাশে বসে শুধরে দেয়।

“কোথায় খাওয়াই” কথাটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলো ট্রাকের হ্যান্ডিম্যান। ক্ষিদে তারও পেয়েছিল নিশ্চয়ই। বললো, ওই লাল রঙের দোকানটায় ভাত ও পাওয়া যাবে।

অমিত, একবার দেখলো দোকানটা। মাথা নাড়লো। ধুস, একদম লেতেরা। খাওয়া যাবে না।

চল, তোকে সামনে নিয়ে গিয়ে, মাছ ভাত খাওয়াবো।

ফেরার পথে, মোটামুটি একটা ভাল পরিষ্কার পরিছন্ন হোটেল দেখে, মাছ ভাতই সবাইকে খাইয়ে দেওয়া হলো।

পেসেঞ্জার লোকটা একটু গাই গুই করছে। অমিত আশ্বাস দিলো, রাতের মধ্যেই একটা কিছু হবে। আপাতত কোপারেট করতে।

বিস্বরূপ ভট্টাচার্য্য মশাই ও এই ইউনিটেই কাজ করেন। পরিষ্কার, গোলগাল মাঝারি উচ্চতা। একটা বেশ দাদা দাদা ভাব আছে।  প্রত্যেকটা কেসেই প্রচুর কাগজ কলমের কাজ থাকে। ভদ্রলোক খুব একটা ফিল্ড ওয়ার্ক করতে উৎসাহ পান না। কিন্তু কাগজের ব্যাপারে তুলনা নেই।

অফিস ফিরে দেখলো, কাগজ কলমের কাজ দাদা শুরু করে দিয়েছেন। নারকটিক্স এর কেসে গ্রেফতার করতেই হবে, কোর্টে পেশ করতেই হবে, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে।

বিস্বরূপদা কয়েকটা তথ্য জেনে নিলেন। তারপর বললেন, কটায় গ্রেফতার দেখাবে? বারোটায় দেখিয়ে দেই?  তাহলে, কালকে বারোটার মধ্যে কোর্টে নিয়ে গেলেই হবে।

অমিত মাথা নাড়লো। তারপর বলল, তৃতীয় লোকটিকে নিয়ে কি করা? জড়াতে পারছি না। স্টিক করে রয়েছে, পেসেঞ্জার বলে।

– ভরে দাও। কোর্ট ছাড়লে ছাড়বে।

– কিন্ত ড্রাগস কেস। হাই কোর্ট ছাড়া মনে হয়না বেইল পাবে। মিনিমাম ছয় মাস। মিছেমিছি জেল খাটাবো?

– তাহলে কি করা?

মাথাটা জ্যাম জ্যাম লাগছে। কাল রাতেও ঘুম হয় নি। একটা ডিসিশন  নিতেই হয়। এরকম অবস্থায় পার্থ, একবার একটা সিগারেট …

প্রায় যন্ত্রের মত অমিত হাত বাড়ালো বিভাসদার, টেবিলের উপর খুলে রাখা সিগারেট পকেটের দিকে। একটা সিগারেট বার করলো। ফিল্টার উইলস। খুব যত্ন করে, ভেতর থেকে তামাক পাতার গুঁড়ো গুলো বের করলো পাকিয়ে পাকিয়ে। তারপর তপনকে বললো, “ওই যে প্যাকেট টা সরিয়েছিলি, সেখান থেকে একটু এনে দে।”

 চুপচাপ একটি কথা ও না বলে এক মুঠো এনে দিলো তপন। এবার সেটার সাথে খুব ভালো করে তামাকপাতা কচলে কচলে মিলিয়ে , তারপর দেশলাইয়ের কাঠির সাহায্যে ঠুকে ঠুকে ভেতরে ঢোকাল অমিত। সামনে একটু ফাঁকা। সেখানে এবার আগুন দিয়ে। দুই আঙুলের ফাঁকে গুঁজে চোখ বন্ধ করে টান… একবার । আহ… ভেতর অবধি যেন খুলে যাচ্ছে ।

এভাবেই টানতে বলেছিল পার্থ। কিছুতেই ফর্মুলা মাথায় থাকছিলো না, বি এস সি পড়ার সময়… অথচ তখনো, এখনো মুখস্তবিদ্যায় ভালো হলেই ভালো মার্কস আসতো পরীক্ষায়। যে যত মনে রাখতে পারে, সেই ভালো।

 আর কিছুতেই মনে থাকতো না, থাকছিলো না অমিতের।

তখন পার্থের সাথে আলাপ। ঘনিষ্ঠতা। প্রবলেম শুনে, প্রচুর পাতা এনে দিয়েছিল। বলেছিল , এরকম ভাবে মিলিয়ে খাস। মাথা খুলে যাবে।

ঘরে, টেবিলের ড্রয়ারে রাখলেও খাওয়া হচ্ছিল না।

কিন্তু,  একদিন….

(ক্রমশ)