রাতে ঘুমটা ঠিক ভাবে হয়নি। দু’বার উঠে জল খেতে হলো।
ভোরের দিকে অবশ্য জমিয়ে স্বপ্ন একটা দেখা গেল। সত্যেন স্যারের বাড়ি থেকে অঙ্ক কষে ফিরছে। একটা উঁচু জায়গায় স্যারের বাড়ি। ফেরার রাস্তায় অনেক দূর অবধি দেখা যায়। সেখানে দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে, চারটি মেয়ে নিজেদের মধ্যে খুব হাসি ঠাট্টা করতে করতে আসছে। ওরাও পড়ে স্যারের কাছে। সবাইকেই চেনে অমিত। শুধু একজনের চেহারা বেশি চেনা। সামনাসামনি দেখা হয়ে গেলে কী কথা বলবে ভাবতেই ঘেমে সারা। শেষটায় একটা গোল মতো পাথরের টুকরো নিয়ে পা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে অমিত। ওদের সামনে পৌঁছতেই উচ্ছ্বসিত হাসি ওদের। একই জায়গায় ওরাও যাচ্ছে। টিউশন নিতে। তবু অমিতকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করা, ক্লাস কিসের ছিল। তারপর সেই বিশেষ মেয়েটির টিপ্পনি, এই ভাবে জুতো দিয়ে ফুটবল খেললে জুতোর আয়ু বেশিদিন থাকবে না। প্রশ্নের জবাব দিয়ে , বিব্রত মুখে কোনওমতে ওখান থেকে দ্রুত হেঁটে যাওয়া।
স্বপ্নে এত কাছে— মনে হচ্ছিল, যেন ছোঁয়া যাবে। তবে স্বপ্ন তো স্বপ্নই।
স্বপ্নের চক্করে পড়ে, ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল। স্নান করে কিছু মুখে দিয়ে বেরুতে বেরুতে প্রায় বারোটা।
তবে এই অফিসে এসবের চাপ নেই। যখন খুশি আসো, যাও। মাস দু’য়েক পর দেখা হয়, কেস ক’টা ধরা পড়লো। আর সেই চক্করে, বসরা জানেই যে লোকগুলো অফিসের কাজে অন্তত দশ বারো ঘণ্টা কাটায় নিয়মিত ভাবে। কোনও নিৰ্দিষ্ট সময় নেই, রাতবিরেতে যখন খুশি বেরুনো আর ফেরা।
অমিতের বন্ধু সঞ্জয় বিয়ে করেছে চাকরি পেয়েই। তখন অন্য ব্রাঞ্চে ছিল। দশটা পাঁচটায় বাড়ি ফেরত। বিকেলে মধ্যে মধ্যে যুগলে বাজার, বেড়াতে যাওয়া। সুখী গৃহ কোণ শোভে গ্রামাফোন। এই ব্রাঞ্চে আসা মাত্তর সব চেঞ্জ। সেদিন নাকি ওর বউ সোনালী, জিজ্ঞেস করেছিল দশটা-পাঁচটায় এই ব্রাঞ্চে কেন কাজ করা সম্ভব নয়? সে বলেছে, তাহলে অপরাধীরা সকাল দশটা থেকে পাঁচটা অবধি ঘুমোবে নাকে তেল দিয়ে, তারপর সন্ধ্যায় চরতে বেরুবে। জবাব শুনে তিনি খুব একটা নাকি খুশি হননি। কিছু করার নেই। তবে অমিত দেখেছে, রাতের ডিউটি থাকলে, সকালে বন্ধুবর বাজারে গিয়ে মাছ কিনে বাড়ি ফেরেন। আর তারপর পুরো দিনটি অফিসে আসার চান্স নেন না। সংসারী লোকেদের অনেক ঝামেলা।
অফিসে পৌঁছে প্রথমেই বিশ্বরূপদা। বসিয়ে বললেন , “শোন, ফলোআপ করার জন্যে পাহাড়ি রাজ্যে যেটা পাঠিয়েছিলাম ওটার রিপোর্ট এসেছে। জায়গাটা ঠিকই পাওয়া গিয়েছিল কিন্তু পাখিরা সব পালিয়ে গিয়েছে। কিছু প্যাক করার প্লাস্টিক ম্যাটেরিয়াল পাওয়া গেছে। ওজন করার মেশিন। অল্প কিছু মাল পাওয়া গেছে। আসলে, গাড়ি ঠিক জায়গায় পৌঁছয়নি খবরটা ওরা পেয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। “
মোটামুটি আর খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। পাহাড়ি সমাজে ঐক্যবোধ খুব স্ট্রং। তাছাড়া এই সব জিনিসের জন্যে চাষ নিয়মিত দুর্গম স্থানে হতেই থাকে। সাধারণত খবরাখবর নিয়ে অমিতদের ডিপার্টমেন্ট বছরে একবার হয়তো ফসল নষ্ট করতে লোকলস্কর নিয়ে যায়। তাও আধাসামরিক বাহিনী নিয়ে। তারপরেও গ্রামের লোকেরা পাথর ছোড়ে, মহিলারা পথ আটকে রাখে। জোর জবরদস্তি করে গাছ কাটা।
আসলে হয়তো এখানে অন্য উপার্জনের উপায়, একদম নীচের লেভেলে আসে না। কেন আসে না, সেটার অনেক কারণ। একবার এই রকম ফসল কাটার অভিযানের আগে, পেপ টক দিচ্ছিলেন এক বড় অফিসার। বলছিলেন, সরকার নাকি চেষ্টা করছে চাষিদের জন্যে অন্য ধরনের চাষ আবাদের বীজ দিতে। কিন্তু চাষিরা নিচ্ছে না। কারণ, এইসব চাষ করে বিক্রি করে যে টাকা পায়, সে তুলনায় ওসব করলে কিচ্ছু হবে না। সুতরাং চাষ চলবে। অফিসারদের কাটতে যেতে হবে। আর সিরিয়াসলি চেষ্টা চালাতে হবে, খরিদ্দারদের ধরতে। ফসল কাটাকাটির ট্রিপটা, কলিগদের সঙ্গে একটা পিকনিক, নাহলে ডে আউট হিসেবে ট্রিট করে এনজয় করতে।
বিশ্বরূপদা অবিশ্যি আরও কিছু খবর দিলেন। ড্রাইভার এবং হ্যান্ডিম্যানের বাড়ী খুঁজে পাওয়া গেছে। সার্চ হয়েছে। কিছুই পাওয়া যায়নি। বাড়ির লোকেদের বলা হয়েছে আদালতে উকিল নিয়ে আসতে। তবে মন্দের ভালো দু’টোরই বিয়ে হয়নি। ভাই-টাই আছে। নাহলে আবার কেলোর কীর্তি হয়ে যেত। বৃদ্ধ বাবা মা অথবা শিশু কোলে স্ত্রী, অফিসের সামনে জিনা হারাম করে দিতো। খারাপ লাগলেও কিছু করার থাকে না। জেল হবেই। মিছিমিছি উকিল আর কোর্টের চক্করে পড়ে সঞ্চয় শেষ। যারা ধরা পড়ে, তারাই ফাঁসে। বাকিরা পগারপার। অন্তত ড্রাইভার বা তার সহযোগী নিচু তোলার লোকেদের জন্যে আসবেই না কেউ। শুধু পরিবার ছাড়া।
তবে প্যাসেঞ্জার লোকটি সম্বন্ধে জানা গেছে, সে আদতে বিহারের লোক। একটা কোম্পানির কাজ নিয়ে পাহাড়ি শহরে এসেছিল বছর দশেক আগে। বছর দু’য়েক আগে সেই চাকরি ছেড়ে দেয়। ভাড়াবাড়িতে থাকে। বাড়ির মালিক জানেন, সে সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করে। বউ এবং দু’টি বাচ্চা আছে। এখন তারা দেশে গেছে। এখানে বাড়িতে তার ছোটভাই আছে। সদ্য পাশ করে এসেছে, হপ্তাখানেক হলো। রোজগারের ধান্দায়।
এমনিতে বিশেষ কিছু কাগজপত্তর নেই। ব্যাঙ্কে একটা অ্যাকাউন্ট আছে বটে, কিন্তু খুব বেশি টাকা জমা অথবা ওঠানো হয়নি।
তবে এই ব্যবসায় নগদেই সব কাজ কারবার হয়। ট্রেনিং নেওয়ার সময় শুনেছিল, খোদ আমেরিকাতেই নগদে কারবার। যিনি দিচ্ছিলেন, তিনি বলেছিলেন, নগদে যত লেনদেন হয় সেই দেশে, সেই প্রত্যেকটি টাকাই একবার হলেও হাত ছুঁয়ে এসেছে কোনও না কোনও ড্রাগ ডিলারের। এখানেও এই ব্যবসা নগদ ছাড়া হয় না। সুতরাং ব্যাঙ্কে কিছুই থাকার কথা নয়।
বোধহয় অনেক সকালে এসেছেন। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বিশ্বরূপদা বললেন, ” কালকে ওখানকার অফিসার জয়চন্দ্র আসবে কাগজপত্তর নিয়ে। হয়তো ড্রাইভারের পরিবারের লোকও আসতে পারে। আর ওই ভাই, ওটাকে এমনি প্রোটেকশনে রেখেছে। ওকেও নিয়ে আসবে বললো ফোনে। “
একটু পরে উঠলো অমিত। বিভাসদা নিশ্চয়ই রাতে ছিলেন। তপন বলল, সকালে গেছেন। বিকেলে এলে পর নেক্সট প্ল্যান আর কি কি নতুন খবর পাওয়া গেছে জানা যাবে।
আপাতত বিশেষ কিছু করার নেই।
এই অফিসে লকআপ নেই। উল্টোদিকের একটা রুমে বন্দি করে রাখা তিনজনকেই। রুম নেই। নয়তো আলাদা করে রাখা উচিত। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো অমিত।
তিনজনই মাটিতে শুয়ে আছে। কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা তিনজনই। নিয়ম কানুন মানা প্রকাশ্যে। ভেতরে সুযোগ মতো সাবধানতা নেওয়া, যাতে পালাতে না পারে।
কম বয়সী ড্রাইভারের সহকারী গভীর ঘুমে। বাকি দু’জন হাত চোখের উপর দিয়ে শোয়া। অমিত ঢুকতেই দু’জনে দাঁড়িয়ে গেল। এক নজর দেখে মনে হল, রাতে খুব আদরযত্ন হয়নি নিশ্চয়ই। নাহলে চিহ্ন থাকতো।
চেয়ারে একটা শব্দ করে টেনে বসলো অমিত। এত জোরে, যেন ঘুম ভেঙে যায় সহকারীর। ভাঙলো, সে-ও উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
নিজে বসে, তাদেরকেও বসতে বললো অমিত। মেঝেতে। সবসময় একাসনে বসাতে হয় না। গুরুর বারণ আছে। একটা দাতা গ্রহিতার সম্বন্ধ আছে। এখন সম্মোধনও তুই তুকারির উপর উঠবে না।
ড্রাইভার আর তার সহকারীকে বলল, ” তোদের বাড়িতে আমাদের লোক গিয়েছিল। গ্রামে তোদের ফ্যামেলির ইজ্জত নষ্ট করে দিয়েছিস তোরা। কালকে আসবে হয়তো তোদের ভাই নয়তো বাবা। কে বুদ্ধি দিয়েছিল গাড়িটা চালাবার? “
এইসব প্রশ্নের কোন উত্তর হয় না। কেউ দেয় না। ওরা চুপ করেই রইলো।
এবার বিহারের ছেলেটির দিকে চোখ ফেরালো অমিত। তীব্র দৃষ্টি। লোকটা চোখ নামিয়ে নিলো।
– ” তোর কপাল ভাল। বউ বাচ্চা এখানে নেই। গ্রামের অ্যাড্রেসটা দিসনি। বলিসওনি আগে। তোর ভাইয়ের কাছ থেকে পেলাম। কালকে তোর গ্রামে আমাদের লোক যাবে। ছেলের কীর্তি সবাই জানবে।”
এও চুপ করে রইলো। অমিত, তপন কে ডাকলো। বললো, “ড্রাইভার আর ওর সঙ্গীটাকে বাথরুম করিয়ে আন।”
তিনজন সেপাই, ওদের দু’জনকে নিয়ে বাইরে গেল। অমিত আবার লোকটার দিকে দেখলো। তারপর বললো, লোকাল ড্রাইভার আর হ্যান্ডিম্যান নিয়েছিলি। ওদের পরিবারের লোক জেনেছে জেল হবেই। তোকে সামনে পেলে ছিঁড়ে খাবে। যাদের কাছ থেকে মাল কিনেছিলি, তারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। তোকেই দোষ দেবে। আর তো ওই শহরে জিন্দেগীতেও ফিরতে পারবি না। তোর ভাই…
লোকটা এই প্রথম কথা বললো। বললো, “আমার ভাই তো বেকসুর আছে। ও এই সবে নেই।”
অমিত একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।
তারপর বলল, সেটা তুই ওই লোকাল লোকগুলোকে বুঝিয়ে বলিস। তোকে না পেয়ে, তোর ভাইকে উঠিয়ে নিতে গিয়েছিল। আর জানিস তো, পাহাড়ি রাজ্যে মব লিনচিং কেমন হয়? পুলিশ থেকে শুরু করে কেউ বাঁচাতে আসবে না। নেহাত আমাদের অফিসাররা সময়মতো পৌঁছেছিল। এখন আমাদের হাতে আছে। কিন্তু ও তো অপরাধী নয়। আমাদের তো ওকে আজ নয়তো কাল ছেড়ে দিতে হবে। তারপর ওদের হাতে… সব শালা, তোর দোষে …।
লোকটি কিছুক্ষণ তাকিয়েই রইলো। তারপর বললো, ভাইকে এখানে নিয়ে আসুন সাহেব। যা লাগে সব দেবো। প্লিজ স্যার, প্লিজ।
অমিত উঠে দাঁড়ালো। কাধটা একটু ঝাঁকালো। ঘর ছেড়ে বেরুবার জন্যে পা বাড়ালো। তারপর দরজা খুলে, মুখ ফিরিয়ে বলল, ” শালে, ড্রাগের ধান্দা করিস আর তোর ভাইকে বাঁচাবো? মরনে দো হারামজাদে কো। “